মুশতাক আমার ভাই

কিশোর কোনো কিছু শেষ করতে পারত না। কোনো কিছু হয়ত পূর্ণও করতে পারত না। এই প্রথম সে তিনশো দিন পূর্ণ করেছে জেলের ভেতর। কিশোরকে অভিনন্দন।
সন্তান কোলে কিশোর ও মুশতাকের সঙ্গে আহসান কবির। ছবি: সংগৃহীত

কিশোর কোনো কিছু শেষ করতে পারত না। কোনো কিছু হয়ত পূর্ণও করতে পারত না। এই প্রথম সে তিনশো দিন পূর্ণ করেছে জেলের ভেতর। কিশোরকে অভিনন্দন।

কিশোর আমার ভাই। আহমেদ কবীর কিশোর ওরফে কার্টুনিস্ট কিশোর। আমার হাত ধরেই ওর কার্টুন আঁকার হাতেখড়ি। কখনো ভেবে দেখিনি কিশোর কোন মাপের কার্টুনিস্ট। আজ সে পৃথিবীর অনেক দেশের সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম। আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও পেয়েছে। তাকে নিয়ে পৃথিবীর পঁচিশটি দেশের কার্টুনিস্ট কার্টুন এঁকেছেন। বিখ্যাত মানুষদের হ্যাপা অনেক। জেলে যেতে হয়। কিশোরও জেলে। ২০২০ সালের ৬ মে র‌্যাব-৩ রমনা থানায় কিশোরকে গ্রেপ্তার দেখানোর পর ওকে কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জের শাপলা সেলের তিন তলায় অন্তরীণ রাখা হয়। অন্তরীণ শেষের পর কিছুদিন কিশোরকে কেরানীগঞ্জের কর্ণফুলী সেলে পাঠানো হয়। এরপর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের কোন একদিন জানতে পারি কিশোরকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে।

করোনা জটিলতায় এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কিশোরের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয়নি।

জেলে কি কাগজ-কলম দেওয়া হয়? কিশোর কি কার্টুন আঁকছে সেখানে? নাকি এখন সে হাত আর পা ঠিক মত নাড়াতেও পারে না? কিশোরের প্রতি কার এত সীমাহীন আক্রোশ ছিল? ২০২০ সালের ৬ মে রমনা থানায় ওকে যারা দেখেছে, তাদের কারও বর্ণনা আজ আমি লিখতে বসিনি। কিশোর গরাদের মেঝে থেকে উঠে বসতে পারছিল না। রমনা থানায় সেদিন কিশোরকে দেখে কান্না সামলাতে পারেননি প্রয়াত মুশতাক আহমেদের স্ত্রী লিপা। সৌভাগ্য, সেদিন আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়নি। আমার চোখে জল আসেনি!

ছোটকালে ‘বড় মাথা’ নিয়ে জন্মেছিল কিশোর। তখনো সে মাথা নাড়াতে পারত না। এগার মাস বয়সে বাবা-মা ও আমরা জানতে পারি কিশোরের বড় মাথার কারণ ‘মেনিনজাইটিস’। জন্ম থেকেই কিশোর ছিল ‘স্বাধীনতার বেনিফিসিয়ারি’। আমাদের সাত ভাই-বোনের মধ্যে চার জন জন্মেছিল স্বাধীনতার পর। হয়ত এ কারণে জন্ম থেকেই কিশোর স্বাধীনচেতা। ওর জন্য আমার প্রথম বিমানে চড়া। খুলনা থেকে যশোর হয়ে এগার মাসের কিশোরকে নিয়ে বিমানে ঢাকায় আসতে হয়েছিল পিজি হাসপাতালে কিশোরের মেনিনজাইটিস অপারেশনের জন্য। যিনি অপারেশন করেছিলেন তার নাম ছিল ডা. করিমউল্লাহ। জানি না এখনো বেঁচে আছেন কি না। বাবা-মা বেঁচে থাকলে আরও কিছু বলতে পারতেন। মার ধারণা ছিল কিশোর বাঁচবে না। ঢাকায় রওনা হওয়ার আগের দিন কিশোরকে নিয়ে মা একটা ছবি তুলেছিলেন। অপারেশনের পরও অনেকদিন সময় লেগেছিল কিশোরের মাথা একটা নির্দিষ্ট ‘শেপ’-এ আসতে। কিশোর বেঁচে যাওয়ার পর মা গিয়েছিলেন স্টুডিও থেকে কিশোর ও তার সেই তোলা ছবিটা আনতে। ছবিটা এখনো আছে। সাদাকালো সেই ছবিটা আনার পর দেখা গেল কিশোর পেছনে হাত দিয়ে কী যেন চুলকাচ্ছে।

ছোটকাল থেকেই কিশোর অনবরত হাত চুলকাতো আর তার হাত ঘামতো। মেনিনজাইটিসের কারণে হুট-হাট রেগে যেত। দুই-একবার শিক্ষকদের হাত কামড়ে দিয়েছিল। কেউ কিছু বললে হুট করে রেগে যেত। শুধু মা কিছু বললে মাথা নিচু করে শুনত। মা বেঁচে নেই দশ বছরের বেশি। বেঁচে থাকলে হয়তো এখনো কিশোরকে ডেকে বকে দিতে পারতেন।

Kishor3.jpg
মায়ের সঙ্গে কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না এ কারণে যে, আমার জন্যই কিশোরের কার্টুন আঁকায় আসা। কিশোর আসলে সহজে কোনো কিছু শেষ করতে পারত না। একবার ভেবেছিল কলেজ পাশ করবে না। পরীক্ষা ড্রপ করেছিল। তারপর সবার অনুরোধে কলেজ পাশ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। শেষ করতে পারেনি। এরপর অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগ দিয়েছিল নৌ-বাহিনীতে। সেখানেও কিশোর শেষ করতে পারেনি। মিড-শিপম্যান হয়ে নৌবাহিনী থেকে ফিরে এসেছিল পাসিং আউট প্যারেডের আগের দিন। একসময় দৈনিক প্রথম আলোর রম্য সাময়িকী ‘আলপিন’, ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিনের ‘খবর আছে’ এবং আমার দেশ পত্রিকার রম্য সাময়িকী ‘ভিমরুল’-এর সঙ্গে জড়িত ছিলাম আমি। কিশোর এই তিন পত্রিকার সাময়িকীতেই কার্টুন আঁকত। সাপ্তাহিক ২০০০ এবং যুগান্তরের ‘বিচ্ছু’-তেও ওর কিছু কার্টুন ছাপা হয়েছিল। ১৯৯৮ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত রম্য সাময়িকীর স্বর্ণযুগ ছিল এ দেশে। দেশের দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া, একসময়ের রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ইয়াজউদ্দীন আহমেদ, এমনকি মন্ত্রী থাকাকালীন জিল্লুর রহমানও কার্টুনের বিষয়বস্তু ছিলেন। অন্যান্য নেতা-মন্ত্রীর কথা বাদই দিলাম। সেসময় আমেরিকা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি কিংবা রাশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যের শেখরাও কার্টুনের বিষয়বস্তু ছিল। আমার গাইডলাইনে কিশোর যতদিন কার্টুন এঁকেছে, কোনো অসুবিধের মুখোমুখি হতে হয়নি তাকে। ২০০৫ সালে দেশের একমাত্র কার্টুন ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’ কার্টুনিস্টদের জন্য পদক প্রবর্তন করে এবং প্রথম এই ‘উন্মাদ’ পদক পেয়েছিল কিশোর। অনলাইন ম্যাগাজিনের জনপ্রিয়তা, ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ বা টুইটারে ফান বা কার্টুন ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকলে কৌতুক সাময়িকীগুলোর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। জীবনের প্রয়োজনে সেসময় কিশোরও অন্য চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছিল।

