আমাদের এক ও অদ্বিতীয় হুমায়ুন ফরীদি
প্রখ্যাত টিভি নাটক নির্মাতা আতিকুল হক চৌধুরী একবার অভিনয়ের জন্য এক তরুণকে দেখে দারুণ পছন্দ করলেন। ভাবলেন তার পরবর্তী নাটক “নিখোঁজ সংবাদে” সেই তরুণকে চাই। তরুণটিকে আতিকুল হক চৌধুরী ডাকলেন। প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, অভিনয় করবে টিভি নাটকে?
তরুণ বললো, ‘নিশ্চয়ই। কেন করবো না!’
আতিকুল চৌধুরী বললেন 'ঠিক আছে এমন এমন হবে নাটক, এটা তোমার চরিত্র। এভাবে অভিনয় হবে।'
আতিকুল হক চৌধুরীর বলা শেষ হওয়ার আগেই তরুণটি বললো, 'না এই নাটকটি আমি করবো না। এই নাটকটি করা আমাকে দিয়ে হবে না।'
আতিকুল হক চৌধুরী বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে পারছিলেন না। তার মুখের ওপর বিখ্যাত অভিনেতারাও এভাবে কথা বলতে পারেন না, বলার সাহসও রাখেন না। তখন তিনি টেলিভিশনে দুঁদে ও খ্যাতিমান নাট্যকার। তার পরিচালিত নাটকে অভিনয় করার জন্য অভিনয়শিল্পীরা মুখিয়ে থাকেন। সেখানেই কিনা এই ছোড়া বলছে অভিনয় করবে না! এই সুযোগ কেও হেলায় ছাড়ে!
তারপর তিনি বললেন, 'ঠিক আছে তাহলে তুমি অডিশন দাও।'
তরুণের সাফ জবাব, 'আমি অডিশনও দিতে পারবো না'।
এবার যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন আতিকুল হক চৌধুরী। তিনি এবার কৌতূহলবশত ও বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'কেন করবে না?'
তরুণটি বললো, ‘চরিত্রটা পছন্দ হয় নাই।’
আতিকুল হক চৌধুরী বললেন, 'করো, তুমি ভালো করবে।'
‘যে চরিত্রের সাথে আমি নিজেকে রিলেট করতে পারি না, সেটা আমি করবো না,’ বললো সে তরুণ।
'আচ্ছা স্ক্রিপ্টটা পড়ো, দেখো ভালো লাগবে।' আতিকুল হক চৌধুরীর অনুরোধ।
স্ক্রিপ্টটা পড়ে তরুণ এবার বললো, 'আতিক ভাই দুঃখিত আমি এই কাজটা করবো না। যে কাজটি আমার পছন্দ হয়নি, সেটা আমি যতোই ভালো করি তা কখনোই ভালো হবে না।'
পরে কেবল ওই তরুণের জন্যই নাটকের ওই চরিত্রটি পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তনের পর কাজ করলেন ওই তরুণ অভিনেতা। সেই তরুণ অভিনেতা বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়কে নিয়ে গেছেন গগনচুম্বী উচ্চতায়। তখনকার সময় সবচেয়ে জনপ্রিয় সুপারস্টারদের থেকে তার জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। বহু চলচ্চিত্র গড়ে উঠেছে কেবল তাকে কেন্দ্র করে। অথচ বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে তিনি ভিলেনের চরিত্রে। শ্যুটিং স্পটে অব্দি নায়ক কিংবা মূল চরিত্র থেকে তার প্রতিই সবার নজর। অভিনয়ের সমস্ত ধারা উপধারা ব্যাকরণ ভেঙে দিয়ে নতুন করে অভিনয়ের নিজস্ব ধারার স্রষ্টা তিনি। যাকে নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অভিনেতা। কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পী হুমায়ুন ফরীদি।
হুমায়ুন ফরীদির জন্ম ১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায়। তার বাবা এটিএম নূরুল ইসলাম ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী, আর মা বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে ফরিদী ছিলেন দ্বিতীয়।
