কামাল আতাতুর্কের জন্মস্থান থেসালুনিকিতে
‘মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক’ এ নামটির সঙ্গে আমরা প্রায় সবাই কম-বেশি পরিচিত। ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের স্থপতি হিসেবে তিনি বিশেষভাবে সমাদৃত হন। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ওসমানী সাম্রাজ্য তখন অনেকটা দুর্বল ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। বলকান যুদ্ধে অটোমান সেনাদের পরাজয়ের ফলে একে একে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ওসমানী সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্রভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের পথে পা বাড়ায়।
অন্যদিকে স্যাভরোর চুক্তির ফলে সিরিয়া, লেবানন ও ইরাকসহ অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা দেশগুলোর ওপর একচ্ছত্রভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য। বসফরাস প্রণালী এবং ইস্তাম্বুলের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ রাশিয়ার। কৃষ্ণসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যকার সংযোগস্থল হিসেবে পরিচিত বসফরাস প্রণালীর প্রতি রাশিয়ার আগ্রহ ছিল প্রবল। ককেশাস অঞ্চলে আর্মেনিয়া নামক নতুন এক রাষ্ট্রের উত্থান তুর্কিরা ভালোভাবে নেয়নি। এদিকে ইতালি ও গ্রিসসহ ইউরোপীয় শক্তিগুলো তুরস্কের মূল ভূ-খণ্ডের বিভিন্ন অংশকে নিজের করায়ত্ব করতে তখন ভীষণভাবে উৎসুক।
ঠিক এমন সময় তুর্কি জাতির জন্য ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন মোস্তফা কামাল। মোস্তফা কামাল তার নেতৃত্ব এবং রণকৌশলের মাধ্যমে বিদেশি শক্তিগুলোকে পরাজিত করেন এবং তাদেরকে তুরস্কের মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিতাড়িত করেন। আজকে বিশ্ব মানচিত্রে আমরা তুরস্ক নামক যে দেশটিকে দেখতে পাই, সেটি কস্মিনকালেও তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারতো না যদি না মোস্তফা কামাল তুর্কি জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত না হতেন।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে মোস্তফা কামাল তুরস্কের নায়ক হলেও জন্মসূত্রে তিনি গ্রিক। ১৮৮১ সালে গ্রিসের থেসালুনিকি শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। থেসালুনিকির যে বাসভবনে মোস্তফা কামালের জন্ম হয়েছিল সেটি বর্তমানে তুরস্কের কনস্যুলেট ভবন এবং একই সাথে যাদুঘর। চেষ্টা করেছিলাম সে যাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এবং এ মুহূর্তে যেহেতু গ্রিসের সাথে তুরস্কের উত্তেজনা চলছে তাই আমাদের সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। পুরো ভবনের সামনে সবসময় স্পেশাল পুলিশ ফোর্স পাহারায় নিয়োজিত থাকে।
এথেন্সের পর থেসালুনিকি হচ্ছে গ্রিসের বৃহত্তম নগরী এবং একই সাথে দেশটির অন্যতম প্রসিদ্ধ বন্দরনগরী। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের ইতিহাসে থেসালুনিকি একটি বিরোধপূর্ণ শহর হিসেবে পরিগণিত। যদিও ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত লুজান চুক্তির ফলে থেসালুনিকিসহ সমগ্র পশ্চিম থ্রেসের ওপর গ্রিসের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিন্তু আদৌতে এ শহরটি আজও গ্রিস, তুরস্ক, মেসিডোনিয়া ও বুলগেরিয়ার বিবাদের কারণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
থেসালুনিকি এক সময় ইউরোপের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। গ্রিক, তুর্কি এবং বুলগেরিয়ান- তিনটি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের পদচারণায় মুখর থাকত এ শহর। পাশপাশি আর্মেনিয়ান বংশোদ্ভূত অনেক মানুষও এখানে বসতি স্থাপন করেছিল। শহরটির অধিবাসীরা অর্থোডক্স খ্রিস্টান, ইসলাম ও ইহুদি এ তিন ভিন্ন ধর্মে বিভক্ত ছিল। এক সাথে এতোগুলো ভিন্ন জাতি ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের সহাবস্থান সে সময় ইউরোপে খুব কম শহরে দেখা যেত। ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত লুজান চুক্তির ফলে থেসালুনিকিতে অবস্থান করা মুসলিমদের এ শহর ত্যাগে বাধ্য করা হয়। ধীরে ধীরে ইহুদিরাও এ শহর ছেড়ে চলে যায়। এমনকি এ শহরে স্লাভিক জাতিগোষ্ঠীর যে সব মানুষ বসবাস করতেন তারাও পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বুলগেরিয়া কিংবা মেসিডোনিয়াতে চলে যান।
বর্তমান সময়ে থেসালুনিকির দিকে তাকালে কেবলমাত্র এক রুগ্ন প্রতিমূর্তির ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বলকান অঞ্চলের অন্যান্য শহরের মতো থেসালুনিকিও অবকাঠামোগত দিক থেকে বেশ পিছিয়ে। অনেক সময় তাই বিশ্বাসই করা যায় না আদৌতে থেসালুনিকি কি ইউরোপ মহাদেশের কোনও শহর? না কি এর অবস্থান তৃতীয় বিশ্বের কোনও দেশে। রাস্তা-ঘাট তেমন একটা প্রশস্ত নয়। শহরের বেশিরভাগ দালানকোঠা বেশ পুরোনো। পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে স্থানীয় জনসাধারণেরও তেমন একটা সচেতনতা দেখা যায় না, এমনকি আইন মেনে চলার ব্যাপারেও যে তারা যথেষ্ট সচেষ্ট সেটি বলার সুযোগ নেই। ঢাকা শহরের মতো থেসালুনিকিতেও মানুষজনকে ফুটপাতের ওপর মোটর সাইকেল চালাতে দেখা যায়। হরহামেশা যেখানে সেখানে স্থানীয় অধিবাসীরা গাড়ি পার্ক করে রাখেন ফলে যানজট শহরটির অন্যতম প্রধান সমস্যা।
অবশ্য একটি কারণে আমি থেসালুনিকিকে এগিয়ে রাখি সব সময়। গ্রিক খাবারের জনপ্রিয়তা গোটা দুনিয়াব্যাপী আর কেউ যদি সত্যিকার অর্থে গ্রিক খাবারের স্বাদ নিতে চান তাহলে তাকে থেসালুনিকিতে আসতে হবে। বাংলাদেশে যেমনিভাবে খাবারের জন্য পুরান ঢাকার আলাদা সুনাম রয়েছে, ঠিক তেমনি গ্রিসসহ গোটা ইউরোপে থেসালুনিকির রন্ধনশৈলীর আলাদা কদর রয়েছে। ইয়োগার্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের চিজ বা পনির, বুরেক, অলিভ ওয়েল, সালাদ, বিভিন্ন ধরনের সসেজ এবং বাকলাভাসহ বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবারের জন্য গ্রিস বিখ্যাত। সামুদ্রিক মাছ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবারের জন্যও গ্রিসের খ্যাতি পুরো দুনিয়া জুড়ে। গ্রিসের জনপ্রিয় দুইটি খাবারের আইটেমের মধ্যে রয়েছে গিরোস এবং সুভলাকি। গাইরো এবং সুভলাকির সাথে আমাদের দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ফাস্টফুড আইটেম শর্মার কিছুটা মিল পাওয়া যায়। তবে আমাদের পরিচিত রুটির পরিবর্তে পিটা নাম এক বিশেষ ধরণের ব্রেড এবং ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও বিভিন্ন ধরণের সালাদ এবং এক ধরণের বিশেষ সস সহযোগে তৈরি হয় সুভলাকি। সুভলাকি এবং গাইরোর মাঝে একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে সুভলাকিতে কাবারের ন্যায় মাংসকে আগের থেকে ঝলসিয়ে নিতে হয়, অন্যদিকে অনেকটা শর্মার আদলে গাইরোতে ব্যবহৃত মাংসকে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। থেসালুনিকির সিটি সেন্টারের কাছে অবস্থিত একটি ফাস্টফুড শপ থেকে আমি সুভলাকি নিয়েছিলাম এবং আমি বলতে পারি এখন পর্যন্ত আমার খাওয়া সেরা ফাস্টফুড আইটেমের মধ্যে এ সুভলাকি অন্যতম। ফাস্টফুড শপে কাজ করা এক কিশোরী আমাকে বলছিলেন থেসালুনিকির সুভলাকি না কি একেবারে আলাদা এবং স্বাদের দিক থেকে সেরা। বাহিরের দেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক কেবলমাত্র এ সুভলাকির জন্য থেসালুনিকিতে বেড়াতে আসেন। যেহেতু সুদীর্ঘকাল গ্রিস অটোমান শাসনের অধীনে ছিল তাই গ্রিসের সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে দৈনন্দিন সংস্কৃতিতে অটোমানদের প্রভাব লক্ষণীয় যদিও রাজনৈতিক অঙ্গনে গ্রিস এবং তুরস্কের মাঝে সম্পর্ক সাপে নেউলের মতো।
থেসালুনিকির সিটি সেন্টারের মূল চত্বর ভূমিটি “অ্যারিস্টোটেলাস স্কয়ার” নামে পরিচিত। থেসালুনিকির অন্যান্য অংশের তুলনায় এ অংশটি অপেক্ষাকৃতভাবে নতুন। পুরো শহরের মধ্যে বলতে গেলে কেবল এ অংশেই চাকচিক্যময় দালানের দেখা মেলে। ১৯১৮ সালে বিখ্যাত ফরাসি স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ আর্নেস্ট হাবরার্ড এ স্কয়ারটির নকশা প্রণয়ন করেন। যদিও তার প্রণীত নকশা অনুযায়ী পুরো অ্যারিস্টোটেলাস স্কয়ারকে আজকের রূপ দিতে পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত সময় লেগে যায়। ১৯১৭ সালের দিকে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ফলে এ শহরটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ৩২ ঘণ্টা সময়ব্যাপী স্থায়ী হওয়া এ অগ্নিকাণ্ডের ফলে সাড়ে নয় হাজারের মতো ঘরবাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত। থেসালুনিকির বসবাসরত ইহুদিদের একটা বড় অংশের স্থানচ্যুতির কারণ হিসেবে এ ঘটনাকে দায়ী করা হয়। ১৯১৭ সালের এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সে সময়কার গ্রিস সরকার থেসালুনিকিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ডাক পড়ে আর্নেস্ট হাবরার্ডের। ২০০০ সালের পর আরও একবার অ্যারিস্টোটেলাস স্কয়ারকে সংস্কার করা হয়। আগে বলেছি যে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় গ্রিস এবং বলকান অঞ্চলে যে সব দেশ রয়েছে সেগুলো অবকাঠামোগত দিক থেকে অনেকটা রুগ্ন প্রকৃতির। থেসালুনিকিও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই পুরো শহরটি একবার ঘুরে আসার পর যখন কেউ এ অ্যারিস্টোটেলাস স্কয়ারে এসে দাঁড়াবে তখন তার কাছে হয়তোবা মনে হবে আশেপাশের সমগ্র শহরতলী থেকে এ অংশটি ফুলেফেঁপে এ রকম জৌলুসতা অর্জন করেছে। অ্যারিস্টোটেলাস স্কয়ার থেকে উত্তর-পশ্চিম বরাবর এজিয়ান সাগরের তীর ঘেঁষে কয়েকশো মিটার হাঁটার পর চোখে পড়বে হোয়াইট টাওয়ার।
