‘ভয় হতে তব অভয়মাঝে, নূতন জনম দাও হে’
২০২০, বছরটি কেমন গেল? কেমন গেল, নাকি বছরটি গেল এই ভাবনায় আমাদের স্বস্তিবোধ বেশি হচ্ছে।
‘স্মৃতির ছবি মিলাবে যবে,
ব্যথার তাপ কিছু তো রবে’
‘কিছু নয়’, ব্যথার তাপ ভালোভাবেই অনুভূত হবে, যখনই আমরা পেছনে ফিরে দেখব এ বছরটিকে। ‘মৃত্যু’ আর ‘অনিশ্চয়তা’ এ শব্দযুগল যেন নতুন অর্থ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছিল ফেলে আসা এই বছরটিতে। এমনিতেই প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল, তার মধ্যে আমাদের খেলাধুলার জগতের আপনজন দিয়েগো ম্যারাডোনাসহ আরও অনেকের মৃত্যু বছরটিকে বিষণ্ণ ও বিষাদময় করে তুলেছিল ক্রীড়ামোদী মানুষের জন্য।
এমন এক অভাবনীয় দুর্যোগের মধ্যে, খেলাধুলার জগতের মানুষের জন্য, বছর শেষে সবচেয়ে বড় স্বস্তির জায়গাটি হয়তো ছিল; আচমকা থমকে যাওয়া খেলাধুলোর মাঠে ফিরে আসা। আর ফিরে এসেছে সে ‘বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা’ নিয়ে।
মানুষের সহজ সরল ছন্দের যে জীবন, সে জীবনে খেলাধুলার যে কী ভূমিকা, তা যেন আবার নতুন করে উপলব্ধি হলো।
পূর্ণ সুধা নিয়ে হয়তো নয়। মানুষ যে এখনও তার সহজ স্ফূর্তিতে মাঠে ফিরতে পারছে না... তবুও খেলাধুলার মাঠে ফিরে আসা মহামারির বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়েরই এক দিকচিহ্ন এঁকে দিলো। যেমন অভাবনীয় এই মহামারি, তেমনি অভাবনীয় খেলাধুলার এই মাঠে ফিরে আসা। সব রকমের উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সহজ ছিল না এই ফিরে আসা। কারণ, ‘ত্রুটি ঘটলে যে তার পূর্ণমূল্য শোধ হবে বিনাশে’ এই ভাবনা ও ভয়কে অতিক্রম করেই যে যাত্রার শুরু!
মানুষের জীবন আগে, এ কথাটির চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। আর সেকারণেই ঝুঁকির প্রশ্নটি সবসময় উচ্চারিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আমরা এখানে স্মরণ করতে পারি, কীভাবে জোকোভিচের ‘কাণ্ডজ্ঞান’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল তার ‘ঢিলেঢালা’ভাবে আয়োজন করা টুর্নামেন্টটিকে নিয়ে।
মফস্বল শহরের হাজারো মানুষের মাঠে উপস্থিতি এখনও আমাদের উদ্বেলিত করে না, উদ্বিগ্ন করে।
পূর্ণ ঝুঁকিতে এখনও আছি আমরা, কিন্তু পথের একটা দিশা যে খুঁজে পাওয়া গেছে, তাতেই আমাদের কিছুটা স্বস্তি। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই, এ মন্ত্রটিরই যেন প্রতিফলন দেখতে পেলাম আমরা খেলাধুলার এই ফিরে আসায়। এ যেন অসম্ভবকে সম্ভব করারই এক নতুন গল্প।
মার্চ-এপ্রিলের সে সময়টাকে নিয়ে ভাবলে, খেলাধুলার এই ফিরে আসাকে যদি অবিশ্বাস্য কিছু মনে হয়, তাতে দোষের কিছু নেই। অকস্মাৎ যখন খেলাধুলা সব বন্ধ হয়ে গেল, আর একে একে সব বড় ক্রীড়া আসর স্থগিত হতে থাকল; সবাই তখন দিশেহারা। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি ছিল, কবে মাঠে ফিরবে খেলাধুলা? শিগগিরই কি সম্ভব?