ফরিদীর বাবা ছিলেন শিল্পানুরাগী। গ্রামে নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার কারণে তার বাবার ছিল বদলির চাকরি। ১৯৬৫ সালে মাদারীপুরের ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ফরিদী। সেই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই ১৯৬৭ সালে "মুখোশ যখন খুলবে" নাটকের মধ্য দিয়ে মঞ্চে অভিষেক হয় হুমায়ুন ফরীদির। সেই নাটকটি সেই মফস্বল শহরে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এরপর তাকে চোখে পড়ে মাদারীপুরের নির্দেশক বাশার মাহমুদের। তিনি তাকে তার দল শিল্পী নাট্যগোষ্ঠীতে নিয়ে আসেন। সেখানেই কল্যাণ মিত্রের 'ত্রিরত্ন' নাটকে 'রত্ন' চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মঞ্চে অভিষেক হয় তার। ওই দলের হয়ে 'টাকা আনা পাই', 'দায়ী কে', 'সমাপ্তি', 'অবিচার'সহ মোট ৬টি নাটকে অভিনয় করেছিলেন ফরীদি। এর মধ্যে তার বাবা বদলী হয়ে গেলেন চাঁদপুরে। তাই হুমায়ুন ফরীদিকেও চাঁদপুরে চলে আসতে হলো। ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার পর বাবার চাকরির কারণে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হলেন ফরীদি। সেখানে ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার কয়েক মাস পর শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। এর মধ্যে চাঁদপুরে একটি দলের হয়ে অভিনয় করছেন, আর তখনই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। সে সময় সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তারা যারা অভিনয় করতেন তারাই একটি যাত্রার দল গঠন করেছিলেন। ফরীদির মতে তার ভাবনা যুদ্ধপরবর্তী পর্যায়ে যে ধরনের স্বপ্ন ছিল বা যা একজন মানুষ আকাঙ্ক্ষা করতে পারে সেটি যখন প্রতিফলিত হয়নি সমাজে, সংসারে, রাজনীতিতে, তরুণ বয়সের একগুয়েমি থেকেই যাত্রার দল গঠন করা।
সেবার এক মৌসুম দুইটি নাটক নেমেছিল যাত্রায়। সেখানে দোর্দণ্ড প্রতাপে অভিনয় করেছিলেন ফরীদি। একটা পর্যায়ে দেড় বছরের মাথায় সেই দলটা ভেঙে গেল। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ফরীদির ছাত্রজীবনে প্রায় ৫ বছর বিরতি পড়েছিল। সে সময় ঘুরে বেড়ানোই একমাত্র কাজ ছিল ফরীদির।
একটা সময় তিনি ভাবলেন, এভাবে তো চলে না। পড়াশোনা তো করতে হবে। নয়তো এভাবে জীবন নষ্ট হবে। তখন পরিবার তার উপর পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিয়েছে। তাদের ধারণা ছেলে বিপথে চলে গেছে, ওকে ফেরানো আর সম্ভব না। এক পর্যায়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কিছু বন্ধু ছিল। সেই বন্ধুদের সহায়তায় ভর্তি হলেন। ভর্তি হওয়ার পেছনে আরেকটি অন্যতম কারণ ছিল ফরীদি ভালো ক্রিকেট খেলতেন। অবশেষে জাহাঙ্গীরনগরে ফরীদি বিশেষ বিবেচনায় ভর্তি হলেন অর্থনীতি বিভাগে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি থাকতেন আল- বেরুনী হলে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে একবার আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো। সেখানে তার নাটক প্রথম স্থান অধিকার করলো। মজার বিষয় হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার আগে চার বছরের বেশি সময় ধরে অভিনয় থেকে দূরে ছিলেন তিনি। সেই আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ফরীদিকে বললেন, 'আমাদের ঢাকা থিয়েটার নামে একটি নাটকের দল আছে। তুমি যদি চাও আমাদের সাথে কাজ করতে পারো। একদিন আসো দেখো কেমন লাগে তোমার।'
