বর্ণবাদ, বাংলাদেশের নারী এবং রং কালো নারীর অভিশপ্ত জীবন
১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২১ মার্চ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক জাতিগত বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস’ হিসেবে পালন করার আহ্বান জানিয়েছিল। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই দিনটিকে ‘জাতিগত বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস’ হিসেবে পালন করে। এই দিবসটি পালনের মূল পরিপ্রেক্ষিত ছিল ১৯৬০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভিলে জাতিগত বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদে সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ মিছিল। যে মিছিলে পুলিশ গুলি করে ৬৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে, আহত হন আরও ১৮০ জন। এই প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল ২১ মার্চ থেকে, সে কারণে ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২১ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক জাতিগত বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ‘মেয়েদের শরীরের রং’ সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে একটি পুরুষতান্ত্রিক হেজিমনিক কর্তৃত্ববাদী ডিসকোর্স দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কারণে নয়, বরং এটিকে কখনও কখনও নারীবাদী পরিপ্রেক্ষিতেও হেয় করে দেখার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। যে কারণে একটি কালো রংয়ের মেয়ে সন্তান জন্ম নেওয়ার পর বাবা-মাকে দীর্ঘদিন দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। যার অবসান ঘটে কালো রং-এর মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দায়মুক্তির মাধ্যমে। দায়মুক্তি কেন? কারণ, এর মূলে রয়েছে মেয়েটির ভালো পরিবারে বিয়ে হবার প্রতিবন্ধকতা, অধিক পরিমাণে যৌতুকের জন্য অর্থের সংস্থান এবং সর্বোপরি মেয়েটির ভালো চাকরি না পাওয়ার অনিশ্চয়তা। এই বিষয়গুলোর কারণে শুধুমাত্র কালো রং নিয়ে জন্ম নেওয়ার ফলে একটি পরিবারকে দীর্ঘমেয়াদী মানসিক সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়।
বাংলাদেশে মূলধারার সমাজ ব্যবস্থা ছাড়াও মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা ‘দলিত’ নামে পরিচিত। প্রথমত এরা মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন অবহেলিত একটি জনগোষ্ঠী। এদের মধ্যে দলিত নারীদের অবস্থা আরও বেশি শোচনীয়। তাদের মধ্যে কালো রং-এর দলিত নারীদেরকে সবচেয়ে বেশি শোষণ, বঞ্চনা এবং অবহেলা সহ্য করতে হয়। কেন এবং কোন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এই ধরনের আধিপত্যবাদী বর্ণবাদী সমাজব্যবস্থায় কালো রং-এর দলিত নারীরা বেঁচে থাকেন সেটি অনুসন্ধানের জন্য সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরের দলিত নারীদের উপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়েছিল কিছুদিন আগে।
শাহজাদপুরের বেশ কয়েকটি জায়গায় দলিত জনগোষ্ঠী মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক ধরনের দুঃসহ জীবনযাপন করে। দরগারচর, ঋষিপুর, বাগদিপাড়া, কান্দাপাড়াসহ বেশ কিছু জায়গায় দলিত জনগোষ্ঠীর বসবাস। লক্ষ করা গেছে যে, শরীরের রং-এর উপর ভিত্তি করে নারীদের বিয়ের যৌতুক নির্ধারিত হয়ে থাকে। সবচেয়ে কালো রং-এর নারীর বিয়ের জন্য এক থেকে তিন লাখ টাকা যৌতুক দিতে হয়। সঙ্গে আরও দিতে হয় স্বর্ণালঙ্কার, আসবাবপত্র, টেলিভিশন, ফ্রিজ ইত্যাদি। যৌতুক ছাড়া সাধারণত কালো রং-এর নারীদের কোনো পুরুষ বিয়ে করতে চায় না। কিছুটা কম কালো রং-এর ক্ষেত্রে যৌতুকের পরিমাণ অন্তত এক লাখ টাকা হয়ে থাকে। তবে দিতে হয় স্বর্ণালঙ্কার, আসবাবপত্র, টেলিভিশন, ফ্রিজ ইত্যাদি। যেসব নারীদের গায়ের রং কিছুটা ফর্সা তাদের জন্য যৌতুক কম লাগে। তবে এক্ষেত্রেও অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে অন্তত ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নারীদেরকে বলা হয়ে থাকে ‘পুরুষশাসিত সমাজের নীরব শিকার’। এর মধ্যে যারা মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অতিপ্রান্তিক জীবনযাপন করেন, প্রথমত তাদের সঙ্গে সমাজ এক ধরনের বর্ণবাদী আচরণ করে। অন্যদিকে, দলিত জনগোষ্ঠীকে সাধারণত ‘মেথর’; ‘অপরিচ্ছন্ন’; ‘নোংরা’ এবং সর্বোপরি ‘অচ্ছুৎ’ নামক নেতিবাচক বিশেষণ দিয়ে আখ্যায়িত করা হয়। এদের মধ্যে আবার দলিত নারীরা ‘দলিতদের অভ্যন্তরে দলিত’ হিসেবে আরও বেশি নিপীড়নের শিকার হন।
২০২১ সালের আন্তর্জাতিক জাতিগত বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস-এর প্রতিপাদ্য হলো, ‘যুব সমাজ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে’। সাধারণত, এ ধরনের দিবসের মাধ্যমে বর্ণবাদী সমস্যাকে দূর করে নতুনভাবে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গীয় অথবা জন্মস্থান অথবা কর্ম-এর ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণের বিলোপসাধনের জন্য ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘বৈষম্য বিলোপ আইন ২০১৪’ নামে একটি আইন অনুমোদন করেছে- যেটি যেকোনো ধরনের বৈষম্য নিরসনে একটি কার্যকর আইন হিসেবে বাস্তবায়ন হবার কথা ছিল। পাশাপাশি অনুচ্ছেদ ২৭ সবার সমান অধিকারের উপর গুরুত্বারোপ করেছে। অনুচ্ছেদ ২৯ বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগের বিষয়টির উপর অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছে। টেকসই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ‘কেউ পিছিয়ে থাকবে না’ নীতি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ২০১৮ সালে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে ‘যৌতুক নিষিদ্ধ’ করার বিষয়ে একটি আইন পাশ করা হয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সংবিধানে যৌতুককে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু আইন থাকার পরেও বাস্তবে দেখা যায় যে, একটি কালো রং-এর কন্যা শিশু জন্মদানের পর থেকে বাবা-মাকে একধরনের মানসিক অবসাদ এবং দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে সন্তানকে বড় করতে হয়। শুধুমাত্র দলিত জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই নয়, মূলধারার তথাকথিত ‘সভ্য’ জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এই কর্তৃত্ববাদী আচরণ ভীষণভাবে বিরাজমান।
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, কালো রং নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুদেরকে পরিবার এমন কিছু পোশাক পরানো শেখায় যেটা তার ‘কালোত্বের পরিমাণ’ কিছুটা কমিয়ে দেবে। অথবা, কালো রং-এর মানুষ কেন কালো পোশাক পরবে-এ ধরনের একটি আচরণ শিশুটির মানসিক বিকাশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে, পরিবার ছাড়াও আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুদের কাছে নানা ধরনের কটূক্তি শুনতে হয়। কালো রংয়ের মেয়ে একটু মোটা হলেতো কথাই নেই। একজন দলিত নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধুমাত্র গায়ের রং কালো হবার কারণে বাবা-মা জোর করে তাকে ১৩-১৪ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছিল। পরে শ্বশুর বাড়িতে তাকে নিয়ে নানা ধরনের হাসি-ঠাট্টা করা হতো। ফলে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
বহুল প্রচারিত একটি পত্রিকায় ‘কালো তবুও সুন্দর’ শিরোনামের সংবাদটি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সৌন্দর্যের মাপকাঠি কি তাহলে শুধুই শরীরের রং? অথবা প্রশ্ন হতে পারে- ‘সৌন্দর্য কী?’ এছাড়া বর্তমানে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও টেলিভিশনে বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ রয়েছে। বেশ কয়েকটি চ্যানেলে গায়ের রং ফর্সাকারী প্রসাধনীর আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়। এসব বিজ্ঞাপন কি বর্ণবাদী আচরণের ক্ষেত্রে উস্কানি দিয়ে থাকে? তাছাড়াও প্রচুর বিলবোর্ডে মেয়েদের রং ফর্সাকারী প্রসাধনীর বিজ্ঞাপন কি কোনভাবে আমাদের সমাজে বর্ণবাদী আচরণের জন্য দায়ী? সমাজ থেকে বর্ণবাদকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার জন্য এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা খুব জরুরি। কেন, কিভাবে এবং কোন প্রেক্ষাপটে কালো রং নিয়ে জন্ম নেওয়া একটি শিশু শুধুমাত্র তার শরীরের রং-এর জন্য মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন- সেগুলোর উত্তর খুঁজে বের করতে না পারলে কালো রং-এর ধারণাটি একটি অভিশপ্ত ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থেকে যাবে। সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এই হেজিমনিক ধারণা থেকে আমাদের মুক্তি প্রয়োজন।
‘কেউই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নয়’- এই ধারণাকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নীতি-নির্ধারকদের কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যেন সমাজ থেকে চিরদিনের জন্য বর্ণবাদী মানসিকতা দূর হয়ে যায়। শুধুমাত্র দলিত জনগোষ্ঠী নয়, একই সঙ্গে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যেন এদেশের সকল ধরনের নাগরিক সুবিধা পায় সেসব নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বহু ভাষা, সংস্কৃতি এবং পেশার বৈচিত্র্যকে ধারণ করে। বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদ এই দেশে বিরাজমান থাকলে সংস্কৃতি পাবে এক অনন্য মর্যাদা। আমাদের যুব সমাজ এবার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোক। ভেঙে ফেলুক পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী বর্ণবাদী আচরণের শৃঙ্খল- যার মাধ্যমে জাতপাত নিপাত গিয়ে মানবতা মুক্তি পাবে- সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী হিসেবে এটি আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি।
লেখক:
মো. রিফাত-উর-রহমান, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক। ইমেইল: rifat218@gmail.com
সাদিয়া আরেফিন, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী
সুবেদা খাতুন, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী
শাহিদা আমিন পিয়া, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments