বিপর্যয় ঠেকানোর সক্ষমতা নেই দুর্বল স্বাস্থ্য খাতের
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতার যে অবস্থা, তাতে করোনা সংক্রমণ কোনো কারণে অনেক বেড়ে গেলে বা ভারতের মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত বছরের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতার কিছুটা উন্নতি হলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও এটি যথেষ্ট নয়।
সরকার এখনও ২৯টি জেলায় সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা পৌঁছে দিতে পারেনি। দৈনিক কোভিড-১৯ পরীক্ষার সংখ্যা এখনো অপ্রতুল। এ ছাড়া, দেশের ৪২১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বেশিরভাগেরই প্রয়োজনীয় জনবল নেই। গুরুতর অসুস্থদের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ হাই-ফ্লো অক্সিজেন এবং অন্যান্য জীবনরক্ষাকারী উপকরণেরও সংকট রয়েছে এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে দৈনিক করোনা শনাক্তের হার কমতে থাকলেও, গত তিন দিন ধরে আবারও বাড়তে শুরু করেছে। ১৫ মে দেশে ২৬১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। গতকাল বুধবার শনাক্ত হয়েছে এক হাজার ৬০৮ জনের।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য আগেই সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, সংক্রমণ কমলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ নেই। কারণ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টসহ ‘উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত চারটি মিউটেটেড করোনাভাইরাস ইতোমধ্যে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি, নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্টও সামনে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গত বছর আমরা যেখানে ছিলাম, এখনো প্রায় সেখানেই আছি। জেলা পর্যায়ের অনেক হাসপাতালেই এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়নি। এখনো বড় পরিসরে অ্যান্টিজেন-ভিত্তিক পরীক্ষা চালু হয়নি। দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা খুবই কম।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন।
তিনি বলেন, ‘আগে আমাদের কিছুই ছিল না। এখন কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য সাত হাজার বেড আছে। কিন্তু, রোগীর সংখ্যা ২১ হাজার হয়ে গেলে আমরা কী করব? সেজন্য আমাদের পরিস্থিতি বুঝে বিশেষায়িত ব্যবস্থা নিতে হবে।’
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম চীনের উহান শহরে করোনার প্রাদুর্ভাবের পরই অন্যান্য দেশকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তখন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১৫টি শয্যা আলাদা করে রাখে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ঢাকার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালকে দেশের প্রথম করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। এ ছাড়া, জেলা পর্যায়ের সব হাসপাতালে পাঁচ শয্যার আইসোলেশন ইউনিট স্থাপনের নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এক বছরের বেশি সময়ে কোভিড রোগীর বেডের সংখ্যা, সরকারি পূর্ণাঙ্গ কোভিড হাসপাতাল ও হাসপাতালে কোভিড ইউনিট বহুগুণে বেড়েছে।
গতকালের হিসাব অনুযায়ী, কোভিড আক্রান্তদের জন্য সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপতালগুলোতে ১১ হাজার ৯৯১টি সাধারণ বেড এবং এক হাজার ১৭১টি আইসিইউ বেড রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরের ১৫টি হাসপাতালে তিন হাজার ৪৪০টি সাধারণ বেড এবং ৩৭৪টি আইসিইউ বেড রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের চারটি হাসপাতালে রয়েছে ৪৩২টি সাধারণ বেড এবং ৩৩টি আইসিইউ বেড।
এ ছাড়া, হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক, নার্স ও অন্য কর্মীদেরও স্বল্পতা রয়েছে। এ সমস্যাটিও যে সঠিকভাবে সমাধান করা যায়নি, সে ব্যাপারে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা একমত।
অক্সিজেন সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ
গত বছর মার্চে যখন দেশে মহামারি আঘাত হানে তখন হাতেগোনা কয়েকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া জেলা পর্যায়ের প্রায় সব হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না।
তবে, এপ্রিলের শেষদিকে ৭৩টি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়। আরও ৬১টি হাসপাতালে এ ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ফরিদ হোসেন মিয়া।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের জুনের মধ্যে জেলা পর্যায়ের ১৩৪টি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হবে। গতকাল পর্যন্ত এক বছরে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে হাই-ফ্লো নাসাল ক্যানুলার সংখ্যা বাড়িয়ে এক হাজার ৬০৯টি করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এসব ক্যানুলার ৪৮৬টি ঢাকা শহরের করোনা-ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতাল বা ইউনিটে এবং ৪৬টি চট্টগ্রাম শহরের করোনা-ডেডিকেটেড সরকারি হাসপাতাল বা ইউনিটে রয়েছে। এ ছাড়া, ঢাকার ২৭টি ও চট্টগ্রামের চারটি বেসরকারি হাসপাতালে ৩৯৫টি ক্যানুলা আছে। দেশের অন্যান্য স্থানের জন্য আছে মাত্র ৬৯৯টি হাই-ফ্লো নাসাল ক্যানুলা।
অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই সংখ্যাটা এমন শুনছি। অগ্রগতি খুবই কম। হাসপাতালের সেবার বিকেন্দ্রীকরণ করতে না পারলে আমরা প্রস্তুতিকে সন্তোষজনক বলতে পারি না।’
গত ২৪ ঘন্টায় ভারতে করোনা আক্রান্ত হয়ে চার হাজার ৫২৯ জন মারা গেছে। এখন পর্যন্ত যা দেশটিতে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা এটি।
প্রতিবেশী দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে গত ৪ মে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারকে (সিএমএসডি) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ৪০টি অক্সিজেন জেনারেটর আমদানি করতে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে, সেজন্য মন্ত্রিসভার ক্রয় কমিটির অনুমোদন দরকার বলে জানিয়েছিলেন কর্মকর্তারা।
গতকাল মন্ত্রিসভা কমিটির অর্থনীতি বিষয়ক বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল সঠিক সময়ে উদ্যোগ নেওয়ার। কিন্তু, তারা তা করেনি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের যেহেতু কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, এখন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। কোভিড -১৯ পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা সিএমএসডিকে সরাসরি ৪০টি অক্সিজেন জেনারেটর কেনার অনুমোদন দিয়েছি।’
স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি জেনারেটর একসঙ্গে ১০০ জন রোগীকে ২৪ ঘণ্টা হাই-ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম।
সম্প্রতি গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘হাসপাতালগুলোতে আমাদের সাধারণত দৈনিক ৭০-৮০ টন অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে দৈনিক চাহিদা বেড়ে ২১০ টন হয়ে যায়। তবে, দেশেই দৈনিক ২২০ টন অক্সিজেন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে আমাদের।’
ভারতের অক্সিজেনের ঘাটতি বিবেচনা করে সরকার এক হাজার ৩৫০ টন তরল অক্সিজেন মজুদ করেছে বলে জানান তিনি।
এখনো হচ্ছে না পর্যাপ্ত নমুনা পরীক্ষা
সরকার গত বছরের ২১ জানুয়ারি থেকে করোনা পরীক্ষা শুরু করলেও প্রথমবারের মতো গত মাসে দৈনিক নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে। যদিও গত সপ্তাহে দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা গড়ে ২০ হাজারের নিচে ছিল।
এমনিতে সাধারণত দৈনিক ১৫ হাজারের মতো নমুনা পরীক্ষা করা হয়। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষার সংখ্যা এরচেয়েও অনেক কমে যায়।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত হাজারে মাত্র ৩৫টি নমুনা পরীক্ষা করতে পেরেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। আওয়ারওয়ার্ল্ডইনডাটা ডট অরগের তথ্য বলছে, মালদ্বীপে প্রতি এক হাজারে এক হাজার ৪৭১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে, ভুটান প্রতি হাজারে ৯৬৬টি নমুনা পরীক্ষা করে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। এ ছাড়া, প্রতি হাজারে ২২৬টি নমুনা পরীক্ষা করে ভারত তৃতীয়, ১৪৯টি নমুনা পরীক্ষা করে শ্রীলঙ্কা চতুর্থ, ৯৫টি নমুনা পরীক্ষা করে নেপাল পঞ্চম এবং ৫৬টি নমুনা পরীক্ষা করে পাকিস্তান ষষ্ঠ অবস্থানে আছে।
অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান বলেন, ‘পরীক্ষার সংখ্যা খুবই কম। আপনি পর্যাপ্ত পরীক্ষা করছেন না, এর অর্থ আপনি সংখ্যা লুকাচ্ছেন। এভাবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সম্প্রতি যখন সংক্রমণ বেড়ে গিয়েছিল, তখন আমরা পরীক্ষা ছাড়াই রোগীদের করোনা হাসপাতালে আসতে দেখেছি।’
সরকার অ্যান্টিজেন পরীক্ষার অনুমতি দিতে অনেক বেশি সময় নিয়েছে এবং এখনও এটি সব জায়গায় হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৩০০টি অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকার শুরু থেকেই একটি সুসংবদ্ধ পদ্ধতিতে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির (এনটিএসি) সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘হাসপাতালের সক্ষমতা এখনো পর্যাপ্ত না। শেষবার সংক্রমণ বাড়ার সময় অক্সিজেন ও আইসিইউ সুবিধার অভাবে আমরা অনেক রোগীকে মারা যেতে দেখেছি। যেহেতু আমরা আবারও সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা করছি, বিশেষ করে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের জন্য, সেহেতু এ প্রস্তুতি নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব না।’
তিনি বলেন, ‘জেলা হাসপাতালগুলো ভালোভাবে প্রস্তুত না থাকায়, বিশেষ করে সেখানে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকায়, রোগীরা ঢাকায় ছুটে যান। এটি মোটেই ভালোভাবে চলছে না। সরকারকে এর সমাধান করতে হবে।’
অক্সিজেন সরবরাহ সক্ষমতা বিষয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বেসরকারি শিল্পখাত থেকে অক্সিজেন মজুদ বাড়ানো কোনো সমাধান নয়। আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে।’
দৈনিক নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়ানোর ওপরও জোর দেন তিনি।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম
Comments