যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের ‘কালো দিন’
নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই ভোট জালিয়াতি ও ষড়যন্ত্রের কথা বলে আসছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। একাধিকবার তিনি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না বলেও জানিয়েছিলেন। ৩ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে হারার পরেও আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। তার আইনি লড়াইয়ের প্রতিটি প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।
তবুও হোয়াইট হাউস ছাড়তে রাজি নন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরিকল্পনা ছিল, ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া ও নির্বাচনী ফল পাল্টে দেওয়া। কংগ্রেসের অধিবেশনে ইলেকটোরাল কলেজের ভোট প্রত্যাখ্যানের জন্য কংগ্রেস সদস্যের রাজি করানো নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন ট্রাম্প। সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান থাকায় এ নিয়ে আশাবাদীও ছিলেন তিনি।
কিন্তু, অধিবেশনের এক দিন আগেই জর্জিয়ার সিনেট নির্বাচনে দুটি আসন জিতে নেয় ডেমোক্র্যাটরা। এর ফলে কংগ্রেসের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টি পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেরই নিয়ন্ত্রণ পান।
ট্রাম্পের ইচ্ছা ছিল, সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান দলের প্রার্থীরা জয়ী হয়ে যেন বাইডেনের কর্মসূচিগুলো আটকাতে পারেন। সিনেট নির্বাচনে পরাজয়ের পর আবারও তিনি টুইটারে ভোট জালিয়াতির দাবি করেন।
বুধবার কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনের দিনে কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে হামলা চালিয়েছে ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকরা। এদিন কয়েক শ সমর্থক অস্ত্র-শস্ত্রসহ পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরে ঢুকে হামলা চালায়। দিনটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স।
বিবিসি জানিয়েছে, সহিংসতায় আগে হোয়াইট হাউসের কাছে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্যে দেন ট্রাম্প। ‘সেভ আমেরিকা মার্চ’ নামের ওই র্যালিতে ট্রাম্প জানান, তিনি কখনোই পরাজয় মেনে নেবেন না।
সমর্থকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমরা ক্যাপিটাল হিলে যাবো। আমাদের সাহসী কংগ্রেসম্যান এবং ওম্যানদের উৎসাহ দেবো। তবে, আমরা তাদের মধ্যে কয়েকজনকে খুব বেশি উৎসাহ দেবো না। কারণ আপনি কখনোই আমাদের দেশকে দুর্বলতা দিয়ে ফিরিয়ে নিতে পারবেন না। এজন্য আপনাকে শক্তি দেখাতে হবে ও শক্তিশালী হতে হবে।’
এদিন র্যালিতে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজন সমর্থক বিবিসিকে জানান, ট্রাম্পের ডাকে সাড়া দিয়েই তারা নির্বাচনে কারচুপি ও এর সার্টিফিকেশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ক্যাপিটলে গিয়েছিলেন।
হামলার কয়েক মিনিট আগে এক ট্রাম্প-সমর্থক বিবিসির ক্যামেরায় বলেন, ‘আমরা এখানে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছি। আমরা সহিংস হবো না। কিন্তু, কেউ যদি আক্রমণ চালায় তবে প্রতিরোধ করব।’
এর কিছু সময় পরেই কয়েক শ উগ্র ট্রাম্প-সমর্থক ক্যাপিটল ভবনে নিরাপত্তা ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। এক পর্যায়ে কংগ্রেসের অধিবেশন চলার মধ্যেই পুলিশের বাধা ভেঙে তারা পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়েন।
বিশৃঙ্খলার মধ্যে প্রতিনিধি পরিষদের (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস) সদস্যদের পাহারা দিয়ে অধিবেশন কক্ষ থেকে বের করে পুলিশ।
সিনেট অধিবেশন স্থগিত করা হয়। যৌথ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করা ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকেও পাহারা দিয়ে অধিবেশন কক্ষ থেকে বের করে পুলিশ।
এক পর্যায়ে কয়েক শ উগ্র সমর্থক দরজায় সজোরে আঘাত করে পার্লামেন্টের ভেতরে ঢোকে। এসময় কয়েকজনের হাতে অস্ত্র-শস্ত্রও দেখা যায়। পুলিশের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষের এক পর্যায়ে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ও জলকামান ছোড়া হয়।
মার্কিন গণমাধ্যমে প্রচারিত বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, পার্লামেন্টের ভেতরে ঢুকে সমর্থকরা বিশৃঙ্খলা চালিয়েছেন। স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির অফিসেও তারা ঢুকে পড়েন। ভিডিওতে তার আসনে একজনকে বসে থাকতে গেছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১২ ঘণ্টার কারফিউ ঘোষণা করেন।
