প্রথম সমুদ্রযাত্রার প্রথম ছুটিতে
২০১৩ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম থেকে আমরা তিন ব্যাচমেট একইসাথে একই জাহাজে যোগ দিয়েছিলাম। সেই জাহাজ গেল মিয়ানমার, মানে আমার প্রথম বিদেশ! আমার প্রথম পোর্ট ছিল মিয়ানমার ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল থিলওয়া (সংক্ষেপে, এম.আই.টি টি) যা ইয়াঙ্গুন মূল শহর থেকে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্ব। ট্যাক্সিতে করে কখনও সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার, কখনও ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার আবার কখনও থার্ড ইঞ্জিনিয়ার স্যারের সাথে চলে যেতাম ইয়াঙ্গুনে। সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার স্যার তার পরিবারসহ সেইল করেছিলেন।
মনে আছে আমি প্রথম 'শোর লিভে' (সোজা বাংলায়, জাহাজ থেকে নেমে ডাঙায় ঘোরাঘুরি) গিয়েছিলাম থার্ড ইঞ্জিনিয়ার রিয়াদ স্যারের সাথে। প্রথম শোরলিভের স্মৃতি হিসেবে স্যারের টাকা দিয়ে ছোট্ট একটা টেবিল ঘড়িও কিনেছিলাম যা এখনো সচল! সাধারণত ক্যাডেটদের শোরলিভে আসা-যাওয়া এবং খাওয়ার সমস্ত খরচ সিনিয়ররা দিয়ে থাকে যা মেরিনারদের একটা চমৎকার ট্র্যাডিশন। আমার ক্যাডেট লাইফেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
ইয়াঙ্গুন শহরে পৌঁছানোর আগে দূর থেকেই চোখে পড়ে বিশাল বিশাল প্যাগোডার। সবচেয়ে বিখ্যাত প্যাগোডার নাম 'সুলে প্যাগোডা' যা সবাই এক নামে এনে। ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের সুলে প্যাগোডার সামনেই নামিয়ে দিয়েছিল। সুলে প্যাগোডার গা ঘেঁষেই দেখি চমৎকার 'বাঙালি ছুন্নী জামে মসজিদে'! মসজিদের বাইরের দেয়াল আর ভিতরে নামাজের সময়সূচিতে বার্মিজের পাশাপাশি বাংলা লেখা দেখে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছিলাম।
ইয়াঙ্গুনে প্রায় আধা মিনিটের হাঁটা দূরত্বে মসজিদ, প্যাগোডা আর গীর্জা দেখেও কম অবাক হইনি। 'নীলার বিরিয়ানি' নামে একটা সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট ছিল যেখানে বেশ কয়েকবার পেটপূজা করেছি। ট্র্যাডিশনাল সাউথ ইন্ডিয়ানদের মতো অ্যালুমিনিয়ামের বালতিতে করে ডাল তরকারি ইত্যাদি পরিবেশন করতো। 'রেইন ইন্টারনেট' নামে সুলে প্যাগোডার কাছেই একটা ফোনের দোকান ছিল। বেশ সস্তায় অনেকক্ষণ দেশে কথা বলা যেত, অনেক সময় কাটিয়েছি সেখানে। উল্লেখ্য, আমার ফোনের খরচও সাথে থাকা সিনিয়ররা দিয়েছেন সবসময়।
আমরা সাধারণত দুপুরের পর যেতাম শোরলিভে। কখনও রাত ১০/১১ টায় ফেরার সময় দেখতাম নির্জন রাস্তায় নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে একা একা মেয়েরা হাঁটছে, বাড়ি ফিরছে! রাস্তার চারপাশে বেশ ঘন জঙ্গল, পাহাড়। নিরাপত্তাহীনতায় না হোক, ভূতের ভয়ে আমি নিজেও একা একা অমন রাস্তায় চলতে পারতাম কিনা সন্দেহ আছে!