বাবা ও মায়ের পঞ্চাশতম বিয়ে বার্ষিকীর তিন দিন আগে ২০১০ সালে মা চলে যান না ফেরার দেশে। কিশোর বলতে থাকে সে নিঃস্ব হয়ে গেছে। মাকে কবর দেওয়ার আগ পর্যন্ত কিশোর মায়ের কফিন জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। খুলনার বাসা থেকে ঢাকায় চলে আসার আগে সে মায়ের সব স্মৃতি নিজের মনে করে নিয়ে এসেছিল। আমরা এখনো জানি না কিশোর মাকে পুরোপুরি নিয়ে যেতে পেরেছিল কি না। মায়ের মৃত্যু দিনে কিশোরকে বাসায় না পাওয়া গেলেও মায়ের কবরস্থানে পাওয়া যেত। আমরা কেউ জানি না কিশোর শেষমেশ মাকেও ধরে রাখতে পেরেছিল কি না। পারলে হয়ত কখনো তাকে জেলে যেতে হত না। কিশোর সবসময় স্বীকার করে যে, মেজাজ ছাড়া সে আর কিছু ধরে রাখতে পারে না। কী কারণে জানি না, এরপর থেকে ওর পেশাগত এবং পারিবারিক জীবনেও প্রভাব পড়তে থাকে। মা আর আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে নিজস্ব জীবনযাপনে যাওয়ার পর কিশোর কার্টুন আঁকার চেয়ে বিজ্ঞাপনী সংস্থার চাকরিতেই বেশি ঝুঁকে পরেছিল। বিজ্ঞাপনী সংস্থার চাকরিতে থাকাই হয়ত ভালো ছিল ওর জন্য। বিটপী, এশিয়াটিক, অ্যাডকম, মিডিয়াকম, প্রাণসহ সম্ভবত দেশের সবগুলো প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কিশোর কাজ করেছিল। কিন্তু কোনো চাকরিই তাকে বেধে রাখতে পারেনি। অস্থিরতা ভর করেছিল ওর জীবনে।

হুট করে একদিন তার মাথায় ভিন্ন চিন্তা আসে। প্রাণ কোম্পানির নিশ্চিত চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে কিশোর ফিরে যায় খুলনাতে। ছোট্ট বাচ্চাদের জন্য ভিন্নমাত্রার এক স্কুল খোলে, যার নাম ‘আঁকিবুঁকি স্কুল’। সেখানেও মন টিকল না কিশোরের। আমাদের বাড়িতে নিয়ে এল স্কুল। তারপর সেখান থেকেও একদিন চলে এল সে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ২০২০ সালের ৬ মে। কিশোর হয়ে গেল এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। হাতে গোণা দু-একজন ছাড়া কেউ জানল না কিশোর কোথায় কেমন আছে। ফেসবুক আর মোবাইল থেকে সে অনেককে ঝেড়ে ফেলল। একবার লিখল- বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপে রবিনসন ক্রুসো হয়ে বেঁচে থাকাই ভালো! আমরা জানতে পারিনি বিচ্ছিন্ন দ্বীপেও কিশোর ভালো ছিল কি না, কিংবা মায়ের সঙ্গে ওর কোনো অলৌকিক যোগাযোগ হয়েছিল কি না! একবার দেখা হয়েছিল রাস্তায়। জানাল আইসোলেশনে আছে, নিকেতনের কোনো এক জায়গায়। ওজন হারিয়েছে অনেক। বাইক অ্যাকসিডেন্টে হাতে আর চোয়ালে ফ্যাকচার হয়েছিল। কোনোক্রমেই জোড়া লাগছে না।

এরপর সেই ৬ মে ২০২০। সংবাদকর্মী এক ছোট ভাই জানাল কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমাদের হৃদয়ও কিশোরের হাতের মতো ভাঙ্গল, জোড়া লাগল না। এরপর খোঁজাখুঁজি। জানা গেল রমনা থানায় আছে। সেখানে গিয়ে জানা গেল আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আদালতে গিয়ে জানলাম কিশোরকে কেন্দ্রীয় কারাগারে (কেরানীগঞ্জ) নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন কাশিমপুরে আছে কিশোর। আমি বা আমাদের পরিবারের কেউ বুঝতে পারছি না কেন এমন হলো? কিশোর কেমন করে সরকারবিরোধী এক ষড়যন্ত্রের প্রধান অভিযুক্ত হয়ে গেল? ওর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মহামারি করোনাভাইরাস সম্পর্কে গুজব ছড়ানো, অপপ্রচার, বিভ্রান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার (ধারা ২১/২৫ (১) (খ) ৩১/৩৫, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮) অভিযোগ আনা হয়েছে।

