বাস্তবায়ন নেই, বিধিনিষেধ শুধু কাগজে-কলমে

স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে ফেরি পারাপার। ছবিটি শিমুলিয়া ঘাট থেকে তোলা। ছবি: সাজ্জাদ হোসাইন

মানুষ ও যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণসহ করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে আরোপ করা বিভিন্ন বিধিনিষেধ কার্যকরের ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলো খুব কম তৎপরতা দেখাচ্ছে। ফলে এসব বিধিনিষেধ শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

ঈদুল ফিতর উদযাপনের জন্য যারা গ্রামের বাড়িতে গেছেন, আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস বন্ধ থাকায় তারা এখন স্বাস্থ্যবিধি না মেনে, বিভিন্ন যানবাহনে গাদাগাদি করে রাজধানীতে ফিরছেন।

গতকাল শুক্রবার বাংলাবাজার, দৌলতদিয়া ও কাজীরহাট ফেরিঘাট থেকে পদ্মা পাড়ি দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় ফিরেছেন। পাশাপাশি, ঢাকার রাস্তাঘাট, কাঁচাবাজার, শপিং মল, রেস্টুরেন্ট ও পার্কগুলোতে মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তাদের অনেকেই মাস্ক পরছেন না। মানছেন না সামাজিক দূরত্ব।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আবারো সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বিধিনিষেধের শিথিলতার মধ্যে মানুষের এমন বেপরোয়া চলাফেরার কারণে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। ঈদের পর সংক্রমণ বেশ বেড়েছেও। এক সপ্তাহ আগে ২৬১ জনের করোনা শনাক্ত হলেও, গতকাল করোনা শনাক্ত হয়েছে এক হাজার ৫০০ জনের।

বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা আগেই বলেছেন, সঠিকভাবে কঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন না করা হলে, দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টসহ আরও তিনটি উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর ফলে সংক্রমণ আবারো বেড়ে যেতে পারে।

বিশিষ্ট ভাইরাসবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলন, ‘ঈদের ছুটিতে মানুষ যেভাবে দেশজুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, তাতে এসব বিধিনিষেধ যে কার্যকর করা হচ্ছে না, তা স্পষ্ট বোঝা গেছে।’  

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির এ সদস্য বলেন, ‘বাসগুলোকে রাস্তা থেকে সরিয়ে না রেখে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেওয়া উচিত।’

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘উপদেষ্টা কমিটি তাদের সুপারিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ফাইলটি সেখানেই পড়ে থাকে কয়েকদিন। এই সুপারিশগুলো কোন কর্মকর্তারা দেখেন এবং সিদ্ধান্ত নেন আমরা তা জানি না। এরপর এসব ফাইল যায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। আপনারা কি জানেন কতজন কর্মকর্তা এ প্রক্রিয়াটিতে জড়িত? এটি কাজ করার সঠিক পদ্ধতি নয়।’

শেষ পর্যন্ত কর্মকর্তারা যখন সুপারিশের বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন, ততক্ষণে আর ওই সুপারিশের সময়োপযোগিতা থাকে না বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক নজরুল।

প্রবেশমুখগুলোতে ভিড়

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুসারে, গত ১৫ মে থেকে পাঁচ দিনে অন্তত ৫৩ লাখ ৪৫ হাজার ৮২৬টি সক্রিয় মোবাইল ফোনের গ্রাহক রাজধানীতে প্রবেশ করেছেন। ৪ মে থেকে ১৫ মে’র মধ্যে এক কোটি ছয় লাখ ৪৫ হাজার ৬৯৭টি সক্রিয় মোবাইল ফোনের গ্রাহক ঢাকা ছেড়েছেন।

দূরপাল্লার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও যে মানুষের ঈদ যাত্রা থামানো যায়নি এ সংখ্যাগুলো তার প্রমাণ।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তথ্য অনুসারে, বর্তমানে শিমুলিয়া ও বাংলাবাজার ঘাটে ১৮টি, পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ঘাটে ১৬টি এবং আরিচা ও কাজীরহাট ঘাটে চারটি ফেরি দিয়ে পদ্মা পারাপারের কাজ চলছে।

বিআইডব্লিউটিএ’র শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক ফয়সাল আহমেদ জানান, ফেরিগুলো মানুষ ও যানবাহন দিয়ে ভর্তি। ভিড় কমাতে মাঝেমধ্যে কিছু ফেরির মাধ্যমে শুধু মানুষ পারাপারের কাজ চলছে।

গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশমুখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খুব বেশি তৎপরতা চোখে পড়েনি। নাম গোপন রাখার শর্তে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক কর্মকর্তা জানান, যানজট এড়াতে পুলিশ রাস্তার সব মানুষকে থামায় না।

গতকাল রাজধানীর এয়ারপোর্ট রোড, প্রগতি সরণি, ভাটারা, নতুন বাজার, গুলশান, বনানী, বিজয় সরণি ও ফার্মগেট এলাকায় বেশ যানজট দেখা গেছে। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও অনেক রেস্টুরেন্ট খোলা ছিল। মসজিদগুলোতেও ছিল ভিড়।

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মহামারির শুরু থেকেই সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু, এগুলো শুধু কাগজেই রয়ে গেছে। খুব সামান্যই কার্যকর হয়েছে। এখানে লকডাউন একটি ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছুই না। এর কোনো প্রয়োগ নেই।’

আন্তঃজেলা বাস না চললেও, এগুলো ছাড়াই চলাচলের প্রক্রিয়া মানুষের জানা আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘মানুষ কী করতে পারবে এবং কী করতে পারবে না, লকডাউন বিষয়ক নির্দেশনায় তা বলা আছে। কিন্তু, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ভ্রমণ করতে পারবে না, আলাদা করে এমন কোনো কথা বলা হয়নি। এটি পদ্ধতিগত একটি সমস্যা। মানুষ যদি জানতো কোনোভাবেই ভ্রমণ করা সম্ভব না, তাহলে তারা সেই চেষ্টাও করতো না।’

ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় অনেক দ্রুতি ছড়ায় বলে এটি উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক রিদওয়ানুর।

তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের জনসংখ্যার চার শতাংশকে টিকা দিয়েছি। করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হলে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কারণে সংক্রমণ অনেক বেড়ে যেতে পারে।’

Comments