রোজিনারা একা নয়
বাংলাদেশে বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়ন আছে। এর একটা অংশ সরাসরি বিএনপি কর্মী, আরেক অংশ আওয়ামী লীগের। এক অংশের নেতারা বিএনপির, আরেক অংশের নেতারা লজ্জাহীনভাবে আওয়ামী লীগের সিল পিঠে মেরেছেন। এতে তাদের গর্বিত হতেই দেখা যায়। আওয়ামী লীগের শাসনকালে যে অংশের নেতারা সরকারি দলের নেতা হিসেবে চিহ্নিত, তারা যখন-তখন প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছে যান। এদের কেউ কেউ ইউনিয়নের নেতৃত্বকে পুঁজি করে এমপি হয়েছেন। মন্ত্রী-সচিবের পদমর্যাদায় নানা সুবিধা নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। অতিরিক্ত ধূর্ত, চোপা-রুস্তমরা নিয়েছেন ব্যবসায়িক সুবিধা। মালিকানা পেয়েছেন রেডিও, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের। প্লট, ফ্ল্যাটসহ ছোট বড় হাজারো সুবিধার কথা না বললেও চলে।
সরকারি দলের কর্মী হিসেবে চিহ্নিত এসব নেতাদের দাপট দেশের জনগণ নানা সময়ে দেখেছেন। মন্ত্রীদের মত তাদের গাড়ি রাস্তার উল্টো পথ দিয়ে চালাতে গিয়ে বিপত্তি হলে বা ভুল করে পুলিশ আটকে দিলে মারমুখী হয়ে যান তারা। পুলিশের তখন ‘ভাত চাইনা কুত্তা সামলা’র অবস্থা হয়।
সোমবার দুপুরে যখন রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আটকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছিল, মাঠ পর্যায়ের রিপোর্টারদের ফেসবুক পোস্টের সুবাদে সারাদেশের মানুষ তা জেনে যান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রোজিনা ইসলামকে গলা চেপে ধরার ছবিও ছড়িয়ে পড়ে। একই কক্ষে ছয় ঘণ্টা ধরে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই ছয় ঘণ্টা সময়ে সাংবাদিক ইউনিয়নের দাপুটে নেতারা কী করেছিলেন? তারা চাইলে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করে সেখান থেকেই রোজিনা ইসলামকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পারতেন। দুঃখজনক হলেও সত্য এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান হয়নি। এসব নেতাদের কেউ সচিবালয়ে গিয়ে রোজিনাকে উদ্ধারের কোনো তৎপরতাও দেখাননি। এর কারণ কী হতে পারে? তারা কী রোজিনাকে তাদের দলের অর্থাৎ দালাল ইউনিয়নের সদস্য ভাবেননি?
রাত ৮টা নাগাদ যখন অসুস্থ রোজিনা ইসলামকে হাসপাতালে না পাঠিয়ে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল, রাত ১২টা নাগাদ মামলা রেকর্ড করে গ্রেপ্তার দেখানো পর্যন্ত প্রায় চার ঘণ্টা লেগেছে। সেই সময়ে মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকরা শাহবাগে বিক্ষোভ করেছেন। ইউনিয়ন নেতারা কী ভূমিকা রেখেছিলেন? যদিও দু-একজন নেতৃস্থানীয় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে মন্ত্রী পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার কথা জানিয়ে সমাধান করে ফেলেছেন বলে নিজের ক্ষমতার জানান দেন, কার্যত কোনো কাজ না হওয়ায় এসব নেতাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য টকশোতে গলা ফাটিয়েছেন, যার কার্যত কোনো মূল্যই নেই।
অসুস্থ রোজিনা ইসলামকে সারারাত থানায় থাকতে হয়েছে। সকালে আদালতে নেওয়ার পর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। জামিন আবেদন শুনানির জন্য আদালত বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেছেন। যদি সেদিন তার জামিন নামঞ্জুর হয়, রোজিনাকে দীর্ঘ দিন কারাভোগ করতে হতে পারে। এমন হলে উচ্চ আদালত ছাড়া তিনি যে জামিন পাবেন না, সেটা তখন স্পষ্ট হবে। সবাই জানেন, উচ্চ আদালতে জামিনের জন্য আপিল প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ এবং সেখানে আপিল শুনানির লাইনও দীর্ঘ।
