চাহিদা দ্বিগুণ, চ্যালেঞ্জে অক্সিজেন সরবরাহ
করোনা সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে গত কয়েক সপ্তাহে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। জীবন রক্ষাকারী এই গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ।
অক্সিজেনের ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার কারণে বেশিরভাগ সরবরাহকারী ইতোমধ্যে শিল্প কারখানায় অক্সিজেন সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছে। উৎপাদিত অক্সিজেনের সবটুকুই করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত হাসপাতালগুলোতে দিয়ে দিচ্ছে তারা।
হাসপাতাল সূত্র বলছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর করোনা সংক্রমণ অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় এবং নতুন স্ট্রেইনগুলো অতি মাত্রায় সংক্রামক হওয়ায় রোগীদের ফুসফুস মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকেরই তীব্র শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে বেশি সংখ্যক রোগীকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে।
তারা আরও জানান, গুরুতর অসুস্থদের জীবন বাঁচাতে অক্সিজেন সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা অত্যন্ত জরুরি। বেশিরভাগ রোগীই তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসছেন এবং তাদের হাই-ফ্লো নজেল ক্যানুলার মাধ্যমে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার টন অক্সিজেন প্রয়োজন। এ অক্সিজেনের ৯০ শতাংশই সরবরাহ করে লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি বহুজাতিক কোম্পানি। বাকিটা সরবরাহ করে ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড ও স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেড।
লিন্ডে বাংলাদেশের মুখপাত্র সাইকা মাজেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘কোভিড হাসপাতালগুলোতে মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই চাহিদা মেটাতে আমরা এখন শিল্পজাত অক্সিজেনের চেয়ে মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।’
তিনি জানান, লিন্ডে বাংলাদেশ দেশের সবগুলো সরকারি হাসপাতালেই অক্সিজেন সরবরাহ করে। পাশাপাশি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রগুলোতে (আইসিইউ) নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন দরকার হয়, এমন কিছু বড় বেসরকারি হাসপাতালেও অক্সিজেন সরবরাহ করে।
লিন্ডে বাংলাদেশের অক্সিজেনের ঘাটতি আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এক অর্থে, কিছু ঘাটতি তো আমাদের আছেই।’
সাইকা মাজেদ বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে আমাদের দুটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট আছে। এগুলো থেকে প্রতিদিন ৯০ টন অক্সিজেন উৎপাদিত হয়। আগে মেডিকেল ও শিল্পজাত অক্সিজেনের অনুপাত ছিল প্রায় ৬০:৪০। শিল্পজাত অক্সিজেনের চাহিদা আগের মতো থাকলেও মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ফলে অনুপাত হয়ে গেছে ৮০:২০। এ কারণে আমরা শিল্পজাত অক্সিজেনের উৎপাদন কমিয়ে মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনকে প্রাধান্য দিচ্ছি।’
ভারতেও লিন্ডে বাংলাদেশের একটা অক্সিজেন প্ল্যান্ট রয়েছে। সেখান থেকে ট্যাংকারে করে অক্সিজেন এনে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে।
সাইকা মাজেদ বলেন, ‘ভারত থেকে আরও ২০ শতাংশ অক্সিজেন আনার চেষ্টা করছি আমরা।’
বিপুল পরিমাণ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ২২ এপ্রিল থেকে শিল্পজাত অক্সিজেন সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত।
এ নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশে অক্সিজেন সরবরাহের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে কি না-এ প্রশ্নের জবাবে লিন্ডের মুখপাত্র বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যার মুখোমুখি হইনি আমরা। যেহেতু ভারতে লিন্ডের একটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট আছে, সেহেতু আন্তকোম্পানি হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় এখানে অক্সিজেন আনা যায়। যদি ভারত সরকার এটা বন্ধ করে দেয়, তবে এ ব্যাপারে দুই দেশের সরকারের একটা সমঝোতায় আসতে হবে।’
লিন্ডে ছাড়া আরও যেসব কোম্পানি ভারত থেকে অক্সিজেন আনছে, তাদের নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। আগে যতটুকু অক্সিজেন পাওয়া যেত, এখন তার অর্ধেক পাচ্ছে তারা।
ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুস্তাইন বিল্লাহ জানান, আগে তারা প্রতি সপ্তাহে ভারত থেকে ৩০ টন অক্সিজেন আমদানি করতেন। কিন্তু এখন মাত্র ১৫ টন আমদানি করা যাচ্ছে।
মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা অনেক বেড়ে যাওয়ায় ২০ দিন আগে থেকেই ইসলাম অক্সিজেন শিল্পজাত অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমরা দৈনিক ২৮ হাজার কিউবিক মিটার অক্সিজেন উৎপাদন করি। এর পুরোটাই এখন মেডিকেল অক্সিজেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্পেকট্রা অক্সিজেনের এক কর্মকর্তা জানান, স্পেকট্রা দৈনিক ২৫ টন মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন করে।
তিনি বলেন, ‘এখন চাহিদা বেড়ে গেছে। আগে আমাদের ৬০ শতাংশ যন্ত্র মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনের কাজ করতো। এখন সবগুলো যন্ত্র ২৪ ঘণ্টা শুধু মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনের কাজই ব্যবহার হয়।’
দেশে করোনা সংক্রমণের পাশাপাশি মৃত্যুও ব্যাপকভাবে বাড়ছে। হাসপাতালগুলোর যে অবস্থা, তাতে তারা রোগীদের আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সুবিধা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক জানান, তারা এখনও অক্সিজেন সংকটে পড়েননি। তবে চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘আগে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ২০ হাজার কিউবিক মিটারের ট্যাংক খালি হতে তিন দিন লাগত। আর এখন এটি দুদিনেই খালি হয়ে যাচ্ছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যবস্থায় সরবরাহ করা অক্সিজেন ছাড়াও গুরুতর অসুস্থদের জন্য ঢাকা মেডিকেলে আরও ৭০০ সিলিন্ডার আছে বলে জানান তিনি।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অসিম কুমার নাথ গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, গত মাস থেকে অক্সিজেনের চাহিদা ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘অক্সিজেন সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো প্রতিদিন এই হাসপাতালের ১২ হাজার কিউবিক মিটার ট্যাংকে অক্সিজেন সরবরাহ করছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রায় অর্ধেক রোগীরই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে।’
গ্রিন রোডের নিউ লাইফ হাসপাতাল লিমিটেড কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা এখন যে পরিমাণ অক্সিজেন পাচ্ছে, চাহিদা পূরণে তার চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি অক্সিজেন প্রয়োজন।
সিলিন্ডারের মাধ্যমে একজন রোগীকে মিনিটে সর্বোচ্চ ছয় লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হয়। কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের মাধ্যমে এর চেয়ে অনেক বেশি অক্সিজেন নিরবচ্ছিন্নভাবে দেওয়া সম্ভব। তবে তা নির্ভর করে তরল অক্সিজেনের সরবরাহের ওপর।
অক্সিজেন সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর তথ্য অনুসারে, হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট অন্য শিল্পগুলোতে দৈনিক ১৮০ টন অক্সিজেনের চাহিদা রয়েছে।
লিন্ডে বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রায় ৯০ টন এবং স্পেকট্রা অক্সিজেন প্রায় ২৫ টন অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। এই দুটি কোম্পানি বেশিরভাগ সময় সরকারি হাসপাতালগুলোতে ট্যাংকের মাধ্যমে তরল অক্সিজেন সরবরাহ করে। আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণত সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন দেয় তারা।
এছাড়া, স্থানীয় কোম্পানি ইসলাম, মেঘনা ও আবুল খায়েরও স্বল্প পরিমাণে অক্সিজেন উৎপাদন করে থাকে।
পরিবারের কেউ কোভিড আক্রান্ত হলে তার শ্বাসকষ্ট হতে পারে- শুধুমাত্র এই আশঙ্কা থেকেও অনেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনছেন। ফলে খুচরা বাজারেও অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, ‘আমরা এখনো কোনো সমস্যার মুখোমুখি হইনি। কিন্তু এভাবে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে হয়তো সমস্যা সৃষ্টি হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়তই সরবরাহকারীদের সঙ্গে আলোচনা করছি। আমরা তাদেরকে উৎপাদন বাড়াতে এবং মেডিকেল অক্সিজেনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলেছি।’
বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত জানান, তারা এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে শিল্পজাত অক্সিজেন পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, ‘যদি ভবিষ্যতে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হয়, তবে ইস্পাতের উৎপাদন অবশ্যই ব্যাহত হবে।’
Comments