ছোটকাল থেকে আমরা যে কিশোরকে চিনি, তার সঙ্গে এই অভিযুক্ত কিশোরকে মেলাতে পারছি না। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কখন, কোথায় কিশোর ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন এঁকেছিল? বরং ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সবসময় কিশোর জামায়াত, শিবির, বিএনপি ও জঙ্গিবাদবিরোধী কার্টুন এঁকেছে এবং সেসব কার্টুনের প্রদর্শনীও হয়েছে। শেখ রেহানা ও বেবী মওদুদের তত্ত্বাবধানে যে সাপ্তাহিক বিচিত্রা (২০০২ থেকে ২০০৫) বের হত, কিশোর সেখানে নিয়মিত কার্টুন আঁকত। সে শাহবাগ আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে কার্টুন প্রদর্শনীসহ আরও অনেক কর্মসূচিতে অংশ নিত কিশোর। আমরা এখনো বুঝতে পারছি না কিশোর কারও বা কোনো মহলের প্রতিহিংসার স্বীকার হচ্ছে কি না? করোনাভাইরাস নিয়ে সে যে কার্টুন এঁকেছে, তাতে সরকারের ভাবমূর্তি কতটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে? প্রতিদিনই সরকার সংশ্লিষ্ট অনেককে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল হচ্ছে, কার্টুন আঁকা হচ্ছে বা সমালোচনামূলক পোস্ট বা স্ট্যাটাস আপ করা হচ্ছে। যারা এসব করছেন তাদের সামনে কী একটা ‘গাইডলাইন’ বানানো হয়েছে কিশোরকে? গাইডলাইন বললাম এ কারণে যে, কেউ যেন আর কিশোর না হয়। সাধারণ মানুষ জেলের বাইরে খুব ভালো থাকুক।

চারটি বই বের হয়েছিল কিশোরের। এগুলো হচ্ছে- ভালোবাসার চারাগল্প (জাগৃতি প্রকাশনী, ২০০৬), কিশোর এর নির্বাচিত চুশীল কার্টুন (আমার প্রকাশনী, ২০১২), বাংলাদেশের কার্টুন, কার্টুনের বাংলাদেশ (শ্রাবণ প্রকাশনী, ২০১২ ও প্রিয়মুখ প্রকাশনী, ২০১৬) এবং দেয়ালের গল্প (প্রিয়মুখ প্রকাশনী, ২০১৬)।

কিশোর নিজেই এখন গল্প হয়ে গেছে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার ছায়াসঙ্গী হয়েছিল লেখক ও বাংলাদেশের প্রথম কুমির চাষের এন্টারপ্রেনার মুশতাক আহমেদ। মুশতাক জেলে মারা যাওয়ার পর নতুন ‘ট্রমা বা ভীতি’ যুক্ত হয়েছে কিশোরের জীবনে। হয়ত সে সাহস হারিয়েছে। কিশোরের মনে হচ্ছে, সে আর বাঁচবে না। মুশতাক মারা যাওয়ার পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি কিশোরের জন্য রিমান্ড আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ, যদিও সেটা নামঞ্জুর হয়েছে।

2.jpg
মেজো বোনের দুই সন্তান ও মা-বাবার সঙ্গে কিশোর এবং আহসান কবির। ছবি: সংগৃহীত

প্রথমেই বলেছি কিশোর সহজে কোনো কিছু শেষ করতে পারত না। অভিযোগের জীবন, মামলার জীবন আর জেলের জীবনও কিশোর শেষ করতে পারবে কি না জানি না।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: ২৮ ফেব্রুয়ারি ছিল মুক্তিযোদ্ধা গায়ক আজম খানের (পপ সম্রাট ও গুরু নামে অধিক পরিচিত) জন্মদিন। কিশোর আজম খানকে নিয়ে একাধিক কার্টুন এঁকেছিল এই উদ্দেশ্য নিয়ে যে, তাকে যেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়া হয়। মৃত্যুর পর আজম খান তা পেয়েছিলেন। পপ সম্রাটের বিখ্যাত গানের আদলে একজন আমাকে লিখেছিলেন- মা তার কাঁদে/মুশতাক মরে গেছে/হায় আমার বাংলাদেশ!