রোজিনা ইসলামের প্রতিষ্ঠান প্রথম আলো দেশের প্রধানতম এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী পত্রিকা। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় রোজিনা ইসলাম একটি বিশ্বস্ত নাম। বিগত দিনগুলোতে প্রথম আলোতে প্রকাশিত রোজিনার প্রায় সব প্রতিবেদন ব্যাপক আলোচিত। রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণের স্বার্থে প্রতিবেদনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জনস্বার্থ প্রশ্নে এই প্রতিবেদনগুলো ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।
একজন কর্মরত সাংবাদিককে ‘‘আন-ল’ফুল কনফাইন্ডমেন্টের” অভিযোগে সচিবের একান্ত সচিবের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ প্রথম আলো বা রোজিনার পরিবার করতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেছা হকের বিরুদ্ধেও রোজিনা ইসলামকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার অভিযোগে মামলার উদ্যোগ নিতে পারে তার পরিবার। সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনুমোদন ছাড়া থানা মামলা নিবে না, নিশ্চিত করে বলা যায়। কিন্তু আদালতে মামলা দায়েরের সুযোগ রোজিনার পরিবার কেন হাতছাড়া করবে? শোনা যাচ্ছে রোজিনার পরিবার মামলা করার কথা ভাবছে, খুবই অপরিহার্য। কোনো অন্যায়ের ছাড় দেওয়াটা আরেকটি অন্যায়কে স্বাগত জানানোর মতোই। তাই রোজিনার পরিবারের পাশে আমরা দাঁড়াতে চাই।
রোজিনা ইসলামকে গলা চেপে ধরে যিনি শারীরিক নির্যাতন করেছেন, তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তিনি এবং তার সহকর্মীরা দেশের একজন নাগরিকের সঙ্গে গুণ্ডামি করে উল্টো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে রোজিনাকে জেলে ভরেছেন। আইন ভেঙ্গেছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন।
ঘটনাটি কি কেবল একজন ব্যক্তি রোজিনার গলা চেপে ধরা? প্রকৃত অর্থে পুরো সাংবাদিক সমাজের গলা চেপে ধরে একটা বার্তা দিতে চাওয়া যে, এ দেশে দুর্নীতি, অনিয়ম, নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে যেই মুখ খুলবে বা কলম ধরবে, তাকে ভবিষ্যতে আরও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। বিগত কয়েক বছর ধরে মফস্বলে সাংবাদিকদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাবানরা এ ধরনের নির্যাতনমূলক আচরণ করে আসছিলেন। তার কোনোটিরই আসলে সুষ্ঠু বিচার তো দূর, ঠিক মতো তদন্তও হয়নি। সাংবাদিক ইউনিয়ন চুপ থেকেছে। কারণ নেতারা ব্যস্ত থাকেন নিজের ধান্ধায়।
মফস্বলের ঘটনাগুলো থেকে উজ্জীবিত হয়ে এবার ঢাকাতে এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিককে সচিবালয়ে আটকে নির্যাতন করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে পাবলিক সার্ভেন্টরা।
আমার মনে হয়েছে, রোজিনাকে করা নির্যাতন ও ফাঁসিয়ে জেলে ঢুকানোর ঘটনাটি তারা নিয়েছে টেস্ট কেস হিসেবে। এই ঘটনা সফলভাবে হজম করতে পারলে আগামী দিনগুলোতে দুর্নীতিবাজ প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের স্তুতিবাক্য ছাড়া কোনো কিছু লিখলে বা বললে লেখক বা সাংবাদিকের স্থায়ী ঠিকানা হতে পারে কাশিমপুর অথবা কেরানীগঞ্জে।
রোজিনা ইসলামের ঘটনায় সাংবাদিক ইউনিয়নের ভূমিকা হতাশাজনক। ঘটনার একদিন পর তারা একটি বিবৃতি দিয়েছে আর তিন দিন পর বৃহস্পতিবার একটা বিক্ষোভ কর্মসূচি রেখেছে। অথচ সেই সময়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তারা রোজিনাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে পারতো। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করে তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারতো। তবে এডিটরস গিল্ড ঘটনার রাতে তাৎক্ষণিক বিবৃতি দিয়ে রোজিনার মুক্তি চেয়েছে। এ জন্য এডিটরস গিল্ডের নেতাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য।
দ্বিধাবিভক্ত অকার্যকর নেতৃত্বের দুর্বল সাংবাদিক ইউনিয়নের কাছে কোনো কিছু আশা করাটাই দুরাশা। বর্তমানে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যে একমাত্র রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ঐক্য আছে। এর সদস্যরা নানা রাজনৈতিক মতাদর্শের হলেও সেখানে রাজনৈতিক বিভাজন প্রকাশ্য নয়। এই অরাজকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে গড়ে তুলতে পারে কেবল রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং তারা যথাযথ ভূমিকা পালন করছে শুরু থেকে এবং তারা তা জারি রাখবে বলে বিশ্বাস করি।
ইউনিটির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে রিপোর্টার্স ইউনিটির জোরালো ও আপোষহীন ভূমিকা আশা করি। তবে রিপোর্টার্স ইউনিটির নেতাদের খুব সতর্কতার সঙ্গে এগুতে হবে। এর মধ্যে ইউনিয়নবাজ চিহ্নিত নেতাদের এই আন্দোলনে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হবে। অন্যথায় সব কর্মসূচি নস্যাৎ করে কেউ কেউ ব্যক্তি সুবিধা নিতে পারে, যেমনটি নিয়েছিল সাগর-রুনি হত্যার বিচারের আন্দোলনের সময়।
রোজিনার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটি এতোই দুর্বল, যা আইনি লড়াইয়ে উড়ে যাবে, এইটা আমলাতন্ত্র বুঝতে পারলেই সাংবাদিক নেতাদের ব্যবহার করে নিজেদের মান-সম্মান বাঁচানোর জন্য সমঝোতার নামে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা করবে, নিশ্চিত। মামলার এজাহারের ভাষাই বলে দেয় যেন-তেনভাবে একটা দুর্বল মামলা দিয়ে আমলারা সব সাংবাদিকদের ভয় দেখানোর সুযোগ নিয়েছে। এই মামলায় আসলে সমঝোতার কিছু নেই। রোজিনা ইস্যুতে মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিক বিশেষ করে রিপোর্টারদের মধ্যে যে ঐক্য তৈরি হয়েছে এবং একইসঙ্গে সর্বস্তরের সাংবাদিক প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন, এটা ধরে রাখা ভীষণ জরুরি, যাতে প্রশাসনের অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী অথবা দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকরা ভবিষ্যতে কোনো একজন সাংবাদিককে পেশাগত কাজে বাঁধা দেওয়া, হেনস্তা বা অসদাচরণের দুঃসাহস দেখানোর কল্পনাও না করে।
রিপোর্টার্স ইউনিটির সদস্যরা যারা সচিবালয় বিটে কাজ করেন, তাদের কাছে আশা- আগামী এক মাস স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং এর সব বিভাগের সব অনিয়ম, দুর্নীতির খবর বের করাকে রুটিন কাজ মনে করে একটানা খবর প্রকাশ করে যাবেন। রোজিনার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অনাচারের পিছনে যে কেবল সচিব, অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা জড়িত, তা নাও হতে পারে। এর শিকড় থাকতে পারে অনেক গভীরে। রোজিনাকে নির্যাতনের সুষ্ঠু বিচার পেতে হলে স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সবার মুখোশ খুলে দিতে হবে। এদের অনেকের দেশে-বিদেশে প্রচুর সম্পদের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে এদের সব দুর্নীতি প্রমাণ করে বিচারের মুখামুখি করতে পারলেই সহকর্মী রোজিনার সঙ্গে করা গুণ্ডামি, অন্যায়, অত্যাচারের জবাব দেওয়া যাবে। একইসঙ্গে পাল্টা বার্তা দেওয়া হবে যে, রোজিনারা একা নয় আর সব সাংবাদিক দালাল নয়।
জসিম আহমেদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments