‘তোমার বাবা কেমন আছেন?’

kajol
ফটোসংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীতে নানা রকমের উত্থান-পতন সবসময় লেগেই আছে। এটাকে চিরন্তন সত্য মেনে নিয়েই আমাদের রোজকার জীবন রচনা করি।

সিরিয়াতে বোমা ফেলে ছোট এক শিশুর খুলি উড়িয়ে দেওয়া হলো। পৃথিবীর পরাশক্তিধরেরা হাসপাতালে বোমা ফেলল। আমরা সবাই অন্তর্জালে সে দৃশ্যের লাইভ ভিডিও দেখলাম। রোগীর দেহের অংশ বিশেষ সাদাটে ছাই রঙের ধূলায় নিস্তেজ পরে থাকতে দেখলাম। কোনটা হাতের আঙুল আর কোনটা পায়ের আলাদা করা গেল না।

পাকিস্তানের মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় কয়েক শ নামাজি নিহত। ধর্ষণের পর এক শিক্ষার্থীকে মেরে ফেলা হলো কলাবাগানে।

সমুদ্র সৈকতের ভেজা বালিতে যুদ্ধ থেকে পলায়নরত শরণার্থী শিশুর নিথর মৃতদহ উল্টো হয়ে পড়ে থাকতে দেখলাম। এর পরের মুহূর্তেই গায়ে হলুদের আয়োজনে হিন্দি গানের সঙ্গে নাচানাচি হলো। সাকরাইনে রং-বেরঙের ঘুড়ি উড়ানো হলো। আতশবাজির কেরামতি দেখা গেল।

শত চড়াই-উৎরাই চারদিকে ঘটছে অবিরত, তারপরও কোথাও না কোথাও  ঠিকঠাক সুন্দর  জীবন চলে। এসব বাস্তবতা নিয়ে ভালোই যাচ্ছিল আমাদের অনেকের সময়।

তারপর এলো ভয়ঙ্কর ২০২০ সাল। এতই ভয়ঙ্কর বছর যে বছরের  শুরুতেই সারা দুনিয়াতে আস্তে আস্তে তালা পড়ে গেল। এত বড় বড় ঘটনাও যখন পৃথিবীকে দুদণ্ডের জন্য থামিয়ে রাখতে পারল না, তখন দেখা যায় না-ছোঁয়া যায় না ভাইরাস তাবৎ পৃথিবীর বেশিরভাগ জীবন এক প্রকার থামিয়েই দিলো। গায়ে-হলুদের সংখ্যা কমে গেল আস্তে আস্তে। স্কুল-কলেজগুলো বন্ধ হয়ে গেল। স্বাভাবিক জীবন বলতে যে জীবন আমাদের জানা ছিল সেই জীবনের দেখা এক বছর পার হয়ে যাচ্ছে, তবুও ঠিক মিলছে না।

আশার সংবাদ এতটুকুই এখন পর্যন্ত এই যে ২০২১ সালের শুরুতেই ৫৪তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এই ভাইরাসের টিকা দেওয়া কর্মসূচি শুরু হয়েছে।

যে দেশগুলো টিকা উৎপাদনে সামনের সারিতে তাদের দেশের সরকার প্রধান ও রাজনীতিবিদেরা দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য নিজেরা প্রথমে টিকা নিয়েছেন সাধারণ জনগণকে টিকা নিয়ে নানা বিভ্রান্তিমূলক ধারণা থেকে স্বস্তি দিতে। কারণ, সাধারণ জনগণ সরকারকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেন না। সরকারের কর্মকাণ্ডকে বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না। তাই সরকার প্রধানদের আস্তিন গুটিয়ে টিভিতে প্রমাণ করতে হয় এই যাত্রায় যা বলা হচ্ছে তা সত্য।

‘এই যে দেখুন আমরা নিজেরাই নিচ্ছি! নিরাপদ না হলে কি আমরা নিতাম!’— সরকার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা পৃথিবীর ইতিহাসে এখন সবচেয়ে নিচের দিকে। সেদিক থেকে বাংলাদেশের ঘটনা পুরোপুরি উল্টো। সাধারণ মানুষের সরকার ব্যবস্থার ওপর  শতভাগ আস্থা আছে বলেই সরকার প্রধানরা বলতে পারেন, ‘আপনাদের সবাইকে টিকা দিয়ে তারপর আমরা টিকা নেব।’ টিকা নিয়ে বাংলাদেশে কারো কোন ভয়-ভীতি আছে না কি?

