আপনায় নজর দিন, আয়নায় নয়
আয়নাহীন একটি দিন কল্পনা করুন তো!
কাজে বের হচ্ছেন। কিন্তু, আপনাকে আজ কেমন দেখাচ্ছে, জানেন না। ব্যস্ত রাস্তা ধরে অফিসের পথে ছুটছেন। জুজতে হচ্ছে দুঃসহ যানজটের সঙ্গে। কিন্তু, আপনার গাড়িতে পেছনে দেখার (রিয়ার-ভিউ) কোনো আয়না নেই। একটি মেয়ে সেজেগুজে বের হচ্ছে; বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু, এই সাজে তাকে কেমন লাগছে, জানে না। একজন দাঁতের ডাক্তার। রোগীর মুখের বেশ ভেতরে মাড়ি কাটছেন। দাঁতের রুট ক্যানেল করবেন। ভরসা নিজের চোখ; কিছু দেখা যায়, কিছু হয়তো দেখা যায় না। ফলাফল জানা: হয় হাসির খোরাক, না হয় বিপর্যয়!
আয়না ছাড়া জীবন প্রায় অসম্ভব। ছোট্ট এক টুকরো কাঁচ, সে-ই কিনা আমাদের সত্যিকারের বন্ধু হয়ে উঠেছে। আমাদের নিরাপদ রাখতে সহায়তা করছে, সব সময়। তার এই বন্ধুত্ব একতরফা। সে কেবল সত্য জানান দেয়। আর ঠিক কাজটি করে যায়। আয়নার কাছে আমাদের চাওয়া কেবল একটি প্রতিচ্ছবি। যাতে আমরা আমাদের বেশভূষা, পোশাক-আশাক, সাজগোজ আর নিজেদের যেভাবে উপস্থাপন করছি তার খুঁতগুলো ধরতে পারি। কোন ভুল শোধরাতে হবে, কীভাবে শোধরাতে হবে—আয়না সে ইঙ্গিত দেয়। যদি আমাদের কোনো ত্রুটি নাও থাকে, তবুও আমাদের আয়না লাগবে। সে আমাদের বলবে, ‘এগিয়ে যাও, ভালো থাকো।’ এই সময়ে, আয়নার অনুমোদন ছাড়া জনসমক্ষে আসার কথা ভাবতেও পারি না আমরা।
আয়নায় খুঁতগুলো দেখে আমরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাই? আমরা প্রতিচ্ছবিকে অস্বীকার করি না। সেখানে ভুলগুলো আমাদের চোখে পড়ে। আমরা তা শোধরাই। যতক্ষণ না আয়না আমাদের সঙ্গে একমত হয়, ততক্ষণ আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাই। দিন শেষে কেউই নিজেকে হাস্যাস্পদ করে তুলতে চায় না।
আয়নায় বিশ্বাস নেই কার? প্রতারণাপূর্ণ চিত্র দেখানোর জন্য আয়না বানানো হয়নি। এটা যেমন জিনিস তেমনই প্রতিফলন ঘটায়। এমনকি এই গ্রহের সবচেয়ে অসুন্দর মানুষটিও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে না যে, ‘না, এটা কোনোভাবেই আমি নই।’ এও বলে না যে, ‘আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে আয়না এমন ভুল প্রতিচ্ছবি দেখাচ্ছে!’ অবশ্য কিছু ত্রুটিপূর্ণ আয়না তো থাকতেই পারে; যেগুলো এবড়ো-থেবড়ো প্রতিচ্ছবি দেখায়। কিন্তু, কেউই সে আয়নাগুলো কিনতে চায় না। সবাই সত্যিকারের প্রতিচ্ছবিটাই দেখতে চায়।
আমরা কি কখনো আয়নাকে বলি, আমরা যে প্রতিচ্ছবি দেখতে চাই তা-ই আমাদের দেখাও। আয়না মনগড়া কিছু করতে অক্ষম। পাগল না হলে কেউ বলবেন না, ‘আয়না, আয়না, ভুল কর—সুন্দর দেখাও আমায়।’ কেউ চাইলে হয়তো আয়নায় গোলকধাঁধা তৈরি করতে পারে। তবে সেটাও খুবই অস্থায়ী, দৃষ্টিভ্রম মাত্র। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।
গণমাধ্যম সমাজে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। অনেক ক্ষেত্রে এর কাজও আয়নার মতোই। নানা উপায়ে সমাজের ভালো, মন্দ ও কুৎসিত দিকগুলো তুলে আনে। একটি মুক্ত গণমাধ্যম আয়নার মতোই নিখুঁত হতে চেষ্টা করে। দ্রুত ঠিক তথ্য দিয়ে মানুষকে সহায়তা করে। এটা খারাপের খোলস, মন্দের মুখোশ খুলে দেয়। সমাজের মিথ্যার স্তূপ থেকে সত্যকে তুলে আনে। খবরের পাশাপাশি গণমাধ্যম মতামতও দেয়। এতে জনমত তৈরি হয়। তা নীতিনির্ধারকদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হয়। নীতিমালা আর নৈতিকতার মানদণ্ড মানার পরও সাংবাদিকদের ভুল হতেই পারে। ভুল চিহ্নিত হলে বা ধরিয়ে দেওয়া হলে মুক্ত গণমাধ্যম দ্রুত তা শুধরে নেয়। আয়নার মতোই পরার্থে কাজ করা মুক্ত গণমাধ্যমের একমাত্র অভীষ্ট।
