এসেছে ঈদ আসেনি আনন্দ

ঈদ তো আগামীকালই, তাই না?

ঈদ তো আগামীকালই, তাই না?

গত ঈদুল ফিতরের পর পুরো একটা বছর পেরিয়ে গেছে। তবুও মনে হচ্ছে, সময় যেন থমকে আছে। করোনাভাইরাসের নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট, ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ ও মৃত্যু, ব্যাংক আমানত কমে যাওয়া, চাকরি হারানো, ঘরে থেকে অফিস করার সমস্যা, লকডাউন, টিকা সংকট, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে হতাশা এবং গরিব মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনীহার অভিযোগ— সব মিলিয়ে কঠিন এক চাপের মধ্য দিয়ে কোনো মতে পার হয়েছে এই সময়টা।

গত বছরের মতো এবারের ঈদও কাটবে লকডাউনে। ঈদগাহ ময়দানে ঈদের নামাজ হবে না। কিছু মানুষ হয়তো মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে যাবেন। তবে, ঐতিহ্য অনুযায়ী নামাজের পর কোলাকুলি বা হাত মেলানো হবে না তাদের।

একসঙ্গে হয়েও যেনো কেউ একসঙ্গে নেই। কারো বাড়িতে অতিথি আসবে না, কেউ অতিথি হয়ে অন্যের বাড়িতে যাবেনও না। যার যার বাড়িতে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে উৎসব।

ছাদে গিয়ে আকাশের দূর এক কোণে চাঁদের খোঁজ করবে না শিশুরা। হৈ-হুল্লোড়, আতশবাজি, বাঁশির আওয়াজ, ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি— কিছুই থাকবে না।

বাইরে সবকিছু শান্ত থাকবে। চারপাশ থাকবে নিস্তব্ধ। আর ভেতরে, করোনাভাইরাসের কারণে ১৪ মাস ধরে বিধিনিষেধের মধ্যে থাকা মানুষের জন্যে শুধুই আরেকটি সাধারণ দিন হবে এটি। এই ভাইরাস এরইমধ্যে দেশে ১২ হাজারের বেশি এবং সারা বিশ্বে ৩৩ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

আমাদের জীবন, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ওপর ঈদের প্রভাব এতোটাই বেশি যে, আমাদের সবকিছু এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই ঘুরতে থাকে। দুই ঈদ আর পহেলা বৈশাখই সারা বছর ধরে দেশীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চলার রসদ যোগায়। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবার পহেলা বৈশাখ ও ঈদ কোনোটিই সেভাবে উদযাপিত না হওয়ায় এসব ব্যবসার অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়েছে। গত বছরও দুটি উৎসবের সময় একই অবস্থা ছিল।

ব্যবসার অবস্থা ভালো না। আমাদের অবস্থাও তা-ই। ঈদ চলে এলেও বিশাল এক শূন্যতা আমাদের গ্রাস করে রেখেছে। আনন্দ জিনিসটা কোথায় হারিয়ে গেল?

আমরা কি এবার হাসিমুখগুলো দেখেছি? প্রতি বছর ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা, যে কোনো যানবাহনে নিজের জন্য একটু জায়গা খুঁজে নেওয়া, নরকের কথা মনে করিয়ে দেয় এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার সাহস নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটে চলা সেই মুখগুলো?

৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটে বসেও এসব মুখে হাসি থাকে। ঢাকা থেকে বের হতে ১০ কিলোমিটার হাঁটতে হলেও হাসি থাকে। ফেরিঘাটে ১৮ ঘণ্টার অপেক্ষা, বাসের টিকিট না পেয়ে ট্রাকে করে যাত্রা- কিছুই তাদের হাসি কাড়তে পারে না। উৎসব ভাতা হিসেবে যে যতটুকু টাকা পায়, তা দিয়ে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটার সময়ও তারা হাসিমুখে থাকে। এমনকি প্রতারকের খপ্পরে পড়লেও মুখ থেকে হাসি সরে না তাদের।

নিজের জন্মস্থান, নিজের বাড়িতে যাওয়ার আগে পুরো সময়টাই এই মানুষগুলোর মুখে হাসি লেগে থাকে। বাড়িতে যাওয়ার পর সেখানকার প্রতিটি মানুষ থেকে শুরু করে ছোট-ছোট চায়ের দোকান, গাছের ছায়ায় ঢাকা রাস্তা, রিকশা, মিষ্টির দোকান, ধান খেতের ওপর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে উড়তে থাকা পাখি, পুকুর বা শৈশবের কোনো বৃদ্ধ নরসুন্দর- সবকিছুই তাদের মুখে হাসি ধরে রাখে। এই হাসিমুখ ঈদ শেষে কর্মস্থল, শহরে ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ম্লান হয় না।

এবার এই হাসিগুলো কোথায় হারিয়ে গেলো?

ঈদে বাড়ি ফেরার ডাক তো তাদের রক্তেই আছে। স্বাভাবিক সময়ের মতো এই আহ্বান অতোটা তীব্র না হলেও, এবারও চির চেনা সেই ঈদ যাত্রা থেমে নেই। তবে করোনার কারণে চলমান বিধিনিষেধে আন্ত:জেলা বাস সেবা বন্ধ থাকায়, এবারের ঈদ যাত্রা হয়ে উঠেছে আরও বেশি কষ্টসাধ্য।

এবার তাদের আরও বেশি হাঁটতে হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ফেরি বন্ধ রাখায় আরও বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তাদেরকে বাড়িতে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। এবারের যাত্রা সেই পরিচিত ঈদ যাত্রার মতো ছিল না। কারো মুখেই ছিল না হাসি।

বরং সবার মুখে দেখা গেছে কালো মেঘের ছায়া। ভবিষ্যতে কী আছে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সবাই।

ঢাকাবাসী প্রতি বছর আগ্রহ নিয়ে ‘চাঁদ রাতের’ জন্য অপেক্ষা করে। সবাই নাড়ির টানে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর ফাঁকা শহরে তারা শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা এবং রাতভর আড্ডা দিতে বের হয়। চাঁদ রাত এবারও আসবে। এবারও হয়তো কিছু মানুষ বাড়ির বাইরে বের হবে। কিন্তু তাদের মুখে হাসি থাকবে না, থাকবে দুশ্চিন্তার ছাপ। ঠিক গত বছরের মতোই।

এ বছর বেশিরভাগ মানুষ ঈদের কেনাকাটা করতেও আগ্রহী হননি।

এবারের ঈদের আগমনী বার্তা এমন অদ্ভুত আর অচেনাই। অথচ এই ঈদ শত শত বছর ধরে ধনী-গরিব সব মুসলমানের জন্য অতুলনীয় আনন্দ বয়ে নিয়ে এসেছে। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ঈদে পরিণত হয়েছে এবারের ঈদ। ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস কণা আমাদের মন থেকে সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে।

আমাদের হাসিমুখ আর নেই। আর কতদিন এই পরিস্থিতি চলবে— সেই অনিশ্চয়তাটুকুই শুধু আছে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English
economic challenges for interim government

The steep economic challenges that the interim government faces

It is crucial for the interim government to focus on setting a strong foundation for future changes.

8h ago