ঘটনা হলো— এই যে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘তোমার বাবা কেমন  আছেন? তুমি কেমন আছো? তোমরা কেমন আছো?’

২০২০ সালের ১০ মার্চ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া আমার বাবাকে দীর্ঘ নয় মাস পর জামিনের মাধ্যমে বাড়িতে পেলাম গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে। এক বছরের এই নানামুখী সংগ্রাম পুরো পৃথিবীকে কতকিছু নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। এই প্রায় এক বছরে পৃথিবী যেমন বদলে গেছে তেমনি বাবাও বদলে গেছেন অনেক দিক থেকে। মানি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলে যায়।

আমি যখন ‘হোয়ার ইজ কাজল?’ মুভমেন্ট শুরু করি তখন আমার বাবা কাজলকে ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। হাইকোর্টে মামলা ওঠার মাস দেড়েক পর বাবা জামিন পান। সম্ভবত পোস্ট-ট্রমাটিক ডিজঅর্ডারের কারণে সাধারণ স্বভাবগত চারিত্রিক বৈশিষ্টের যে বিচ্যুতি ঘটে থাকে, তখন ঠিক তাকে আগের মানুষ হিসেবে গণ্য করা যাবে?

আমরা হয়ত আগের জীবন কখনোই ফিরে পাব না। আমার বাবাও সহজে অথবা আদৌ কোনদিন তার পুরনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ফিরে যেতে পারবেন কি না জানি না।

বাবা আগে কখনোই গেইম খেলতেন না। এখন মোবাইলে বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা গেইম খেলেন। তাকে জরুরি কোনো মিটিংয়ে বসে গেইমের নেশায় বুদ হয়ে থাকতে দেখি।

যখন অনেকের কথাই হলো যে, ভাই ‘আলহামদুলিল্লাহ!’ তোমার বাবাকে জীবিত ফেরত পেয়েছ সেটাই তো অনেক! অনেককে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়! অথবা কখনোই ফেরত পান না। শুকরিয়া আদায় করো।

সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিটের হেজ ফান্ডওয়ালাদের ধান্ধাবাজিতে  বিরক্ত এক বন্ধু খুব রেগে আছে, কারণ তাদের ভাওতাবাজিতে সে তার ঊর্ধগতির শেয়ারগুলো বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে এবং নতুন কোনো শেয়ারও সহজে কেনা যাচ্ছে না। তা না হলে সে হয়তো এখন জীবনের প্রথম  মিলিয়নিয়ার হতে পারতো।

আমার আমেরিকান বন্ধু প্রতিদিন আট ঘণ্টা করে একটা ডেলিভারি অ্যাপের মাধ্যমে খাবার সরবারাহ করে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত। লাস ভেগাসের মতো শহরে থেকে নূন্যতম বেতনে দিনের পর দিন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে খাবার পোঁছে দেওয়া চারটিখানি কথা নয়! একঘেয়েমির চূড়ান্ত! যদিও তার শেয়ারগুলো বিক্রি করে দেওয়ার আগে মূলধন তিনগুণ হয়েছে দুই সপ্তাহেই।

তাই শুনে বললাম, ‘থাক, তাহলে আর রাগ করে থাকার দরকার কি? লাভতো কম হলো না!’ আমার বন্ধু  কিছুক্ষণ ভেবে  বললো, ‘জানো পলক, এটাই ওরা চায়, যা পেয়েছি তাতেই যেন  সন্তুষ্ট থাকি। এর থেকে বেশি পাওয়ার যোগ্যতা থাকলেও তা না পেলে  রাগ করার কোনো দরকার নেই। আমি শত শত ঘণ্টা ব্যয় করেছি এই বিষয়ে দক্ষ হতে। তাই এই দুর্নীতি আমি মেনে নিতে পারছি না! কেনো ওরা বছরের পর বছর দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাবে? আমি কত পেয়েছি এটা তো কথা নয়। কথা হলো, আমার মতো লাখো মানুষের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। অন্যায়ের ফলে আমার তাবৎ লোকসান হয়েছে। ওরা যদি ওদের অদৃশ্য হাতে আমার গলা চেপে না ধরতো আমি এখন এই মুহূর্তেই মিলিয়নিয়ার হয়ে যেতাম।’