কিশোর চুরি করেনি, ডাকাতি মামলার আসামি না, ঋণখেলাপি না কিংবা সরকারি সম্পত্তি দখল করেনি। তবু তাকে জেল খাটতে হচ্ছে। কিশোরের কাছে যা ভালো লাগেনি, আঁকাআঁকির মাধ্যমে কিশোর সেটার প্রতিবাদ করেছে। দেশের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থেকেই কিশোর সেটা করেছে। ভালোবাসার জন্য এ পর্যন্ত অনেকের শাস্তি হয়েছে, ভবিষ্যতেও হয়ত হবে। ঘৃণা করার জন্য কারও কখনো শাস্তি হয়েছে কি না, আমার জানা নেই।

কিশোর আজও ঘৃণা করতে শিখল না। ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে ভয় পেত কিশোর। ক্ষমতা মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায়। সম্রাটদের ভাষা বোঝে না কলম! ক্ষমতার ভাষা বোঝার জন্য তরবারি লাগে! কিশোরের সেটা কখনো ছিল না। ঢালহীন তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার কিশোর।

তলোয়ারহীন কিশোরের জন্য গত দশ মাসে হাতে গোনা পাঁচ-ছয় জন ছাড়া আর কেউ এগিয়ে আসেনি। জেলখানায় কিশোরের দুঃখ সহ্য করতে পারেনি মুশতাক। জীবন দিয়ে সে হয়ত কিশোরের আগাম মুক্তির ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল। কিশোরের কথা লিখতে গিয়ে আমার চোখে জল আসেনি। মুশতাকের কথা ভেবে চোখের জল আর থামছে না।

ভেবেছিলাম লেখার শিরোনাম দেব কিশোর আমার ভাই। বদলে ফেললাম সিদ্ধান্ত। মুশতাক আমার ভাই।

একনজরে কিশোর

আহমেদ কবীর কিশোর

(প্রথম ‘উন্মাদ’ পদকপ্রাপ্ত কার্টুনিস্ট। ‘উন্মাদ’ বাংলাদেশের একমাত্র কার্টুন ম্যাগাজিন)

পিতা: এ কে এম মোজাম্মেল হক

মাতা: বেগম কোহিনুর হক

মাধ্যমিক পাশ করেছেন খুলনার খালিশপুরের ক্রিসেন্ট স্কুল থেকে।

উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন খুলনার বিএল কলেজ থেকে।

ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে।

এরপর যোগদান করেছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অফিসার ক্যাডেট পদে।

কার্টুন এঁকেছেন এবং কাজ করেছেন দৈনিক মানবজমিন’র রম্য সাময়িকী ‘খবর আছে’, প্রথম আলো’র রম্য সাময়িকী ‘আলপিন’ এবং আমার দেশ পত্রিকার রম্যসাময়িকী ‘ভিমরুল’-এ। দৈনিক যুগান্তরের ‘বিচ্ছু’-তেও কার্টুন এঁকেছেন।

স্বৈরাচার ও জামায়াত-শিবির-রাজাকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে কার্টুন প্রদর্শনীতেও অংশ নিয়েছেন। তার আঁকা কার্টুন নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও জামায়াত-শিবির-রাজাকারবিরোধী একাধিক প্রদর্শনী হয়েছে।

এশিয়াটিক, অ্যাডকম, মিডিয়াকম, প্রাণসহ একাধিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করেছেন।

এ পর্যন্ত চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে।

ভালোবাসার চারাগল্প: জাগৃতি প্রকাশনী, ২০০৬

কিশোর এর নির্বাচিত চুশীল কার্টুন: আমার প্রকাশনী, ২০১২

বাংলাদেশের কার্টুন, কার্টুনের বাংলাদেশ: শ্রাবণ প্রকাশনী, ২০১২ ও প্রিয়মুখ প্রকাশনী, ২০১৬

দেয়ালের গল্প: প্রিয়মুখ প্রকাশনী, ২০১৬

Comments