পর্যটকদের জন্য থেসালুনিকির মূল আকর্ষণ হচ্ছে হোয়াইট টাওয়ার অব থেসালুনিকি। এ হোয়াইট টাওয়ারটি থেসালুনিকির ল্যান্ডমার্ক হিসেবে পরিচিত। বাইজেনটাইন শাসন আমলে এ টাওয়ারের স্থানটিতে একটি দুর্গ নির্মাণ করা হয়। মূলত সে সময় স্থানীয়ভাবে প্রতিরক্ষার কাজে এ দুর্গটি ব্যবহার করা হতো। ১৪৩০ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের নেতৃত্বে অটোমানরা থেসালুনিকি জয় করেন। অটোমান শাসন আমলে এ দুর্গটিকে কিছুটা সংস্কার করে লাল রঙের একটি টাওয়ারের আকৃতি দেওয়া হয়। অটোমান শাসন আমলে মূলত কারাগার হিসেবে এ টাওয়ারটিকে ব্যবহার করা হতো। সে সময় মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাওয়া অনেক আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো এ টাওয়ারে। ১৯১২ সালে প্রথম বলকান যুদ্ধের পর এ টাওয়ারটির লাল থেকে পরিবর্তন করে সাদা করা হয়। তখন থেকেই এ টাওয়ারটি হোয়াইট টাওয়ার নামে পরিচিত। বর্তমানে এ হোয়াইট টাওয়ারটি একটি মিউজিয়াম এবং একই সাথে আর্ট গ্যালারি। সাধারণত এ টাওয়ারের ভেতরে প্রবেশ করতে ছয় ইউরো প্রয়োজন হয়। হোয়াইট টাওয়ার থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিক বরাবর কয়েক গজ হাঁটলে চোখে পড়বে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য। ইতিহাসের পাতায় তার চেয়ে মহাপরাক্রমশালী রাজা হিসেবে অন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। গ্রিস থেকে শুরু করে উত্তর-পশ্চিম ভারত এমনকি উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত এক সুবিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। থেসালুনিকির আরও একটি পর্যটন নিদর্শন হচ্ছে রটোন্ডা। রটোন্ডা হচ্ছে এক ধরনের বেলনাকৃতি স্থাপনা যেটি আনুমানিক ৩০৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। এটি মূলত একটি রোমান স্থাপনা। প্রথমে সমাধি হিসেবে এ স্থাপনাটির নির্মাণ করা হলেও পরবর্তীতে ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবে এ স্থাপনাটি ব্যবহার করা হতো। পরবর্তীতে বাইজেন্টাইন সম্রাট প্রথম কন্সটান্টিন একে অর্থোডক্স চার্চে রূপান্তর করে। রটোন্ডা থেকে সিটি সেন্টার বরাবর দেড়-দু মিনিট হাঁটার পর ডান দিকে লক্ষ্য করলে চোখের সামনে একটি তোরণ ভেসে উঠবে। এ তোরণটি “আর্ক অব গ্যালারিয়াস” নামে পরিচিতি। মূলত চতুর্থ শতাব্দীতে যখন থেসালুনিকি রোমানদের অধীনে আসে তখন তারা তাদের এ বিজয়কে স্মরণ করতে এ তোরণটি নির্মাণ করে। যেহেতু থেসালুনিকি এক সময় রোমান শাসনের অধীনে ছিল তাই শহরটির বিভিন্ন স্থানে রোমান শাসনামলের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। থেসালুনিকির অন্যান্য আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে জিউস মিউজিয়াম এবং বাইজেন্টাইন মিউজিয়ামসহ বেশ কিছু যাদুঘর ও অর্থোডক্স গির্জা।
পুরো থেসালুনিকি ভ্রমণে আমাকে সঙ্গ দিয়েছিলেন মনিউর রহমান সুমন ভাই। প্রায় তেরো বছর ধরে তিনি এ শহরে বসবাস করছেন। সুমন ভাইয়ের পৈতৃক নিবাস সিলেটের সুনামগঞ্জে। থেসালুনিকিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা কেমন আছেন এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান যে রাজধানী এথেন্সের তুলনায় থেসালুনিকিতে জীবন-যাত্রা অনেকটা সহজ। এছাড়াও এথেন্সে প্রায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকে পাকিস্তানি কিংবা আফগানি অথবা আরবদের দ্বারা হামলার শিকার হন। থেসালুনিকিতে এ সমস্যা খুব বেশি একটা প্রকট নয়। বর্তমানে তাই এথেন্সের পাশপাশি অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাসের জন্য থেসালুনিকিকে বেছে নিচ্ছেন। থেসালুনিকিতে বর্তমানে বাংলাদেশি মালিকানাধীন বেশ কিছু দোকান রয়েছে, এমনকি বাংলাদেশিদের পরিচালিত একটি মসজিদও রয়েছে। আমরা দুপুরে সে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করলাম। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মাঝে গ্রিস এবং স্লোভাকিয়া দুইটি দেশ যেখানে অফিসিয়াল কোনও মসজিদ নেই। কয়েকজন মুসল্লি একত্রিত হয়ে কোনও একটা বিল্ডিং এর নিচের অংশ ভাড়া নিয়ে মসজিদের কার্যক্রম পরিচালনা করে।
গ্রিস যেহেতু একই সাথে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং সেনজেনের সদস্য, তাই সেনজেনভুক্ত যে কোনো রাষ্ট্রের ভিসা কিংবা রেসিডেন্ট পারমিট থাকলে গ্রিস ভ্রমণ করা যায়। গ্রিসের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী এবং অন্যতম প্রধান বন্দর নগরী হিসেবে পরিচিত থেসালুনিকির সাথে ইউরোপের বেশিরভাগ প্রসিদ্ধ শহরের ফ্লাইট সংযোগ রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ বুলগেরিয়া, তুরস্ক মেসিডোনিয়া কিংবা আলবেনিয়া থেকে সড়কপথেও থেসালুনিকি ভ্রমণ করা যায়। বাজেট অনুযায়ী থাকার জায়গা নির্ধারণের জন্য রয়েছে বুকিং ডট কম কিংবা এয়ারবিএনবির মতো অ্যাপভিত্তিক বিভিন্ন পরিষেবা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত অন্যান্য দেশের চেয়ে গ্রিসে জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলকভাবে এখনও কম।
আসলে পৃথিবীতে কিছু কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে মানুষ যান অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে, থেসালুনিকি হচ্ছে তেমন একটি জায়গা। আমরা যারা সাধারণ মানুষ রয়েছি, থেসালুনিকি আমাদের চোখে হয়তো বা বিশেষায়িত রূপে সেভাবে ধরা দেবে না, যদি না আমরা ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত দিক থেকে এ শহরকে পর্যালোচনা করার চেষ্টা না করি।
ফিরে আসি মোস্তফা কামালের কথায়। তার যদি জন্ম না হতো তাহলে আজকের পৃথিবীতে আমরা যে তুরস্ককে দেখি সে তুরস্ক কোনো দিনও গঠিত হতো না। তুরস্কের বিভিন্ন অংশ জুড়ে তখন ইতালি, গ্রিস ও রাশিয়াসহ বাইরের দেশগুলোর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতো। উসমানী শাসনামলে তার উপাধি ছিলো পাশা। সে সময় কাউকে পাশা উপাধি লাভ করতে হলে তাঁকে তিনি কুরআন ও হাদীসসহ ফিকহ শাস্ত্রে বিশেষভাবে পারদর্শী হতে হতো। মোস্তফা কামাল সব সময় বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্রকে হতে হবে ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত। তাই তিনি তুরস্ককে সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলেন যা ছিল তার শাসনামলের অন্যতম সাফল্য। সত্যি কথা বলতে, মোস্তফা কামাল ছাড়া আধুনিক তুরস্ককে কল্পনা করা কোনোভাবে সম্ভব নয় এবং এজন্য তুর্কি জাতি সব সময় তার কাছে ঋণী থাকবে।
রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।
Comments