একটু ভেবে বললাম, ‘তুমি ঠিক কথাই বলছো বন্ধু! যা পেয়েছি তাতেই যদি চিরকাল সন্তুষ্ট থাকি তাহলে তো এই সমাজের নানা গাঁথুনিতে ঘুন পোকাদের রাজত্ব চলতেই থাকবে।’

আমার বন্ধু নিশ্চিত ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা আছে জেনেও এই মুহূর্ত পর্যন্ত তার সর্বোচ্চ পুঁজি নিয়ে নেমে পড়েছে এই সমূহ যুদ্ধে। সংবাদ দেখে জানলাম এখন পর্যন্ত আমার বন্ধুর মতো যারা তারা জিতেই চলছে এই ডেভিড-গোলিয়াতের যুদ্ধে।

আপনারা ঠিকই ভাবছেন, বাবা বেঁচে আছেন— এর চেয়ে সুখের বিষয় আর কী হতে পারে? আমাদের সঙ্গে আছেন, দু-পায়ে হাঁটছেন, মুখ দিয়ে কথা বলছেন, তার মোটা আঙ্গুল দিয়ে সাদা ভাতে গরুর মাংসের লাল ঝোল মেখে খাচ্ছেন। তার হাতে এখন অখণ্ড অবসর সময়। জীবনের সঙ্গে লেনদেনে তার যে হিসাব তাতে বিরাট গড়মিল হয়ে গেল সেইটা কি কোনো হিসাবে তোলা যাবে না? আমার বাবা এখন করবেনটা কি?

বিনা বিচারে টানা ছয় মাসের ওপর হাজতবাস, ৫৩ দিন কবর-তুল্য অভিজ্ঞতার পর ভঙ্গুর দৈহিক-মানুষিক স্বাস্থ্য ও পরিবর্তিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমার বাবাও হয়তো ভালোই আছেন। মনের মধ্যে ট্রমার ঝড় নিয়ে হয়ত বাহ্যিকভাবে দেখতে ভালোই আছেন।

আমার মুভমেন্টের এক পর্যায়ে যখন বুঝতে পারি হাইকোর্টে না যাওয়া পর্যন্ত এই জুলুমের অবসান হবে না, জুলুম চলতেই থাকবে। তখন আমি আমার মুভেমন্টটাকে একেবারে মেরে ফেলি।

আপনারা অনেকই হয়েতা একমত পোষণ করবেন যে নানা কারণেই এই মুভমেন্ট অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। তাই আমি এই কথাটি বলে দিতে চাই যে আমার মুভমেন্টটি নানাভাবেই ব্যর্থ এবং মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত।

আমার রক্ত-মাংসের বাবাকে ফেরত পেয়েছি। কিন্তু, কাজল কোথায় ছিলেন সেই প্রশ্নের উত্তর পাইনি। বাবার দিকে তাকিয়ে ভাবি বাবাকে কি আসলেই ফেরত পেয়েছি? নিয়মিত কোর্টে হাজিরা দেওয়ার মতো বিষয়তো লেগেই আছে। আমাদের সঙ্গে অন্যায়ের কোনো বিচার হবে না। জলজ্যান্ত মানুষটাকে দেখি হাসতে পারেন, কাঁদতে পারেন; কিন্তু, আগের মতো আর ভাবতে পারেন না!

আমি এখনো আমার বাবাকে ফেরত চাই। মনে হচ্ছে, বহুদিন বাবাকে ফেরত চেয়ে যেতে হবে। ততদিন পর্যন্ত আপনারা যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার বাবা কেমন আছেন?’— আমি আসলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উত্তর খুঁজে পাই না।

জেল অথবা গুম অবস্থায় থাকাকালে বাবার করোনা হলো কি না জানি না। তবে, আশা করি বাবা হয়তো অচিরেই টিকা নিবেন।

মনোরম পলক, সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের ছেলে

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
road accidents death in Bangladesh April

Road accidents killed 583 in April: Jatri Kalyan Samity

Bangladesh Jatri Kalyan Samity (BJKS), a passenger welfare platform, said that a total of 583 people were killed and 1,202 injured in 567 road accidents across the country in the month of April, citing media reports

6h ago