করোনায় বড় ক্ষতি সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পের
করোনা মহামারিতে বই প্রকাশক ও ব্যবসায়ীরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। দেশে সৃজনশীল বইয়ের প্রকাশনা ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ।
বাংলা একাডেমির তথ্য মতে, গত বছর মেলায় বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৮৩ কোটি টাকার বই। এবার, বৈরী পরিবেশের কারণে বলা হচ্ছে প্রায় আট কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে।
লকডাউনে বই নিত্যপ্রয়োজনীয় না হওয়ায় করোনার শুরুর দিক থেকে দীর্ঘ সময় বন্ধ রাখতে হয়েছে প্রকাশনা কার্যক্রম ও বইয়ের দোকান। ফলে সংকটে পড়েছেন বই প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত লেখক, প্রকাশক, অনুবাদক, সম্পাদক, প্রুফরিডার, ছাপা-বাঁধাইখান কর্মচারী ও বই ব্যবসায়ীরা।
দীর্ঘদিন ধরে সংকটের কারণে কেউ প্রকাশনা ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার পথে আবার কেউ বা দেউলিয়া হয়ে দিশাহারা। প্রকাশনায় কেউ হারিয়েছেন চাকরি। আবার কারো বেতন হয়েছে অর্ধেক।
গত বছর শেষে লকডাউন তুলে নেওয়া হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেচাকেনা হয়নি বললেই চলে। গত মার্চে বইমেলা হলেও তা জমে উঠেনি। এমন পরিস্থিতি চলমান থাকলে সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘করোনায় অন্য সব কিছুর মতো সৃজনশীল প্রকাশনী, বইয়ের ব্যবসা ভয়াবহ সময় পার করছে। আমরা নানাভাবে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে সরকারি বিভিন্ন সোর্সে আমরা আবেদন করেছি বই কেনার মাধ্যমে প্রকাশকদের পুনর্বাসন করতে।’
‘পরিস্থিতির কারণে তদারকি করে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এর মধ্যে দৃশ্যমান যে, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় পাবলিক লাইব্রেরি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র— এই দুই দপ্তরের মাধ্যমে বই সংগ্রহ করে। এর মাধ্যমে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বই কেনা হয়। এর মধ্যে এক কোটি টাকা ভ্যাট বাদ দিয়ে চার কোটি টাকার মতো পায় প্রকাশনীগুলো।
প্রকাশনা শিল্প টিকে থাকার জন্য এই বিক্রি যথেষ্ট কি না— এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অবশ্য যথেষ্ট না। সারা বছর চলার মতো বিক্রি প্রকাশনীর থাকা দরকার। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান বন্ধ। বইমেলাও জমে উঠেনি। তাছাড়া, এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। এছাড়াও, ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে বৈরী সময় পার করছে।’
গত ৩০ বছর ধরে বই প্রকাশনার সঙ্গে আছেন শ্রাবণ প্রকাশনীর রবিন আহসান। তবে তিনি প্রকাশকদের সংগঠন জ্ঞান ও সৃজনশীল সমিতির সদস্যও না, আবার বইমেলাতেও অংশ নেন না। স্রোতের বিপরীতে থেকে কীভাবে বৈরী সময় পার করছেন? — সে বিষয়ে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সৃজনশীল বই ব্যবসা আমারা পেশা ও নেশা। বই প্রকাশ, বই পড়ানো, পাঠক বাড়ানো এটিকে আন্দোলন হিসেবে নিয়েছি। ফলে ঢাকা-কেন্দ্রিক মেলা বাদ দিয়ে প্রান্তিক মানুষের কাছে বই পৌঁছাতে একটা গাড়ি নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু জন্মশত বর্ষ বইমেলা’ শিরোনামে ঢাকার বাইরে স্কুলগুলোতে মেলা শুরু করেছিলাম। কিন্তু, করোনা আসায় থমকে গেছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। মেলা করা যাচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রকাশনীর ক্ষতিতে সরকারি প্রণোদনা নেই। ব্যাংকের সরাসরি ঋণ নেই। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ নেই। এতসব সংকট থেকে বাঁচতে লড়াই করে যাচ্ছি।’
‘টিকে থাকার জন্য বইবিডি অনলাইন নামে ফেসবুকের মাধ্যমে বই বিক্রির চেষ্টা করেছি। এ ছাড়া আর উপায় নেই,’ যোগ করেন তিনি।
পাবলিশার্স ফোরাম, কাঁটাবনের সভাপতি শওকত আলী তারা ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘করোনায় আমরা বিপর্যস্ত। এর মধ্যে বইমেলায় অংশ নিয়ে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমার সমগ্র প্রকাশনের ৮০টির মতো বই রয়েছে। আরও কিছু নতুন বই নিয়ে বইমেলায় অংশ নিয়েছিলাম। এতে খরচ হয়েছিল ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। মেলায় বিক্রি করেছি মাত্র ১২ হাজার টাকা।’
‘এভাবে প্রায় অধিকাংশ প্রকাশনী ক্ষতিগ্রস্ত,’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সংগঠনে সদস্য ৫৪জন প্রকাশক। মেলা চলাকালে সবাই পরামর্শ করে ভর্তুকি চেয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি গত ১১ এপ্রিল। এখনো কোনো সাড়া পাইনি। কবে সাড়া পাব তাও জানি না।’
‘বলা যায় প্রকাশনা জগৎ ধ্বংসস্তূপে নিমজ্জিত। নগদ টাকায় কাগজ কেনা, ছাপা, বাঁধাই— সবই করতে হয়। বিক্রি হয় ধীরে ধীরে। কিন্তু, দিনের পর দিন এই পুঁজি আটকে থাকায় কী যে ক্ষতি হয় তা বলে বুঝাতে পারবো না,’ যোগ করেন তিনি।
করোনার বিধিনিষেধ, হরতাল ও গণপরিবহণ বন্ধের মধ্যে এবারের বাংলা একাডেমি বইমেলা অনুষ্ঠিত হলেও তা জমে উঠেনি। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০৭টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫৪টি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৮০টি ইউনিট করে মোট ৫৪০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৩৪টি ইউনিট দেওয়া হয়েছিল। প্যাভিলিয়ন ছিল ৩৩টি।
এছাড়াও, ১৩৫টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দের পাশাপাশি পাঁচটি উন্মুক্ত স্টলসহ ১৪০টি স্টল ছিল। এবারে কবিতা-গল্প-ইতিহাস-গবেষণা-সম্পাদনার নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ৬৪০টি।
Comments