মানুষের জন্য মুক্ত গণমাধ্যম দরকার। দরকার সমাজের জন্যও। গণতন্ত্রের জন্য এটি প্রয়োজন। একইভাবে সরকারের জন্যও। যখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত আসে, গণতন্ত্র ধুঁকতে থাকে; তখন মুক্ত গণমাধ্যমে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু, ক্ষমতার বারান্দায় থাকা কুটিল রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিবাজ আর অপরাধীরা গণমাধ্যমের আয়নায় নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে চান না। আর সেই প্রতিচ্ছবি যদি কখনো বেরিয়ে পড়ে, তখন তারা জনসমক্ষে সেটা নিয়ে সন্দেহ ছড়ান। ক্রুদ্ধ হয়ে বলতে থাকে: ‘না, আমি এমনটা হতেই পারি না।’ তারা দাবি করে, ইচ্ছা করে তাদের এমনভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে যাতে সম্মানহানি হয়। নিজেদের ভুল সংশোধন করার বদলে তারা আয়না সারানোর চেষ্টা করে।
বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে। এভাবেই অপরাধ ও অসংগতি একে একে বেড়েছে। ততক্ষণ পর্যন্ত বেড়েছে যতক্ষণ না সরকার ক্ষমতা হারাচ্ছে। দুঃখের বিষয়—সরকার মুক্ত গণমাধ্যমে নিজেদের প্রতিচ্ছবিকে অস্বীকার করছে। আর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
আবার অভিনব কায়দায় নিজের পছন্দ মতো প্রতিচ্ছবি দেখানোর জন্য অসাধু নেতা, সরকারের ভেতরের অশুভ শক্তি এবং শীর্ষ দুর্নীতিবাজদেরও গণমাধ্যম-আয়না আছে। তবে ঠিক আয়নার মতোই, একটি মুক্ত গণমাধ্যমকে নিজেদের মতো ছাঁচে ফেলা যায় না। বড় জোর, কেউ একে ভেঙে ফেলতে পারে; দিন কাটাতে পারে আয়না ছাড়া। এর কারণে যে কতটা মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, সেটা যথাযথভাবে বলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠাতা জনক এবং তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন। ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতার যৌথ ঘোষণাপত্র অনুমোদন দেওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা নির্ভর করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর এবং স্বাধীনতা হারানোর আগ পর্যন্ত সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করা যাবে না।’
কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে এসে এখন মনে হচ্ছে, এই বিশ্ব জেফারসনের সেই নীতি থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর এখন ক্ষমতার অনুগত গণমাধ্যম এবং দুর্বল গণতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর দ্বিমুখী আক্রমণ চলছে।
ক্ষমতায় থাকা লোকেরা আজকাল ভিন্ন তরিকা নিয়েছে। তারা গণমাধ্যমের একটি অংশকে গোপন-মালিকানায় রাখছে অথবা নিপুণভাবে ব্যবহার করছে। আবার মুক্ত গণমাধ্যম এখনো তার নিজের অবস্থান খুঁজে পেতে এবং জনসমক্ষে তার দুর্বলতা স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত নয়। তারপরও বাস্তবতা হলো— গণমাধ্যম এখন দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। একটি অনুগত গণমাধ্যম, অন্যটি মুক্ত গণমাধ্যম। পৃথিবীজুড়েই অনুগত গণমাধ্যম বা ফ্রেন্ডলি মিডিয়া দিন দিন বাড়ছে। আর মুক্ত গণমাধ্যম বা ফ্রি মিডিয়া সংকুচিত হচ্ছে; যেমন হচ্ছে বাংলাদেশেও। অনুগত গণমাধ্যমের সাংবাদিক, নেতা ও সংগঠনগুলো ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করে চলে। তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে না। ইদানীং মুক্ত গণমাধ্যমের ওপর প্রথম আক্রমণটি আর কারও দিক থেকে নয়, এই অনুগত গণমাধ্যমগুলোর দিক থেকে আসছে। ক্ষমতায় আসীন নিজেদের মদদদাতাদের সন্তুষ্ট করতে তারা এটা করছে।
অনুগত-মিডিয়া এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ রাজত্ব করছে বলে মনে হতে পারে। সত্যিই কি তাই? আসলে নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে উপস্থাপিত চিত্রগুলো মানুষের কাছে ভিজ্যুয়াল বিকৃতির মতো। কারণ এই মানুষগুলো সঠিক তথ্যের জন্য স্বাধীন গণমাধ্যমের কাছেই ফিরে আসেন। স্বাধীন গণমাধ্যম হলো সেই আয়নাটি, যা তাদের প্রয়োজন। ‘স্তুতির স্বাধীনতা’ নয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাই গণমাধ্যমকে সেই আয়নায় পরিণত করতে পারে।
সৈয়দ আশফাকুল হক: নির্বাহী সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments