তোমারে দেব না ভুলিতে: নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরী
উপমহাদেশের স্বনামধন্য নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরী। তার প্রকৃত নাম রশীদ আহমেদ চৌধুরী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার সমান খ্যাতি ছড়িয়ে রয়েছে। তারই নামানুসারে স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র বুলবুল ললিতকলা একাডেমী। নৃত্যশিল্পের বাইরে তিনি লেখক হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন পাঠকের কাছে।
১৯১৯ সালের ১ জানুয়ারি বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন বুলবুল চৌধুরী। পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের চুনতি গ্রামে। পিতা মোহম্মদ আজমউল্লাহ চৌধুরী, মাতা মাহফুজা খাতুন। টুনু ছিল তার আদরের ডাকনাম। বাবার এক বন্ধু পূর্ণেন্দু গোস্বামী তাকে দেখে বলেছিলেন, ‘টুনুর কপালে কলালক্ষ্মী যেন জয়তিলক এঁকে দিয়েছে। এ ছেলে একদিন যশস্বী হবে।’ আসলেই তাই হয়েছেন। তার কীর্তির কারণে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বলা হয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় নৃত্যের আঙিনায় যে মুক্তধারার স্রোত এনেছিলেন, সে ধারায় জোয়ার এনেছিলেন বুলবুল চৌধুরী।
তার সহধর্মিণী নৃত্যশিল্পী আফরোজা বুলবুলের আত্মকথা ‘সুন্দর এই পৃথিবী আমার’। বইটিকে এ অঞ্চলের নৃত্যচর্চার অনবদ্য দলিল বলা যেতে পারে। এতে উঠে এসেছে অজানা জীবনের গল্প। বিশেষত বুলবুল চৌধুরীর আগে বাঙালি মুসলমান সমাজে নাচের চর্চা ছিল না বললেই চলে। অথচ সেই ‘নিন্দিত ও নিষিদ্ধ’ শিল্পকে আমাদের সমাজে বুলবুলই প্রথম ‘জাতে তুলেছেন’, নৃত্যশিল্পকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার সহধর্মিণী আফরোজা বুলবুলকে নিয়ে তিনি এ অঞ্চলের নৃত্যের প্রচার ও প্রসারে রেখে গেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব ছিল তার ওপর। তাই তো তার কবিতার বই শেফালিকা উৎসর্গ করেন। লেখেন, ‘হে বিশ্বকবি, হে কবিগুরু তোমার চরণ পরে আমার দরদ দিয়ে লেখা কবিতার সংকলন শেফালিকাকে সমর্পণ করে ধন্য হলুম...।’ বুলবুল চৌধুরীর মধ্যে কবি নজরুল ইসলামেরও (লন্ডনে কবির সঙ্গে দেখা হয়েছে) প্রভাব ছিল। শখ করে তার মতো চুলও রেখেছিলেন। স্কুলজীবনেই লেখেন ‘শেফালিকা’ ও ‘বুলবুলি’ (কবিতার বই)। সেই সঙ্গে উদয় শঙ্করের প্রতি ছিল তার অগাধ শ্রদ্ধা। বেশ কিছু নৃত্যানুষ্ঠান দেখে তার নৃত্য, পোশাক, আবহসঙ্গীত, আলোর প্রক্ষেপণ বুলবুলকে নাড়া দিয়েছিল।
তবে তিনি ধারণ করতেন নিজস্বতা। বুলবুল চৌধুরী দেশ-বিদেশে নৃত্য পরিবেশন করে অর্জন করেন সুনাম। বইটি থেকে আরও জানা গেছে, ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত অসংখ্য নৃত্যরূপ রচনা করেছিলেন তিনি। এদেশের নৃত্যশিল্পকে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছেন। তার ছোট বোন সুলতানা রাহমানের অনুপ্রেরণায় তিনি এ সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নৃত্যরূপের মধ্যে রয়েছে ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাঁওতালি নৃত্য’, ‘ভ্রমর’, ‘চাঁদ সুলতানা’, ‘আনার কলি’, ‘সোহরাব-রুস্তম’, ‘জীবন ও মৃত্যু’, ‘ফসল উৎসব’ ইত্যাদি।
তার নামে ঢাকা, করাচি, কলকাতা ও লন্ডনে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মানিকগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় এলাকায় আয়োজিত এক বিচিত্রানুষ্ঠানে ‘চাতকনৃত্য’ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে নৃত্যশিল্পী হিসেবে বুলবুলের যাত্রা শুরু হয়। মঞ্চে একটি ছেলের নাচ, তাও আবার ছেলেটি মুসলমান পরিবারের!
মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালের ১৭ মে মারা যান নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরী। স্বামীর মৃত্যুর পর থমকে থাকেননি আফরোজা বুলবুল। স্বামীর মতো তিনিও নৃত্যকে হৃদয়ে ধারণ করে নৃত্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তার বর্ণাঢ্য জীবনের স্মারক ‘সুন্দর এই পৃথিবী আমার’।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, ‘বুলবুল চৌধুরীর মৃত্যুর পর আফরোজা বুলবুল নিবেদিত থাকেন নৃত্যশিল্পে। তার একান্ত প্রচেষ্টাতেই পাকিস্তানের করাচিতে প্রতিষ্ঠিত হয় বুলবুল ইনস্টিটিউট অব কালচারাল ও ঢাকায় বুলবুলের বন্ধু মাহমুদ নুরুল হুদার সাহায্যে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা)। বুলবুল চৌধুরীকে নিয়ে তার স্মৃতিচারণা আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির জগতে মহামূল্যবান। ব্যক্তি বুলবুলের পাশাপাশি বইটিতে রয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার নানা উপাদান।’
আফরোজা বুলবুলের স্মৃতিকথা থেকে আরও জানা যায়, কলকাতায় বুলবুলের প্রথম নৃত্যানুষ্ঠান ছিল বেকার হোস্টেল কিংবা প্রেসিডেন্সি কলেজের এক বিচিত্রানুষ্ঠানে। যখন তিনি ওই কলেজের ছাত্র ছিলেন। এরপর ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল, ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল রি-ইউনিয়নসহ নানা অনুষ্ঠানে তিনি নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন। একজন শৌখিন নৃত্যশিল্পী হিসেবে এসব অনুষ্ঠানে তার পরিবেশনা, বিষয়-পরিকল্পনা, উপস্থাপনা রীতি শিল্পবোদ্ধাদের আকৃষ্ট করেছিল।
ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের অনুষ্ঠানে বুলবুলের ‘সাপুড়ে নৃত্য’র সঙ্গে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন সরোদ শিল্পী সন্তোষ চন্দ্র। যিনি উদয় শঙ্করের নৃত্যানুষ্ঠানেও তিমিরবরণের যন্ত্রীদলের হয়ে বাজিয়েছেন। পরে দেশ-বিদেশে বুলবুলের অনেক অনুষ্ঠানে তিনি অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করেছিলেন। এ ছাড়া সাধনা বসু ও রুশ নৃত্যশিল্পী নিনা কিমটোভিচসহ অনেকের নাচের সঙ্গেও বাজানোর সুযোগ হয়েছিল তার। সেসব অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তীকালে বুলবুল জীবনীকার নীলরতন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বেশ জোরের সঙ্গেই বলতে পারি যে আমাদের দেশে কোরিওগ্রাফার হিসেবে উদয় শঙ্করের পর বুলবুলই শ্রেষ্ঠ।’ ফরিদ বুলবুলের প্রচ্ছদে অ্যার্ডন প্রকাশিত বইয়ের বর্ণনায় ঐতিহাসিক অনেক ঘটনাকে নৃত্যে রূপদান করে তিনি হয়েছেন চিরস্মরণীয়।
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালে মুলতান ও লাহোরে বুলবুল ও তার দলের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বিক্ষোভ ও কালো পতাকা প্রদর্শন করেছিল। কিন্তু, কোনো কিছুই বুলবুলকে তার লক্ষ্য থেকে ফেরাতে পারেনি। এমনই ছিল তার আদর্শ ও নৈতিকতার সাহস। যা সবার জন্যে অনুপ্রেরণার। শিল্পী হিসেবে বুলবুল ছিলেন ভীষণ রাজনীতি-সচেতন। তবে তিনি সরাসরি কখনো কোনো রাজনৈতিক দল বা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হননি। সাধারণভাবে গণমানুষের স্বার্থের পক্ষে ও তাদের মুক্তির লক্ষ্যে শিল্পচর্চায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তার অনেকগুলো নৃত্য পরিকল্পনায় সে অঙ্গীকারের প্রতিফলন ঘটেছে।
সেই সময় মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরেও বুলবুলের নৃত্যানুষ্ঠানের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উদ্যোগে অপপ্রচার ও বিক্ষোভ দেখানো হয়েছিল বলে বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু, কোথাও তিনি পিছু হটেননি। যেখানেই গেছেন, সেখানেই বাধা অতিক্রম করে, স্থানীয় প্রগতিশীল যুব শক্তি ও প্রশাসনের ভেতরের শুভবুদ্ধিসম্পন্নদের সহায়তায় অনুষ্ঠান করেছেন। তাকে একবার কুষ্টিয়ায় বলা হয়, ‘শরিয়ত বিরোধী কাজ করতে দেব না।’ ময়মনসিংহ ত্যাগ করতে বলা হলে আবুল মনসুর আহমদ পাশে ছিলেন। লাহোরে কালো পতাকা দেখানো হয়। বেকার হোস্টেলে থাকার সময় হোস্টেলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করবেন বললে মুসলিম দলের নৃত্যানুষ্ঠানে আপত্তি তোলে অনেকেই। তবু তিনি তার আদর্শ থেকে কখনো সরে আসেননি।
এমন আলো ক্রমান্বয়ে কীর্তি ছড়িয়ে পড়লে জাতীয় শিল্পী হিসেবে পরিগণিত হন বুলবুল। তত্কালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান তার নাচ খুব পছন্দ করতেন ও ভালোবাসতেন। তার মৃত্যুর পর মিসেস লিয়াকত আলিও বুলবুলের পাশে ছিলেন। ১৯৫০ সালে করাচির মেট্রোপল হোটেলে দেশি-বিদেশি অতিথির সামনে অসাধারণ একটি ভাষণ দেন বুলবুল চৌধুরী। সেখানে নিজেকে একজন বাঙালি শিল্পী হিসেবে পরিচয় দেন। সরকারিভাবে পাকিস্তানের জাতীয় শিল্পী হলেও অসাম্প্রদায়িক বুলবুল চৌধুরী মনে-প্রাণে ভালোবাসতেন বাঙালি সমাজকে।
Comments