বিবিসির সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, বুধবার ক্যাপিটাল হিলের সংঘর্ষে চার জন নিহত হয়েছেন।
এফবিআই জানিয়েছে, বুধবার সংঘর্ষের সময় সন্দেহভাজন দুটি বিস্ফোরক ডিভাইস উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে, প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের এমন আচরণে বিস্ময় ও বিরক্তি জানিয়েছেন নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
এক ভিডিওবার্তায় তিনি বলেন, ‘আমি বিস্মিত, স্তম্ভিত। নির্বাচনে জয় পরাজয় থাকবেই। দাবি বা ভিন্নমতও থাকতে পারে। তাই বলে এমন ঘটনা ঘটে কী করে?’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা ভিন্ন মত প্রকাশ নয়, এটা আইন হাতে তুলে নেওয়া। এটা বিশৃঙ্খলা। এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে এবং এখনই এটা শেষ হতে হবে। আমি আন্দোলনকারীদের ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানচ্ছি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজকে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানাই।’
ট্রাম্পের সমর্থকদের এমন আচরণকে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ইতিহাসে ‘নজিরবিহীন হামলা’ বলে উল্লেখ করে তিনি হামলাকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘মনে রাখা উচিত এটা আমেরিকা। এখানে এ ধরনের আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না।’
এসময় তিনি সরাসরি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।
অন্যদিকে হামলার পরে টুইটে ও পরে ভিডিওবার্তা দিয়ে সমর্থকদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানান ট্রাম্প। ভিডিওবার্তায় সমর্থকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনাদের এখন বাড়ি ফিরতে হবে, আমাদের শান্ত থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আপনাদের ভালোবাসি। আপনারা খুব অসাধারণ।’
উত্তেজনা ছড়ানোর আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটার অ্যাকাউন্টটি ১২ ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দিয়েছে টুইটার কর্তৃপক্ষ। টুইটার কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে বুধবার সন্ধ্যায় (বাংলাদেশ সময় ভোরে) এ তথ্য জানিয়েছে।
টুইটারের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘@রিয়েলডোনাল্ড ট্রাম্প’ অ্যাকাউন্ট থেকে আজ (বুধবার) করা পর পর তিনটি টুইট সামাজিকভাবে প্রবর্তিত নীতিমালা ভঙ্গ করেছে। প্রথমবার এ ঘটনা ঘটায় তাকে সতর্ক করা হচ্ছে। এই অ্যাকাউন্টটি ১২ ঘণ্টার জন্য বন্ধ থাকবে ও ওই টুইটগুলো অপসারণ করতে হবে। যদি অপসারণ না করা হয়, তাহলে অ্যাকাউন্টটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকও ডোনাল্ড ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট ২৪ ঘণ্টার জন্য বন্ধ করেছে। ইউটিউব থেকেও ভিডিওটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
কংগ্রেসের ভবন ক্যাপিটলে ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ব নেতারা। এ ঘটনায় ‘বিস্মিত ও স্তব্ধ’ হওয়ার প্রতিক্রিয়ার কথা জানিয়েছেন তারা।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার আইনজীবী রুডি জুলিয়ানির উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণেই এই হামলার ঘটনা ঘটেছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোর সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ক্যাপিটল হিলে প্রায় তিন ঘণ্টারও বেশি সময় পর পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর সিনেটে অধিবেশন শুরু হয়েছে। তবে, এখনো ট্রাম্প সমর্থকদের অনেকেই ভবনের বাইরে পতাকা হাতে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছেন।
আরও পড়ুন:
ট্রাম্পকে ব্লক করল ফেসবুক-টুইটার
যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ইতিহাসে ‘নজিরবিহীন হামলা’: বাইডেন
ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা: ফার্স্ট লেডির চিফ অব স্টাফের পদত্যাগ
ছবিতে কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলে ট্রাম্প-সমর্থকদের হামলা
নিহত ৪: ওয়াশিংটনের কংগ্রেস ভবনে ট্রাম্প-সমর্থকদের হামলা
ট্রাম্প-সমর্থকদের হামলা: পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, সিনেট অধিবেশন আবার শুরু
ওয়াশিংটনের কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলে ট্রাম্প-সমর্থকদের হামলা, নিহত ১
Comments