একজন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
অতি কথনের দেশে শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি সমাজে বহুল আলোচিত ব্যক্তিত্ব স্বল্পভাষী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বোধ-বুদ্ধিতে পরিচিতি পেয়েছেন দেশের শীর্ষ গবেষক, চিন্তাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। সরস গদ্যে বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকেই তার গবেষণা বাঙালি মুসলমানের মানসযাত্রা প্রসঙ্গ বাংলাদেশের গবেষকদের মধ্যে চিন্তার বীজ বপন করেছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা— অদ্যবধি সমাজ জীবনের অসংগতি ও সংকট মোচনের জন্যে বাঙালি যে সংগ্রাম করে চলছে, তাতে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ সংবিধানের বাংলা অনুবাদক আনিসুজ্জামান তার সব কাজের মধ্য দিয়ে জাতির শেকড় অনুসন্ধান করেছেন।
ফলে বিদ্বৎসমাজে তার জীবনাচার বিস্ময়কর এবং আলোচনা করার মতো রয়েছে অনেক দিক। তীক্ষ্ণ মেধার বিরলপ্রজ এই মানুষের জীবনবোধ সমাজের নানান অলিগলিতে প্রভাব ফেলেছে। সময়, সমাজ ও রাজনীতি সচেতন শিক্ষক বিচার বিবেচনায় কাজ করেছেন বহু নিরিখে। কখনো শিষ্য, কখনো গুরু। আবারা কখনো মঞ্চে, কখনো সভাপ্রধান হিসেবে সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে সমস্যাকে মোকাবিলা করেছেন।
আনিসুজ্জামান ২০১৭ সালে আশিতম জন্মবার্ষিকীর অভিভাষণে বলেন, ‘অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক আফসোস করতেন, “আপনি তো আর লেখাপড়া করলেন না!” তার মতো মানুষের প্রত্যাশা যে আমি পূরণ করতে পারিনি, তা আমার জন্য দুঃখের বিষয়। ভেবে দেখেছি, আশানুরূপ কিছু করতে না পারার তিনটে কারণ আছে আমার— সামাজিক অঙ্গীকার পূরণের চেষ্টা, স্বাভাবিক আলস্য ও অস্বাভাবিক আড্ডাপ্রিয়তা। সামাজিক কর্তব্যবোধ আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেজন্য সময় দেওয়াটা আমি কখনোই সময়ের অপচয় মনে করতে পারিনি। নিজের আলস্য অবশ্য ক্ষমার অযোগ্য।’
আনিসুজ্জামানের ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও ক্লাসের বাইরে অসংখ্য কাজ এবং ছোট-বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ততা, দেশে-বিদেশে আলোচনা ও বক্তৃতা, বড় কোনো সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় বিষয়ে উদ্যোগ ছিল তার নিয়মিত কাজের অংশ। আনিসুজ্জামানের গুরু (আব্দুর রাজ্জাক) তা ভালোভাবে নিতেন না। প্রসঙ্গত তিনি আবার লিখেন, ‘আমি যখন বিশেষত বিদেশে গিয়ে সেমিনার সম্মেলনে প্রবন্ধ পড়তে থাকি, তখন তিনি খুব বিরক্ত হন। বলেন, এসব তো তাদের কৌতূহলের বিষয়— আমি নিজের কাজ বাদ দিয়ে ওদের কাজে সময় নষ্ট করছি কেন?’
‘সার্ কিন্তু আমাকে শিক্ষক বলেই জানতেন। অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান যখন রাষ্ট্রপতির শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা, তখন তিনি একবার আমাকে বাংলা একাডেমি বা শিল্পকলা একাডেমি, যেকোনো একটির মহাপরিচালকের দায়িত্ব নিতে বলছিলেন। তাকে বলছিলাম যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে কোথাও যেতে চাই না। তাতে তিনি খুব বিরক্ত হয়েছিলেন।’ (সার্/ আনিসুজ্জামান/ আব্দুর রাজ্জাক স্মারকগ্রন্থ ২০১২)
এই হলো আনিসুজ্জামান। কাজে বিশ্বাসে অনড়। নিরাবেগে কেটে গেছে যুগান্তর। তবে গুরুদের থেকে যেমন নিয়েছেন দীক্ষা, তেমনি পারিবারিক আবহে পেয়েছেন মননশীলতা। কলতাকার কালচারালগৃহে জন্ম। পৈতৃক নিবাস পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার মোহাম্মদপুর গ্রামে। পিতামহ সুধাকর, মিহির, হাফেজ, মিহির ও সুধাকর, মোসলেম হিতৈষী প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদক এবং হজরত মুহাম্মদের জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতি প্রভৃতি গ্রন্থের লেখক শেখ আবদুর রহিম (যারা বাংলা ভাষায় যারা নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী লিখেছেন, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম)। পিতা খ্যাতনামা হোমিওপ্যাথ আবু তাহের মোহাম্মদ (এটিএম) মোয়াজ্জম। মাতামহ সৈয়দ আশরাফ আলী। মা হাতেম তাই গ্রন্থের রচয়িতা সৈয়দা খাতুন।
খ.
কৈশোরে যার স্বপ্ন ছিল আইনজীবী হওয়ার, তিনি শেষ অব্দি হয়ে উঠলেন সাংস্কৃতিক দিকপাল, সাহিত্যের অধ্যাপক, নিরেট গবেষক। হয়তো নিয়তীর লিখন। জীবনের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপ্রাথী হলে স্বাগত জানান তৎকালীন ভাষা পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রথম ইমেরিটাস অধ্যাপক গ্রহণ করেন তার উত্তরাধিকারকে। যিনি পরে বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় ইমেরিটাস পদ অলংকৃত করেন। দিন যত গিয়েছে, তত নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন মন-মননে। নানান কাজে সম্পৃক্ত থেকে সামাজিক দায় পালন করেছেন। হয়ে উঠেছেন সর্বজনশ্রদ্ধেয়।
করোনা ইস্যুতে ২০২০ সালে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের অটোপাস দিয়েছে সরকার। প্রকাশ থাকে যে শিক্ষাবিদ বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের পরামর্শ ছাড়াই কাণ্ড ঘটেছে। যার ফলাফল ক্ষতিটা হবে দীর্ঘস্থায়ী। আনিসুজ্জামান স্যারের দুঃখ প্রসঙ্গে আসা যাক। রাষ্ট্র কাঠামোর শুরুতে ১৯৭২ সালে গণহারে পাস করানোর ঘটনায় তিনি ভীষণভাবে দুঃখ পেয়েছিলেন, ব্যথিত হয়েছিলেন। আত্মজৈবনীক রচনা ‘বিপুলা পৃথিবী’তে লিখেছেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার আগেই বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ইউসুফ আলী যে-নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিলেন, সে-কথাটা এখানে বলে নিই। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে শিক্ষাবিষয়ে আমি যে কয়েকটি কাগজ তৈরি করেছিলাম, তার একটিতে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যে যে-ক্লাসে পড়ত, ১৯৭২ সালের ১ মার্চে তাকে আবার সেখান থেকে পড়াশোনা শুরু করতে হবে; এই একটি বছর জাতীয় ক্ষতি হিসেবে পরিগণিত হবে; এবং সরকারী চাকরিতে প্রবেশের বয়ঃসীমা এক বছর বাড়িয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু মন্ত্রীসভায় এ প্রস্তাব বিবেচিত হওয়ার আগেই জাতীয় পরিষদ-সদস্য ইউসুফ আলী এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গণউন্নতি দেওয়া হলো, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যে যেখানে পড়ত, ১৯৭২ সালে তার পরবর্তী শ্রেণিতে সে উন্নীত হবে। এই ঘোষণার বিষয়ে তিনি যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করেননি, সে-কথা আমি তাজউদ্দীনের কাছ থেকে জেনেছিলাম। বলা বাহুল্য, ঘোষণাটি ছাত্রদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল এবং তা প্রত্যাহার করার মতো সাহস সরকারের হয়নি। এতে যে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে কী সর্বনাশ হলো, অনেকে তা ভেবে দেখেননি।’
অটোপাসের ফল অচিরেই ভোগ করতে শুরু করে। ‘১৯৭২ সালের মার্চ মাসেই ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে দাবি উঠলো সিলেবাস কমানোর। উঠবে নাই বা কেন? আগের ক্লাসের পড়া যে শেখেনি, পরীক্ষাগারে নির্ধারিত পরীক্ষা করেনি, পরের ক্লাসের পড়া কিংবা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক পরীক্ষা তার কাছে তো দুরূহ মনে হবেই। এর প্রতিকার না-পড়া বিষয় জেনে নেওয়া নয়—সেই সময় ও সুযোগ কারো নেই—প্রতিকার আরো না-শেখা। অতএব, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করার আন্দোলন শুরু হলো। প্রথম-প্রথম কেউ গা করেননি এতে, কিন্তু দেখা গেল ছাত্রেরা না-শেখার পণ করেছে।’
১৯৭২ সালের গণপাস পরবর্তী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ শিক্ষার্থীদের অন্যায্য দাবি এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির বাস্তবতাকে মেনে নিতে না পেরে মনের জাতীয় দুঃখে আানিসুজ্জামান চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। ন্যূনতম দায়বোধে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। বর্তমান রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক সংকট বিশেষত শিক্ষা সংস্কৃতির অরাজকতায় বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ কী করছে? কোথায় হারাচ্ছি আমরা। বেদনাজল গড়িয়ে কোথায় পড়ে!
এমন শত বেদনায় শিল্প সমাজ থাকে, কে রাখে তার খোঁজ। আজ ঈদের দিন। আনিসুজ্জামান মারা যাওয়ার দিন। ২০২০ সালের এই দিনে তিনি চলে যান। কাকতালীয় বিষয়— তার বন্ধু বাংলা সাহিত্যের আরেক দিকপাল দেবেশ রায়ও একই দিনে মারা গেছেন। তিস্তা পারের বৃত্তান্ত উপন্যাসের জনক (ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত)। বৃত্ত ভেঙে দুই বন্ধু একই দিনে আমাদের ছেড়ে যান।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ঈদ নিয়ে ‘আমার একাত্তর’ গ্রন্থে লিখেন, ‘ঈদের কদিন আগে তাজউদ্দীন আমাকে ডেকে পাঠালেন। স্বভাবতই বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হলো। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বিদেশ-সফরের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি কিছুটা ধারণা দিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, বঙ্গবন্ধুর বিচারের ফল যাই হোক, বিশ্বজনমতের কারণেই, পাকিস্তানিরা তাঁকে হত্যা করতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধ যে চূড়ান্ত লক্ষের দিকে অগ্রসর হচ্ছে সে-বিষয়ে তাঁর সন্দেহ ছিল না।
কথাবার্তার শেষে উঠে গিয়ে ঘরের মধ্যে রাখা আয়রন শেলফ থেকে একটা খাম বের করে তিনি আমার হাতে দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম: “কী এটা?” তিনি বললেন, “সামনে ঈদ, তাই।” খামে পাঁচশ টাকা ছিল— তখন আমার এক মাসের মাইনের সমান। আমি নিতে চাইলাম না। তিনি বললেন, “ঈদে আপনার বাচ্চাদের তো আমি উপহার দিতে পারি, নাকি।” কথাটা বলতে গিয়ে তিনি নিজেই ভাবাবেগপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন, আমিও খুব অভিভূত হয়ে কিছু আর বলতে পারিনি।’
Comments