হিস না বুম?
হিসস!
শব্দ করে বাষ্প বেরিয়ে গেল। প্রেশার রেগুলেটর আটকে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেল আরো বাষ্প বেরিয়ে যাওয়ার পথ। পাত্রের ভেতরে ফের বাড়তে শুরু করল চাপ, পরবর্তী ‘হিস’ হওয়ার আগ পর্যন্ত। সাধারণ প্রক্রিয়ার চেয়ে কম সময়ে কম জ্বালানি খরচে এভাবে কয়েকবার ‘হিস’ শব্দের পর শেষ হল রান্না। ‘বায়ু চাপ’ সামলানোর এমন সাধারণ জ্ঞান ব্যবহার করেই ফরাসি পদার্থবিদ ডেনি পাপা সেই ১৬৭৯ সালে প্রেসার কুকার আবিস্কার করেন।
এই কয়েক শতাব্দীতে, প্রতিটি রান্নাঘরের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ হয়ে উঠেছে প্রেশার কুকার। ‘হিস’ করতে দেয়া হলে চমৎকার কাজ করবে। ‘হিস’ বন্ধ করে দেয়া হলে হয়ে উঠবে ভয়ংকর বোমা।
চাপ নিতে কেউ পছন্দ করে না। কিন্তু একে কেউ এড়াতেও পারে না। একজনের সফলতা ব্যর্থতা নির্ভর করে তার চাপ ব্যবস্থাপনার ক্ষমতার উপর। সেটা চাপ নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ ‘হিস’ এর মাধ্যমেও হতে পারে আবার হতে পারে বুম করে বিস্ফোরিত হওয়ার মধ্য দিয়েও। হিস শব্দটা শুনতে মধুর না হলেও একে সহ্য করুন আখেরে আপনারই ভালো হবে, এটি আপনাকে নিরাপদ রাখবে।
যে কোনো একটি পরিবারের কথাই ধরুন। আমার সেখানে কি মতে অমিল, অসন্তোষ, ভিন্নমত, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা নানা পরিস্থিতিতে মানুষের ভিন্ন আচরণ দেখতে পাই না? যে কোনো বিতর্কে আমরা তর্ক করি, লড়াই করি। সমস্যার সমাধানে পৌঁছাবার আগে আমরা সবাই মিলে এভাবেই ‘হিস’ করি।
বৃহৎ পরিসরে, একটি সমাজ কিংবা রাষ্ট্র অনেকটাই প্রেশার কুকারের মতো। একটি রাষ্ট্রের সব জনগোষ্ঠী সব কিছুতে একমত হবে- এটি একটি উদ্ভট চিন্তা। আমরা সবাই ভিন্ন, আমাদের মতামত, আকাঙ্ক্ষা ও প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন। দেশের ১৭ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ, বয়স, রাজনৈতিক বিশ্বাস, অর্থনৈতিক কাঠামো এবং চিন্তার। আমাদের সেসব ভাবনা প্রকাশের মৌলিক অধিকার আছে। সুতরাং ক্ষমতায় যারা আছেন, তারা সমালোচনা এবং ভিন্নমতকে স্বাভাবিকভাবে নেবেন এটাই প্রত্যাশা।
রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে উত্তেজনা গোলযোগ, মতবিরোধ আর অসন্তোষ তৈরি হবেই। রাষ্ট্র নামক সিল করা পাত্রটির ভেতর চাপ তৈরি হতে শুরু করে যা এক সময় প্রেশার রেগুলেটর খুলে দেয়, চাপটি ‘হিসস’ শব্দ করে বেরিয়ে যায়। এভাবেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভিন্নমতকে সমন্বয় করে। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েই সামনে এগিয়ে যায় এবং টিকে থাকে।
কিন্তু, যখন একনায়কতন্ত্র জেঁকে বসে কিংবা গণতন্ত্র সংকটে পড়ে, তখন এই ‘হিস’ করার প্রক্রিয়াটি বন্ধ হতে থাকে। গণতন্ত্রের ভগ্নদশা শুধু যে বাংলাদেশেরই সমস্যা তা নয়, যদি আমরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকাই, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রতি পরাজিত ডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাজ্যের বরিস জনসন, রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিন, তুরস্কে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়া, ব্রাজিলের জাইর বলসোনারো, চীনের শি জিনপিং, ফিলিপাইনের রদ্রিগো দুতের্তে, কম্বোডিয়ার হুন সেন কিংবা ভারতের নরেন্দ্র মোদিকে দেখতে পাব। এই সময়টি মুক্ত গণমাধ্যম কিংবা মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য মোটেই ভালো নয়।
ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে বসে থাকা মানুষদের কাছে ‘হিস’, অর্থাৎ ভিন্নমত একেবারেই সমাদৃত নয়। তারা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করে সব ধরনের মতবিরোধ স্তব্ধ করতে চান। নতুন আইন ও প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা আর ভাবমূর্তির অজুহাত দেখিয়ে তারা গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার টুঁটি চেপে ধরতে চান। আর এভাবেই তারা সাফল্যের সঙ্গে রাষ্ট্র নামক সুবিশাল প্রেশার কুকারটিকে যে কোনো সময় ফাটার জন্য একটি ‘বোমায়’ রূপান্তর করেন।
এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশের জায়গাগুলো ধীরে ধীরে সংকুচিত হচ্ছে, ‘হিস’ করার প্রক্রিয়াটির টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে। পথে কিংবা সংসদে সক্রিয় কোনো বিরোধী দল নেই। মানুষের ভেতর সৃষ্ট চাপা ক্ষোভের গল্প তুলে ধরার আগে, মুক্ত গণমাধ্যকে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানহানির আইন, ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, তথ্য লুকানোর অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা এবং উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার সার্বক্ষণিক ভীতিকে পেরিয়ে আসতে হয়। ঐতিহ্যগতভাবে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক কিংবা সামাজিক আন্দোলনগুলোর এখন আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। এককালের উদ্যমী সুশীল সমাজের অধিকাংশই এখন ক্ষমতাবান আর তাদের মোসাহেব-চাটুকারদের ধমক থেকে বাঁচতে নীরবতাকে বেছে নিয়েছেন।
তবে সত্য হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনো কিছু ‘হিস’ শোনা যায়। স্বাভাবিকভাবেই, সবচেয়ে জোরালো ‘হিস’গুলো শোনা যায় বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে নিরাপদে থাকা মানুষদের কাছ থেকে। বাংলাদেশে থাকা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা এতদিনে বুঝে গিয়েছেন যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাদের জামিন অযোগ্য কারাবাসের দিকে ঠেলে দিতে পারে। মুশতাক আহমেদের সাথে যা ঘটেছে চিরকালের জন্য তা তাদের স্মৃতিতে জ্বলতে থাকবে।
করোনা মহামারি মোকাবিলায় সরকারের কাজ নিয়ে কথা বলায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় দেশে কুমির নিয়ে কাজ করা একজন সফল উদ্যোক্তা ও পরে লেখক মুশতাক আহমেদকে, যিনি গেল বৃহস্পতিবার কারাগারে মারা যান। গত নয় মাস ধরে কারাগারে বসে জীবন সম্পর্কে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর এই মানুষটি হয়তো আশা করেছেন সরকার কিংবা বিচার বিভাগ তার স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারকে সম্মান জানাবে। যদিও ছয় ছয় বার তার জামিন আবেদন নাকচ করা হয়েছে।
ন্যায় বিচার কিংবা ভিন্নমত প্রকাশ সবকিছুর উর্ধ্বে এখন মুশতাক। মুশতাকের মতোই একই অভিযোগে গ্রেপ্তার কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর নির্যাতনের কারণে গুরুতর অসুস্থ। হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া সুস্থ সবল ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল, যিনি ৫৩ দিন নিখোঁজ এবং ২৩৭ দিন কারাভোগের পর এখন ভেঙে পড়া এক মানুষে পরিণত হয়েছেন।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি দিনের বেশিরভাগ সময় বিছানায় পড়ে থাকছেন, আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলার ন্যায় বিচারের আশায় তার পরিবারের বাকি সদস্যরা আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন।
এ ধরনের প্রতিটি অবিচার এবং ভিন্নমত প্রকাশকে চেপে ধরার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ নামক কুকারে… অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই তাকে ‘হিস’ করতে দিন।
সৈয়দ আশফাকুল হক: দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক
Comments