বার্মাতে আমরা লগ (বড় বড় গাছের গুঁড়ি) লোড করেছিলাম। প্রায় ১৮ দিন ছিলাম এম.আই.টি.টি পোর্টে। এরপরের গন্তব্য ছিল ইন্ডিয়ার কর্নাটকার নিউ ম্যাঙ্গালোর। নিউ ম্যাঙ্গালোর নামে যে ইন্ডিয়ার কোনো জায়গা আছে সেটাই জানতাম না। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো ব্যাঙ্গালোর, পরে দেখলাম যে ওটা আসলেই ম্যাঙ্গালোর। সেখানে ওদের লোকাল বাসে চেপে শোরলিভে গিয়েছিলাম।
এরপর গুজরাটের পোর্ট 'মুন্দ্রা'। সেখান থেকে ইরানের আসালুয়ে পোর্ট। ইরানে শোরলিভে যাবার সুযোগ হয়নি তবে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সে সময় জাহাজে ইন্টারনেট সহজলভ্য না থাকায় আমরা প্রতিটি পোর্টে গিয়েই সে দেশের সিমকার্ড কিনতাম ১০/২০ ডলার দিয়ে। ইরানে গিয়েও সিমকার্ড কিনে রিচার্জ করতে গিয়ে দেখি সব আরবি ভাষায় লেখা। স্থানীয় যারা আসতো জাহাজে ক্রেইন অপারেট করতে তাদের একজনকে বললাম আমার সিমে রিচার্জ করে দিতে যেহেতু আমি পড়তে পারছিলাম না। সে লোকটা সুন্দর করে গোপন নাম্বার নিয়ে নিজের ফোনে রিচার্জ করে নেয়। এরপর 'নো নো' বলে এমন অঙ্গভঙ্গি করছিল যেন ও ইংরেজি কিছুই বোঝে না। অথচ কিছুক্ষণ আগেই রিচার্জ করে দেবে বলে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি ব্যবহার করছিল! এই ঘটনার পর আরেকজনকে টাকা দিয়ে বললাম আমার নাম্বারে রিচার্জ করে দিতে। আরও রিচার্জ লাগবে কেন জিজ্ঞেস করায় ওকে পুরো ঘটনা বললাম। এরপর ও ওর সহকর্মীর ঘটনায় লজ্জিত হয়ে রিচার্জ করে দেয়। অনেক জোর করেও ওকে সে টাকা দিতে পারিনি! কথা প্রসঙ্গে বলেছিল, ওর নাম আব্বাস, আজারবাইজানের নাগরিক।
ইরান থেকে গিয়েছিলাম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ 'হা লং বে' আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ ভিয়েতনামে। সেখানে গিয়ে দেখি রাস্তায় গাড়ির চাইতে স্কুটির সংখ্যাই বেশি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই স্কুটি চালাচ্ছে। ভিয়েতনামেই প্রথম লাইভ সী-ফুডের রেস্টুরেন্ট দেখেছিলাম। অ্যাকুরিয়ামে বড় বড় চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছ ইত্যাদি থাকে। পছন্দ করে বললে তৎক্ষণাৎ রান্না করে পরিবেশন করে। চপস্টিকের ব্যবহারও শিখেছিলাম একটু আধটু। অসংখ্য সবুজ পাহাড় আর ঝরনা চোখে পড়েছিল। ভিয়েতনামে মুদ্রাস্ফীতি অনেক বেশি। এক ডলারে প্রায় ২০,০০০ ডং। মাত্র ৫ ডলার এক্সচেঞ্জ করলেই লাখপতি! জামাকাপড় থেকে প্রায় সবকিছুতেই তিন ডিজিটের পর K লেখা অর্থাৎ হাজার। যেমন, একটা টি-শার্ট ২০০k, মানে ২ লাখ ডং, বাংলা টাকায় ৮০০! প্রথমদিকে লাখ লাখ টাকা (ডং) হিসেব করতে বেশ গড়মিল লেগে গিয়েছিল।
ভিয়েতনাম থেকে সিমেন্টের ক্লিংকার লোড করে বাংলাদেশে এসেছিলাম। দেশি কোম্পানিতে চাকরি করার এটা এক বিরাট সুবিধা, মাস দুই পরপর চট্টগ্রাম আসা যায়। অনেক জাহাজ আবার প্রতি মাসেই চট্টগ্রাম আসে। অনেক মেরিনার তখন অল্প সময়ের জন্য বাড়ি যায়, কারো কারো পরিবার জাহাজে আসে। সে এক চমৎকার অনুভূতি।
এরপর আবার গিয়েছিলাম ইন্ডিয়া, তবে নতুন পোর্ট বিশাখাপত্তমে (ভাইজাগ-ও বলে)। সেখানে শোরলিভে যাবার অনুমতি ছিল না। ভাইজাগ থেকে প্রথমবারের মতো সেইল করেছিলাম আফ্রিকা মহাদেশের উদ্দেশ্যে, গন্তব্য কেনিয়ায় মোম্বাসা। এরপর মোজাম্বিকের তিন পোর্ট নাকালা, মাপুতো (মোজাম্বিকের রাজধানী) আর বেরা'তে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে প্রায় ১৭ দিনের ভয়েজ শেষে আবার ইন্ডিয়া। এবারও নতুন আরেক জায়গা, গোয়া'র ভাস্কো।