তো একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ঢাকা থিয়েটারের মহড়া দেখতে গেলেন ফরীদি। তখন সেলিম আল-দিনের শকুন্তলা নাটকের মহড়া চলছে। শকুন্তলা ছিল অসম্ভব কঠিন একটি নাটক। ভাষার দিক থেকে এই নাটকটি ছিল ভীষণ জটিল।
এর আগে অবশ্য নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেছিলেন, 'জাহাঙ্গীরনগর থেকে একটি ছেলে আমাদের মহড়া দেখতে আসবে। ছেলেটার নাম ফরীদি।' অপেক্ষাকৃত তরুণ অভিনয়শিল্পীরা বললো, 'আসুক, দেখি কি করে, কি আর করবে এমন। অনেকেই তো আসে, দেখি তো কেমন অভিনয় পারে।' অথচ প্রথম দিন যেই চরিত্রেই রিডিং পড়লো ফরীদি এবং যেভাবে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে অভিনয় প্রকাশ পেল সবাই স্রেফ স্তব্ধ হয়ে গেল তার অভিনয় দেখে। একমাত্র নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাদে সবাই চুপসে গেলেন।
ঢাকা থিয়েটারে থাকা অবস্থাতেই এই "শকুন্তলা" নাটকে "তক্ষক" চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই ঢাকার মঞ্চে অভিষেক হয়েছিল হুমায়ুন ফরীদির। এই নাটকে তক্ষক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। তখন এই নাটকটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তখন ঢাকা থিয়েটারে কাজ করতেন টেলিভিশনে কাজ করা প্রচণ্ড জনপ্রিয় সব অভিনেতারা। ফরীদির ভাষায় এটি "কাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, অভিনয়ের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ, কাজটি করার জন্য যে ধরনের যোগ্যতা, উপযোগিতা দরকার হয় সেটি তিনি রপ্ত করেছিলেন। মঞ্চে কাজ করবেন, মঞ্চকে একটি বিশেষ জায়গায় পৌঁছে দেয়া এসবই ছিল ফরিদির স্বপ্ন। সেটা বোধহয় সবার চোখে পড়েছিল। মঞ্চে তখন ভূত নামের একটি নাটকে নির্দেশনাই দিয়েছিলেন হুমায়ুন ফরীদি।
একে একে মুনতাসির ফ্যান্টাসি, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই, চাকা, প্রাচ্য, হরগজসহ বিখ্যাত সব নাটকে অভিনয় করেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি।
সহপাঠী যখন শিক্ষক
অভিনয়ের নেশা, ঢাকা থিয়েটারের হয়ে মঞ্চে অভিনয় আর আড্ডা একসময় তার পড়াশোনাকে গোল্লায় নিয়ে তুললো। কখনো পরীক্ষা দিতেন, কখনো পরীক্ষা দিতেন না, আর দিলেও হয়তো ফেল করতেন। অর্থনীতি বিভাগে তিনি যেন হয়ে উঠলেন আদু ভাইয়ের মতো। তখন ফরীদি তৃতীয় বর্ষে পড়েন। অর্থনীতি বিভাগে তার সহপাঠী নুরুল ইসলাম স্নাতক শেষে একই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। একদিন নুরুল ইসলাম সাহেব ক্লাসে এলেন। এসেই বোর্ডে কিছু লিখে ছাত্রদের বোঝাচ্ছেন। ঠিক তখন পেছনের বেঞ্চ থেকে কে যেন বলে উঠলো, এই নুরুল বাঁ পাশে কী লিখেছিস বুঝিয়ে বল। দেখতে পাচ্ছি না। পুরো ক্লাস তখন থ! শিক্ষককে নাম ধরে ডাকা। এতো বড় দুঃসাহস কার আছে! বাকি সবাই যখন এই কথা ভাবছে ঠিক তখন পেছন থেকে ফরীদি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, 'ওরে আমি ফরীদি। আমাকে চিনতে পারছিস না। তোর সহপাঠী। হা করে না তাকিয়ে তিন নাম্বার লাইনের ওখানে কি লিখেছিস বুঝিয়ে বল। নিজে তো পাশ করে বেরিয়ে গেলি। পাশ তো করতে হবে আমাকে তাই না? নাকি এখন আমাকে পাশ করতে দিবি না!'
তিনি কতোটা হাস্যরসিক ছিলেন তার আর একটি প্রমাণ মেলে আরেক ঘটনায়।
আল বিরুনী হলের নাম হলো হুমায়ুন ফরীদি হল
সেবার তাদের আল বিরুনী হলে যেই অংশে হলের নাম লেখা থাকে, সেই অংশ বৃষ্টি ও রোদে ভিজে ও পুড়ে “আল বিরুনী” লেখাটি মুছে গেল, তখন হল শব্দটি বাকি রইলো। তখন ছাত্ররা দাবি করলো, হলের নামটা নতুন করে লিখে দিতে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের টনক নড়লো না তখন তারা ভাবলো সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে না, তাই আঙ্গুল বাঁকা করতে হবে। তখন এক ছাত্রের মাথায় এলো এক বুদ্ধি। সেই ছাত্র একদিন গভীর রাতে হলের নাম পাল্টে দিলো। সকালে কর্তৃপক্ষ দেখে তো রেগে আগুন। দেখলো হলের জায়গায় লেখা "হুমায়ুন ফরীদি" হল। তখন হল কর্তৃপক্ষ ফরীদির কাছে প্রশ্ন করলো, কে করেছে এই কাজ? নির্লিপ্ত গলায় ফরীদি বললেন, আপনারা তো ঠিক করলেন না। তাই আমিই ঠিক করে দিলাম।
হুমায়ুন ফরীদির চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় তানভীর মোকাম্মেলের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র "হুলিয়া" চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে ১৯৮৪ সালে। অবশ্য পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে হুমায়ুন ফরীদির অভিষেক ঘটে এর পরের বছর শেখ নিয়ামত আলীর ১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বিখ্যাত "দহন" চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে বাচসাস পুরস্কার পেয়েছিলেন হুমায়ুন ফরীদি।
১৯৮৮ সালে শহিদুল্লাহ কায়সারের বিখ্যাত উপন্যাস সংশপ্তক অবলম্বনে নির্মিত হলো নাটক “সংশপ্তক”। এই নাটকে কানকাটা রমজান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। এই নাটকে রমজান চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদির অভিনয় দেখেই বোঝা যায় তিনি কোন মাপের অভিনেতা। কুটিল, ধুরন্ধর, লোভী ও একই সঙ্গে হাস্যরসে হুমায়ুন ফরীদি যেভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন চরিত্র, তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার এই চরিত্রকে বলা যায় ব্ল্যাক কমেডির নিখাঁদ চরিত্রায়ন।
চলচ্চিত্রে হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন দুর্ধর্ষ অভিনেতা। সেটি পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র হোক বা মূল ধারার গল্পপ্রধান চলচ্চিত্র। হুমায়ুন ফরীদির চলচ্চিত্রের সূচনাই হয়েছিল বিখ্যাত দুই চলচ্চিত্রকারের হাত ধরে। একজন তানভীর মোকাম্মেল অপরজন শেখ নিয়ামত আলী। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই দুই চলচ্চিত্রকারের চলচ্চিত্র যে কতোটা ব্যাপ্তিময় তা অবর্ণনীয়। গল্প প্রধান চলচ্চিত্রে যেমন হুমায়ুন আহমেদের বিখ্যাত চলচ্চিত্র শ্যামল ছায়া, নাসির উদ্দিন ইউসুফের একাত্তরের যীশু, তৌকির আহমেদ পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র জয়যাত্রা, মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী'র ব্যাচেলর, এনামুল কবির নির্ঝরের চলচ্চিত্র আহা, কিংবা রুবাইয়াৎ হোসেনের চলচ্চিত্র মেহেরজান এ যেমন দোর্দণ্ড প্রতাপে অভিনয় কয়েছিলেন হুমায়ুন ফরীদি, ঠিক তেমনি ভাবে অভিনয় করেছেন বাণিজ্যিক ধারার অজস্র চলচ্চিত্রে।
