পদ্মা-গড়াই বিধৌত খুলনার ৫ জেলায় খাবার পানির সংকট
খাবার পানির সংকট চলছে খুলনা বিভাগ জুড়েই। উপকূলের জেলাগুলোতে এ সংকট দীর্ঘদিন ধরে চললেও এবার সংকট দেখা দিয়েছে পদ্মা-গড়াই বিধৌত মিঠা পানির জেলাগুলোতেও। মার্চের শুরু থেকে দেখা দেয়া এই সংকট কুষ্টিয়াসহ আশেপাশের ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, চুয়াডাঙা ও মাগুরায় দিন দিন বাড়ছে।
খুলনা বিভাগীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বলছে প্রয়োজনীয় বৃষ্টি না হওয়াই এর প্রধান কারণ। তারা বলছেন, এই দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ৮ মাস ধরে বৃষ্টির স্বাভাবিক মৌসুমেও বৃষ্টির দেখা নেই। ফলে পুরো অঞ্চল জুড়েই পানির স্তর এলাকা ভেদে ২শ থেকে ৪শ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে। ইতোমধ্যে শুষ্ক মৌসুমের গড় স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৭৮ ভাগ খাবার পানির জলাশয়গুলো শুকিয়ে গেছে। নলকূপগুলোও অকেজো হয়ে গেছে।
অন্যদিকে নদী-বিধৌত জেলাগুলোর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বলছে, এসব জেলায় পানির স্তর ২৫০ ফুটের স্তর থেকে আরও প্রায় ৩২ ফুট নিচে নেমে গেছে। এর ফলে এসব সাধারণ নলকূপের পানি উৎপাদন ৬০ ভাগ কমে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও পানি বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বিভাগের নদীগুলোতেও মৌসুমের এই সময়টাতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ অনেক কমে গেছে। একই সঙ্গে নিয়ম না মেনে একটির কাছাকাছি একাধিক সাব-মার্সিবল পাম্প বসানোয় পানির স্তর নিচে নেমে এ সংকট তৈরি হওয়ার আরেকটি কারণ বলে মনে করেন তারা।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগের নিবার্হী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম জানান, কুষ্টিয়াসহ আশেপাশের ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, চুয়াডাঙা, মাগুরা অঞ্চলজুড়ে পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে ধরে রাখতে সাহায্য করে পদ্মা ও গড়াইয়ের প্রবাহ। এই প্রবাহ থেকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষ’র (জিকে) ১৬৫৫ কিলোমিটার খালের মধ্য দিয়ে এই জেলাগুলোর ভেতরে প্রবাহিত হয়ে থাকে। এই প্রকল্পের ঘণ্টায় প্রায় ১৫৩ কিউসেক পানি সরবরাহের ক্ষমতা আছে। যা এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পানি স্তরের ৬৮ শতাংশ পূরণ করে। সেজন্যই এসব জেলায় পানি সংকট কখনোই সেভাবে দেখা দেয়নি। কিন্তু এবার পদ্মা-গড়াইয়ে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক নেই। এই কর্মকর্তা জানান পদ্মার উজানে গঙ্গা থেকে পানির প্রবাহ যথেষ্ট জোড়ালো না হওয়ায় পদ্মায় পানি সংকটের বিরূপ প্রভাব পড়েছে পদ্মার শাখা গড়াইয়ের ওপর।
হাইড্রোলজি বিভাগের তথ্যানুযায়ী ১ মার্চ শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকেই গঙ্গার পানি ভাগাভাগিতে সমস্যা সৃষ্টি হয়। ঐতিহাসিক গঙ্গা পানি চুক্তির অনুযায়ী পদ্মা নদীতে সর্বনিম্ন ৩৫০০০ হাজার কিউসেক পানির আধার থাকার পরিবর্তে কখনো কখনো তা ২৩০০০ হাজার কিউসেকে নেমে আসে। এর ফলে কয়েক দফা বন্ধ হয়ে যায় জিকের পানি সরবরাহ যা দীর্ঘ হয় প্রায় ২০ দিন। আবার বোরো মৌসুমের পানি সরবরাহ শেষ হওয়ার কারণে গত ১ মে থেকে জিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ রেখেছে পানি উত্তোলন। যা চালু হবে ১৬ মে।
খুলনা বিভাগীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জামালুর রহমান বলেন, বিভাগের ১০ জেলায় গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হতে না হতেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির স্তর আরও কমছে। এই কর্মকর্তা জানান গত ৫ বছরে খুলনাঞ্চল জুড়ে ৩ ফিটের বেশি পানির লেয়ার নিচে নেমে গেছে।
মাগুরা জেলা জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা আসলাম আল হাসান জানান, স্বাভাবিক সময়ে পানির স্তর মাটির ১৬ ফুট নিচে থাকে। কিন্তু উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় পানির স্তর বর্তমানে ২৫ থেকে ৪০ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় নলকূপে পানি উঠছে না।
এদিকে এবার তীব্র পানি সংকটে পড়েছে কুষ্টিয়া। কুষ্টিয়া শহর ছাড়াও মাঝে মধ্যেই ভেড়ামারা, কুমারখালী ও খোকসা শহরে নলকূল থেকে পানি না ওঠার মতো ঘটনা ঘটছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী ইব্রাহীম মো. তৈমুর বলেন, পানির স্তর নেমে যাওয়ার পেছনে যত্রতত্র সাবমারসেবল (গভীর নলকুপ) পাম্প বসানোও দায়ী। তিনি বলেন, পৌর এলাকায় পাইপ লাইনের সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল হলে এ সমস্যা এতো প্রকট হতো না। কিন্তু সরবরাহ পর্যাপ্ত না হওয়ায় মানুষ সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়েছে। শহর এলাকায় একের পর এক পাম্প বসিয়ে ভূগর্ভ থেকে পানি তুলে আনায় স্তর দিনে দিনে নামছে। ভালো মতো বৃষ্টি না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না, বলেন তিনি।
কুষ্টিয়া পৗর কর্তৃপক্ষ বলছে, গড়াইয়ে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি পানির স্তর গত কয়েক বছরের তুলনায় ৩২ ফুট নেমে যাওয়ায় হস্ত চালিত নলকূপ ও পাম্পে উঠছে না পানি। কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, সাধারণত ২৪ ফুট নিচে পর্যন্ত পানির স্তর থাকলে এই শহরে নলকুপ দিয়ে পানি ওঠে। পৌরসভা থেকেই এই শহরে বসানো আছে ৪ হাজার ৩শ টিউবওয়েল। নাগরিকরা এর বাইরে নিজ উদ্যোগেও বসিয়েছে। এখানে ঠিকমতো পানি উঠছে না। পৌরসভার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, পানির লেয়ার নিচে থাকায় আমাদের উৎপাদন ক্ষমতাও ৫০ ভাগ কমে গেছে।
তিনি বলেন, আধা ঘণ্টা পানি তুললেই স্তর নিচে চলে যাচ্ছে, আর পানি উঠছে না। তিনিও ভালমতো বৃষ্টির প্রত্যাশায় আছেন।
Comments