পর্যটকশূন্য পর্তুগালে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা সংকটে
বৈশ্বিক করোনা মহামারির প্রভাবে পর্যটন নির্ভর পর্তুগালের অর্থনীতি বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপরও। দেশটিতে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি অভিবাসীর ৯০ ভাগই পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় যুক্ত। পর্যটকশূন্য পর্তুগালে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে সুভেনির ব্যবসায়ীরা বড় লোকসানে এখন বিপর্যস্ত।
মহামারিতে বিগত দেড় বছরে পর্যটন খাতের বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। যারা টিকে থাকার চেষ্টা করছেন তারাও বিপুল দেনায় রয়েছেন। দোকান ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছেন।
গত বছর করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুতে পর্তুগিজ সরকার ১৮ মার্চ থেকে প্রথম লকডাউন ঘোষণা করে। বন্ধ হয়ে যায় পর্যটনসহ বেশিরভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য। ২ মে থেকে লকডাউন প্রত্যাহার করা হলেও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন বিধিনিষেধের ফলে অনেকেই আর প্রতিষ্ঠান খুলতে পারেননি। যারা খুলেছিলেন আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে এক পর্যায়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। যারা চাকরি করেন তাদের কাজে যোগ দেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কিছু কিছু কোম্পানির কর্মীরা লে-অফের সুবিধা পেলেও বেশিরভাগ কর্মী ছিলেন সেই সুবিধার বাইরে।
গত ১ মে থেকে লকডাউন শিথিলে স্বাভাবিক জীবন শুরু হলেও আবার কবে সব কিছু আগের অবস্থায় ফিরবে তা কেউ বলতে পারছেন না। অনেকেরই আশঙ্কা, হয়তো পরিস্থিতি কখনোই আর আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না।
বাংলাদেশ কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব ও পর্তুগাল বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রানা তাসলিম উদ্দিন বলেন, ‘দীর্ঘ ১৩ মাসের টানা জরুরি অবস্থা ও লকডাউনে বাংলাদেশি কমিউনিটি ব্যবসা-বাণিজ্য ও পেশাগতভাবে বিপুলভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন। চাকরিজীবীদের অনেকে বেতন বা লে অফ পেয়ে টিকে থাকতে পারলেও ব্যবসায়ীরা লোকসানে একেবারে বিধ্বস্ত। কারণ একে তো পর্যটন শূন্য তার উপর অনেক বাড়ির মালিক দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভাড়া কমাননি।’
রাজধানী লিসবনের প্রাণকেন্দ্রে প্রায় দুই হাজারের বেশি বাংলাদেশি সুভেনির শপের বেশিরভাগ এখন বন্ধ। বাণিজ্যিক ও ঐতিহাসিক পর্যটন নগরী পোর্তোতে প্রায় ২০০ সুভেনির শপের বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার জন্য লড়াই করছেন।
পোর্তোতে পাঁচ বছর ধরে সুভেনির ব্যবসায় যুক্ত বাংলাদেশি জাফরুল হাসান বলেন, ‘এত খারাপ অবস্থায় কখনো পড়তে হয়নি। তিন মাস পরে দোকান খুলেও তেমন কোন ক্রেতা পাচ্ছি না। এভাবে চলতে থাকলে বছর শেষে ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হব।’
আরেক ব্যবসায়ী নবিউল হক বলেন, ‘সবারই ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১০ ভাগে নেমে এসেছে বিক্রি। এমন অনেক দোকান আছে যার ভাড়া দুই-তিন হাজার ইউরো অথচ সারাদিন দোকান খোলার রাখলে ১০-২০ ইউরো বিক্রি হয়। এমনও দিন যায় এক ইউরোও বিক্রি হয় না।’
করোনাকালে বাংলাদেশি খাবারের রেস্তোরাগুলো কঠিন সময় পার করছে। একেক সময় একেক নিয়মের বেড়াজালে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ধস নেমেছে। শুধু হোম ডেলিভারি নির্ভর ব্যবসা করে অনেক প্রতিষ্ঠানের খরচ জোগাড় করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। কিছু রেস্টুরেন্ট এই সময়ে বন্ধ থাকলেও বেশিরভাগ চলেছে লোকসান বা সমান খরচে। গত ১৯ এপ্রিল থেকে রেস্টুরেন্টের উপর থেকে কিছুটা বিধিনিষেধ শিথিল করায় আবার চাঙ্গা হতে শুরু করে এই ব্যবসা।
তবে লকডাউনের সময়ে মিনি মার্কেট বা নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা বেশ ভাল করেছেন। এই সময়ে মানুষ দূরের বাজারে না গিয়ে ঘরের পাশে ছোট ছোট গ্রোসারি শপগুলো থেকে নিত্যপণ্য কিনেছেন। ফলে ব্যবসা কয়েকগুণ বেড়েই শুধু যায়নি নতুন নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
ইউরোপের অন্য দেশগুলোর মতো পর্তুগালেও গ্রীষ্মকালীন ব্যবসা বাণিজ্যে ওপর নির্ভরশীল। এই মউসুমেই বেশিরভাগ অর্থনৈতিক কাজকর্ম চলে। বিশেষ করে পর্যটন শিল্পে বছরের এই সাত-আট মাস কাজ থাকে। তবে এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কাজ বেশি থাকে।
২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত বেকার আছেন পর্যটন শিল্পের কর্মীদের বড় একটা অংশ। ওই বছরের গ্রীষ্ম শেষ হলে পর্যটন শিল্প, আবাসিক হোটেল বা রেস্টুরেন্টের নিয়োজিত বাংলাদেশিসহ অনেক অভিবাসী পরবর্তী বছরের মার্চ/এপ্রিলে আবারও কাজে যোগ দেওয়ার অপেক্ষা ছিলেন। কিন্তু মার্চ থেকে করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়া তাদের আর চাকরিতে ফেরা হয়নি।
বাংলাদেশ কমিউনিটি অব পোর্তোর সভাপতি শাহ আলম কাজল বলেন, পর্তুগাল করোনা পরিস্থিতিতে ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধের পাশাপাশি অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি চাকরি হারিয়েছেন। অনেকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে থেকে প্রতি মাসে বেতনের বড় একটি অংশ নগদ সুবিধা পেলেও যারা চুক্তি ছাড়া কাজ করেছে বা মহামারি শুরুর আগে বেকার ছিলেন তাদের বেশিরভাগকেই দীর্ঘ এই সময়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়েছে। যদিও সময়ে সময়ে বাংলাদেশি কমিউনিটিসহ স্থানীয় অনেক সংগঠন এবং বাংলাদেশ দূতাবাস জরুরি সেবা নিয়ে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু সেটা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় গত ১ মে থেকে দ্বিতীয় ধাপের লকডাউন অনেকটাই শিথিল করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে পর্তুগাল। অফিস-আদালত, কাজ-কর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়েছে। খুলছে স্পেনের সঙ্গে বন্ধ থাকা সীমান্ত ও অনেক দেশের বিমান যোগাযোগ। উন্মুক্ত হয়েছে পর্যটন কেন্দ্রগুলো। কমিউনিটি সংগঠকরা প্রত্যাশা করছেন করোনা আবার যদি আঘাত না করে তাহলে জুনের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যে প্রাণ ফিরতে শুরু করবে।
লেখক: লিসবন প্রবাসী সাংবাদিক
Comments