"রাঙা বউ" চলচ্চিত্রে তার কঠিন ও সাইকোপ্যাথ ধর্মী অভিনয়ের বর্ণনা দেয়া আসলে কেবল দুরূহই নয় অসম্ভবও বলা চলে। এতোখানি শক্তিমান অভিনেতার জন্য বাংলার মাটিতে হয়েছে কিনা সন্দেহ।
বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সর্বমহলে পৌঁছে গিয়েছিলেন ফরীদি। চলচ্চিত্রে এসে যেন হুমায়ুন ফরীদি নিজের প্রাণ খুলে দিলেন। তার অভিনীত বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে যেটি দেখা যায় যে শক্তিমান ও নিখুঁত অভিনয় নায়ক ও কেন্দ্রীয় চরিত্রকে বারবার ম্লান করে দেয়। হুমায়ুন ফরীদির পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ই দর্শকের নজর কেড়ে নেয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় সুপারস্টারদের থেকে তার জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। শ্যুটিং স্পটে অব্দি নায়ক কিংবা মূল চরিত্র থেকে তার প্রতিই সবার নজর। এ কেবল দুর্ধর্ষ অভিনয়ের মধ্য দিয়েই সম্ভব।
এতো খ্যাতিমান, দুর্ধর্ষ শক্তিমান অভিনেতা হওয়ার পরেও ভোলেননি নিজের শেকড়কে। মাঝেমাঝে সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন নিজের প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে। সেখানেই এক ঘটনা।
৩১৯ টাকা বাকি
একবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে ছিলেন হুমায়ুন ফরীদিও। সেই অনুষ্ঠানে সুমন নামের এক ছাত্র তাকে ঠাট্টা করে বলেছিল, ‘আপনি নাকি হলের ক্যান্টিনে টাকা দিতেন না। এখনো তো আপনার কাছে ৩১৯ টাকা পায় ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষ, জলদি পরিশোধ করবেন।’
প্রতিউত্তরে হুমায়ুন ফরীদি বলেছিলেন, না কখনোই না। এটা পরিশোধ আমার পক্ষে সম্ভব না। এটা তো আমার ক্যান্টিন, এই হল আমার, এই ক্যাম্পাস আমার, এখানের প্রতিটি মানুষের কাছে আমি আজীবন ঋণী হয়ে থাকতে চাই।'
তিনি যখন মঞ্চে তখনকার কথা বলা যায়। একবার ঢাকার মঞ্চে অভিনয় দেখছেন দর্শকসারিতে বসে। হঠাৎই বলে উঠলেন, দেখো তো মঞ্চটা কেমন একদিকে হেলে পড়ছে। পাশে বসা বাকিরা বললো কই মঞ্চ তো ঠিকই আছে। ফরীদি শান্ত গলায় বললেন, "মঞ্চটা তো অভিনয়ের কারণেই হেলছে!" তার মানে হলো একজন ভালো অভিনয় করছে ঠিক কিন্তু বিপরীত পাশসহ অভিনয়শিল্পীর অভিনয় ভালো হচ্ছে না। এই হলেন হুমায়ুন ফরীদির চরিত্র ও অভিনয়ের গভীরতা।
ব্যক্তিজীবনে ভীষণ বন্ধুবৎসল, আন্তরিক ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি।
