ভ্যাকসিন নেওয়ার অভিজ্ঞতা

টেক্সাসে ভ্যাকসিন দেওয়া কর্মসূচি। ছবি: সংগৃহীত

ভ্যাকসিন নিয়ে কত কথা কত আশা— পুরো একটা বছরের ওপর চলে গেল। বিভিন্ন ভ্যাকসিনের কথা শোনা যাচ্ছে। এসব নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। এর মধ্যে ফাইজার, মর্ডানা ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন সবচেয়ে আলোচিত। এই তিনটি ভ্যাকসিন এখন ইউরোপ ও আমেরিকাতে জরুরি ভিত্তিতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে এটা রেকর্ড বলা যেতে পারে। একটা ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিরূপণ করতে বছরের পর বছর লেগে যায়। মহামারির কারণে বলা যেতে পারে দ্রুত গতিতে ভ্যাকসিনগুলোর অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।

ফাইজার-বায়োএনটেক ও মর্ডানার ভ্যাকসিন এমআরএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন এডেনো ভাইরাস ভাইরাল ভেক্টর ব্যবহার করেছে করোনার স্পাইক প্রোটিনের জিনটি মানবদেহে প্রবেশ করিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরির জন্যে। এছাড়া, এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও অনেক কোম্পানি ভ্যাকসিন তৈরি করছে।

কনভেনশনাল প্রযুক্তি, যেমন নিষ্ক্রিয় ভাইরাস ব্যবহার করে চীনা কোম্পানি তৈরি করেছে সিনোভ্যাক। সম্পূর্ণ নিরাপত্তার ডাটা নিশ্চিত না হলে এ ধরনের ভ্যাকসিন বাজারে এতো সহজে গ্রহণযোগ্য হবে না।

এই তিনটি আলোচিত ভ্যাকসিনের মধ্যে ফাইজার ও মর্ডানার ভ্যাকসিন এখন আমেরিকাতে দেওয়া হচ্ছে। ফাইজারের ভ্যাকসিনটি ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড নিম্ন তাপমাত্রায় রাখতে হয়। মর্ডানারটি রাখতে হয় ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড নিম্ন তাপমাত্রায়।

অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি দুই থেকে আট ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে রাখতে হবে।

সংরক্ষণের কথা চিন্তা করলে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি খুবই উপযোগী। কেননা, ৮০ ডিগ্রি নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা বেশকিছু নির্দিষ্ট ফ্যাসিলিটি ছাড়া সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ সরকার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি করেছে। উন্নত দেশগুলো ভ্যাকসিন তৈরি করছে। কাজেই তারা নিজেদের নাগরিকদের ভ্যাকসিন দিয়ে তারপর অন্য দেশে ভ্যাকসিন পাঠাবে সেটাই স্বাভাবিক।

উন্নয়নশীল ও গরিব দেশগুলোর হয়তো ভ্যাকসিন পেতে দেরি হতে পারে, তবে তা সবার কাছে পৌঁছে যাবে নিশ্চিত। বাংলাদেশ সরকার ৩ কোটি ডোজের জন্যে আগে থেকেই চুক্তি করে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে।

ভ্যাকসিন নিয়ে যেহেতু উন্নত বিশ্বেই চলছে কাড়াকাড়ি, সেহেতু অপেক্ষা করতেই হবে। এ বছরের মাঝামাঝি জানা যাবে এই ভ্যাকসিন যু্দ্ধের অগ্রগতি।

আমেরিকায় মর্ডানা ও ফাইজারের ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। টেক্সাসে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। প্রাথমিকভাবে প্রথম ধাপে স্বাস্থ্যকর্মী, জরুরি চিকিৎসায় নিয়োজিত ব্যক্তি অথবা বয়স্ক যারা নার্সিং হোমে আছেন তাদেরকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।

এরপর, দ্বিতীয় ধাপে যাদের স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে বা করোনার সংক্রমণ হলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি হতে পারে— তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে।

আমার যেহেতু শর্করা জনিত সমস্যা আছে কাজেই আমার মনে হলো আমি হয়ত পেতেও পারি। দেখলাম, আমার কাউন্টিতে বেশ কয়েকটি ফার্মেসি থেকে শুরু করে সরকারি স্বাস্থ্য অফিসে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। আমাদের কাউন্টিতে ভ্যাকসিনের জন্যে সরকারি স্বাস্থ্য অফিসের ওয়েবসাইটে গিয়ে সাইনআপ করলাম। বিভিন্ন পেশার তালিকায় আমার শিক্ষা পেশা পেয়ে গেলাম। এছাড়া, শর্করাজনিত শারীরিক সমস্যার কথা নির্বাচন করলাম।

পরের দিন আমাকে ইমেলে জানাল, একটা বিস্তারিত ফরম পূরণ করতে হবে। ওটা পূরণ করে পাঠানোর দুদিন পর দেখলাম আমার সেল ফোনে মেসেজ। আমাকে রোববার দুপুরে সরকারি স্বাস্থ্য অফিসে যেতে হবে। আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল দুপুর ১টা থেকে ২টার মধ্যে।

সরকারি স্বাস্থ্য অফিসে গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড। লাইন প্রায় এক মাইল লম্বা। আমি ভাবলাম, অ্যাপয়েন্টমেন্ট অনুযায়ী আগে ঢুকতে পারবো কি না। আরেকটা অপশন ছিল, এই সময় কাজ না করলে ৯টা থেকে ৫টার মধ্যে আসতে পারবো। আমার মনে হয়, সবাই এটা করেছে।

যাই হোক, দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকতে পারলাম। ভাগ্য ভালো ওদিন ঠান্ডা অতো না থাকায় তেমন অসুবিধা হয়নি।

ভেতরে সিস্টেমটা খুব চমৎকার। অনেকগুলো রেজিস্ট্রেশন চেক করার লাইনের পর অনেকগুলো স্টেশন ছিল ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্যে। একজনের ভ্যাকসিন দেওয়া শেষ হওয়ার পর পরিচ্ছন্নকর্মীরা দ্রুত চেয়ার মুছে দিচ্ছেন। যাওয়ার আগে ভেবেছিলাম হয়তো ফাইজার ও মর্ডানা দুটোর মধ্যে একটা নির্বাচন করা যাবে। জিজ্ঞেস করতে বলল, এখানে সব মর্ডানার ভ্যাকসিন।

ভ্যাকসিন দেওয়ার পর আরেকটা স্টেশনে গিয়ে ১৫ মিনিট বসতে হলো। অনেকের অ্যালার্জির সমস্যা হচ্ছে, তাই এই ব্যবস্থা। বিশ মিনিটের মতো বসে চলে আসলাম। দ্বিতীয় ডোজের জন্যে এক মাস পর আবার যেতে হবে।

ভ্যাকসিন নেওয়ার পুরো ব্যাপারটা বেশ সহজ ছিল। কিন্তু, এতো মানুষের সঙ্গে লাইনে দাঁড়ানোর বিষয়টি নিয়ে মনের মধ্যে একটু খচখচ করছিল। যদিও সবাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, তবুও।

গাড়িতে আমার বাসা ২০ মিনিটের পথ। বাসায় এসে ছোট ঘুম দিলাম।

ভ্যাকসিন দিলে প্রথমে হাতে একটু ব্যথা হয়। এছাড়া, তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। বলেছিল, দুই-একদিনের মধ্যে হালকা জ্বর আসতে পারে। পরের দিন হাতে ব্যথা ও একটু জ্বরজ্বর ভাব লেগেছে। এখনো আছে। যা হোক, দুই-একদিন পর আরও ভালোভাবে তা বোঝা যাবে।

এই ভ্যাকসিনগুলো নিরাপদ। এদের ক্লিনিক্যাল ডাটা ভালো— ৯৫ শতাংশ কার্যকর।

ভ্যাকসিন দিয়ে এই মহামারি সমস্যার সমাধান হবে কি না তা আমি জানি না। যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন তাদের পরবর্তীতে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হারের ওপর বলা যাবে বড় স্কেলে এই ভ্যাকসিনগুলো কতটুকু কার্যকরী। ভবিষ্যৎ-ই এটা বলতে পারবে।

যত শিগগির সারা পৃথিবীর মানুষ এই ভ্যাকসিনটি পায় ততই মঙ্গল।

পৃথিবীটা আবার স্বাভাবিক হোক। আমরা এই মৃত্যু-উপত্যকা থেকে বের হতে চাই। আমাদের বাচ্চারা ব্যাগ কাঁধে আবার স্কুলে যাক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর হোক। আমরা যেন মুক্তভাবে শ্বাস নিয়ে আগের মতো আবার এই পৃথিবীতে হাঁটতে পারি।

সাইফুল মাহমুদ চৌধুরী: ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট আর্লিংটন রসায়ন ও প্রাণ রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক, ডালাস, টেক্সাস

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।) 

Comments

The Daily Star  | English

Interest payments, subsidies soak up almost half of budget

Interest payments and subsidies have absorbed nearly half of Bangladesh’s total budget expenditure in the first seven months of the current fiscal year, underscoring growing fiscal stress and raising concerns over public finances.

3h ago