বিখ্যাত পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-ডা-গামা'র নামানুসারে যিনি সমুদ্রপথে প্রথম ইউরোপ থেকে ইন্ডিয়া আসার পথ পেয়েছিলেন। স্থানীয়দের থেকে শুনেছি, ভাস্কো-দা-গামা ইউরোপ থেকে প্রথমে গোয়া'র বর্তমান ভাস্কোতেই এসেছিলেন বলে এই নামকরণ। গোয়া'তে শোরলিভে যাবার সুযোগ হয়েছিল অল্প সময়ের জন্য। পাহাড় আর সমুদ্রের চমৎকার সমন্বয় দেখে অভিভূত হয়েছিলাম।
সেখান থেকে আবার আফ্রিকা, তবে এবার নতুন দেশ তানজানিয়া। সেদেশের 'তাঙ্গা' আর 'দার-এস-সালাম' (তানজানিয়ার সবচেয়ে বড় শহর) পোর্টে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বারের মতো গিয়েছিলাম কেনিয়ার মোম্বাসায়। মোম্বাসার 'বাম্বুরী বীচে' গিয়ে প্রথমবারের মতো উটের পিঠে চড়েছিলাম। ইঞ্জিন ছাড়া শুধু পাল তোলা অসংখ্য নৌকা দেখেছি।
আফ্রিকাতে গিয়েও শাহরুখ খানের 'ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম' ক্রিমের বড় বিলবোর্ড দেখে যথেষ্ট অবাক হয়েছিলাম। তবে আমাদের উপমহাদেশের মতো গায়ের রং ফর্সা আর উজ্জ্বল করে লেখার দুঃসাহস দেখায়নি। লিখা ছিল স্কিন মসৃণ আর কোমল করে! আফ্রিকার আরও একটা দেশে যাবার সুযোগ হয়েছিল। কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলার সাউথ আফ্রিকা। সেখানের 'রিচার্ড'স বে' পোর্টে গিয়েছিলাম।
আফ্রিকা থেকে এবার এশিয়ার মিডলইস্ট। গিয়েছিলাম ইউনাইটেড আরব আমিরাতের 'ফুজাইরা'। সেখান থেকে চায়না। চায়নার তিনটি প্রদেশে গিয়েছিলাম, ফেং চ্যাঙ, তিয়ানজিন আর ডালিয়ান। এরমধ্যে ডালিয়ান শহরকেই বেশি উন্নত মনে হয়েছে।
চায়নাতে গিয়ে যোগাযোগ করা নিয়ে সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলাম। ওদের কেউই তেমন ইংরেজি বোঝে না। মনে আছে হালাল খাবারের খোঁজে অনেক কষ্টে একটা টার্কিশ দোকান পেয়েছিলাম। চিকেন বুঝানোর জন্য মুরগির মতো 'কক কক' করতে হয়েছিল আমাদের! চায়নিজ 'সুশি' খেতেও মন্দ লাগেনি।
চায়না'তে থাকাবস্থায় কোরবানির ঈদ পেয়েছিলাম। উল্লেখ্য, মেইডেন ভয়েজে আমাকে পরিবার ছাড়া চারটা ঈদ (দুই রোজার, দুই কোরবানির) উদযাপন করতে হয়েছিল, সেই শুরু! আমাদের ক্যাডেটদের 'ঈদি বা সালামি' দেয়া হয়েছিল ডলারে। সেসময় জাহাজ থেকে বাসায় যোগাযোগ করতাম স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে, ১০ ডলারে ২৪ মিনিট! সালামি হিসেবে স্যাটেলাইট ফোনকার্ডও পেয়েছি সিনিয়র স্যারদের থেকে।
এরপর চায়না থেকে জাহাজ আবার ইরানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেও আমার কন্ট্রাক্ট শেষ হয়ে যাওয়ায় শ্রীলঙ্কার গল থেকে সাইন অফ করেছিলাম। সেখানে একদিন হোটেলে থাকাবস্থায় ক্রিকেটের বিখ্যাত 'গল টেস্টের' গল স্টেডিয়াম আর 'গল ফোর্ট' দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। গলে মাইকে আজান শুনে মসজিদের শহর ঢাকায় চলে এলাম কিনা ভেবে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলাম। চারদিকে এমনভাবে আজান শুনেছি যে মনেই হয়নি মুসলিম সংখ্যালঘু কোন দেশে আছি!
অতঃপর চমৎকার কিছু মানুষদের সান্নিধ্যে থেকে, আজীবন মনে রাখার মতো অসংখ্য স্মৃতি নিয়ে দীর্ঘ ১৫ মাস ১৪ দিন পর সাইন অফ করেছিলাম আমার প্রথম জাহাজ 'ট্রান্সওশান প্রোগ্রেস' থেকে।
এরপর সেই ২০১৩ থেকে এখনো--"হইয়া আমি দেশান্তরি, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে। নোঙর ফেলি ঘাটে ঘাটে, বন্দরে বন্দরে..."
লেখক: আব্দুল্লাহ-আল-মাহমুদ, মেরিনার।
Comments