ভর্তা কাহিনী
একবার নাটকের সেটে চঞ্চল চৌধুরীকে দুপুরের খাবারে ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে দেখেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। চঞ্চলের ভর্তা পছন্দের কথা শুনে তিনি একদিন একদিন নিজের বাসায় নানা রকমের ভর্তা বানিয়ে চঞ্চল চৌধুরীকে আসতে বলেন। চঞ্চল চৌধুরী তখন পাবনাতে। তাও ঢাকায় ফিরে তিনি যখন ফরিদীর বাসায় ঢুকলেন তখন ঘড়িতে রাত দুটো। চঞ্চল চৌধুরী গিয়ে দেখেন প্রায় ৫০ পদের ভর্তা নিয়ে সামনে বসে আছেন ফরীদি।
টিপসের ভুল
একবার তার মনে পড়লো শুটিংয়ের প্রোডাকশন বয় ইসমাইলকে টিপস দেবেন ভেবেও ভুলবশত টিপস দিতে পারেননি। যখন মনে হলো তখন রাত, বাইরে অঝোর বৃষ্টি। সেই প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে নিজে ড্রাইভিং করে গাড়ি চালিয়ে সেটে গিয়ে টিপস দিয়ে তবেই বাসায় ফিরলেন তিনি। এমনই পাগলাটে ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি।
গভীর রাতে বাড়ি ফেরার পথে শীতবস্ত্র দান
তিনি কতোটা মানবিক তা জানা যায় আরেক ঘটনায়। একবার শীতের সময় শুটিং শেষে নিজের গাড়িতে গভীর রাতে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। পথে তেজগাঁওয়ের বিজয় সরণি মোড় পার হওয়ার সময় এক বৃদ্ধ মানুষ শীতে কাঁপছেন। পরনে লুঙ্গি ছাড়া কোনো বস্ত্র নেই। তখন ফরীদি নিজের শার্ট আর কোট খুলে সেই গরীব লোকটির হাতে ধরিয়ে খালি গায়ে বাসায় ফিরেছিলেন।
হুমায়ুন ফরীদি অভিনয়ের পাশাপাশি দারুণ আবৃত্তি করতেন। ছিলেন অসম্ভব পড়ুয়া। তার বই ছিল ঘরভর্তি। কেবল তাই নয়, নিজের অভিনয়কে শাণিত করতে দেখতেন একের পর এক বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র নিয়ে তার যে জ্ঞান ও গভীরতা ছিল তা অনন্য। খুব কম অভিনয়শিল্পীর মধ্যেই তা পাওয়া যায়। ফরীদির প্রিয় ঋতু ছিল বসন্ত। তাই বলেই হয়তো স্রষ্টাও তার চলে যাওয়ার জন্য বসন্তের প্রথমদিনটিই বেছে নিয়েছিলেন।
হুমায়ুন ফরীদি প্রায়ই বলতেন, ‘আমি জীবনে তেমন কিছুই পারি না। তবে সবচেয়ে যেটা ভালো পারি সেটা অভিনয়। আমার মনে হয় অভিনয়টাই আমি কিছুটা পারি।’ সেই শক্তিমান, নিখুঁত, অনন্য অসাধারণ অভিনয়ই তাকে নিয়ে গেল গগণচুম্বী উচ্চতায়। বাংলার অভিনয়ে জগতে তাইতো হুমায়ুন ফরীদি থাকবেন চিরকাল চিরভাস্বর হয়ে।
আজকের দিনেই জন্ম হয়েছিল অভিনয়ের মহাপথিক কিংবদন্তী অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির। আজ হুমায়ুন ফরীদির জন্মদিন। জন্মদিনে পরম শ্রদ্ধায় ও নতচিত্তে স্মরণ করি অবিস্মরণীয় অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদিকে।
তথ্যসূত্র –
হুমায়ুন ফরীদির সাক্ষাৎকার/ ইমদাদুল হক মিলন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র: পাঁচ দশকের ইতিহাস/ জোয়াদ আবদুল্লাহ
আহমাদ ইশতিয়াক ahmadistiak1952@gmail.com
Comments