খেলাপাগল মানুষদের কাছে দিনগুলো, রাতগুলো যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগল। যাদের স্বপ্ন, সাধ, ভালোবাসা সবই খেলাধুলোকে ঘিরে, তাদের জন্য যে কী দুঃসহ ছিল সেই রাতগুলো, দিনগুলো!
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে সবাই একটু দমবন্ধ অবস্থা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছিল বটে, কিন্তু ওই যে বলে না, বেশি বেশি স্মৃতিকথন জরারই লক্ষণ! ব্যাপারটি যেন ধীরে ধীরে এমনই হতে থাকে। একটু পানসে হয়ে যাচ্ছিল সবকিছু।
প্রাণময় বর্তমান, আর আশাবাদী ভবিষ্যতের ইঙ্গিত না থাকলে, স্মৃতি রোমন্থন যে একঘেয়ে হয়ে যায়, আমরা যেন সেই অভিজ্ঞতার মধ্যেই পড়ে গিয়েছিলাম ওই ক’টি মাস। আর সেকারণেই একজন প্রাক্তন ক্রিকেট তারকার আক্ষেপ ছিল এরকম, ‘পুরনো কথা বলতে কার না ভালো লাগে বলেন! কিন্তু এখন আর ওই কথাগুলো ভালো লাগছে না, কেমন বিরক্ত লাগছে।’
যাক, জীবন যেমন থমকে থাকেনি, তেমনি শেষ পর্যন্ত ক্রীড়াঙ্গনও থমকে থাকেনি। এ তো সত্যি কথা, পৃথিবী পূর্বে বহু দুর্যোগ, যুদ্ধ ও মহামারির সম্মুখীন হয়েছে এবং মানুষ সেসব জয়ও করেছে।
কিন্তু এ কথা সবাই মানছেন, এ মহামারির সাথে যুদ্ধ যে একেবারেই ভিন্ন। আর বেশ কয়েক প্রজন্মের কাছে মহাবিপর্যয়ের সময়ে ক্রীড়াঙ্গনের এমন থমকে যাওয়া যে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। আরেকটি কথা হয়তো এখানে না বললেই নয়, এ শতাব্দীতে খেলাধুলা আর শুধু মাঠের খেলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তার অর্থমূল্যও অনেক বেশি বিবেচনার বিষয়। সেকারণেই, ভয়, অনিশ্চয়তা আর উদ্বেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
এমন অবস্থায়, মে মাসে যখন বুন্ডেসলিগার ম্যাচ দিয়ে খেলাধুলা মাঠে ফিরে আসলো, আমাদের কাছে হয়তো একটু কিম্ভূতকিমাকার মনে হলো। কারণ, মঞ্চে সবকিছুই ছিল, কিন্তু যাদের জন্য এই মঞ্চ, তাদের ছাড়া এ যেন এক ফকিরের রাজা সাজার মতো মনে হচ্ছিল, ধু ধু গ্যালারিগুলো যেন তীব্র ব্যঙ্গ করছিল সবাইকে, আর লিওনেল মেসি যেভাবে এটিকে কুৎসিত বলে আখ্যায়িত করেছেন, সেটি মোটেও বাড়িয়ে বলা ছিল না... তবুও কী যে স্বস্তির বাতাস বয়ে গিয়েছিল! ফিরে তো এসেছে! তাও কম নয়।
এ যেন খেলাধুলোর মানুষের কাছে ছিল এক নতুন সূর্যোদয়। তারপর একে একে সব খেলারই দ্বার খুলতে লাগল আর আমাদেরও নতুন নতুন গল্পের ভাণ্ডার গড়ে উঠতে থাকল। আমরা পেলের পুরনো গল্পের সাথে মেসির নতুন গল্প পেলাম, নতুনের মাঝে আবার আমরা জীবন্ত অতীতকে খুঁজে পেতে থাকলাম, আবার পেলাম নতুন বিজয়ীর গল্প, পরাজিতের আখ্যান।
পায়ের একটি নতুন বাঁক, কব্জির অনিন্দ্য সুন্দর মোচড়, সফলতা, ব্যর্থতা, মাঠের ও মাঠের বাইরের নানান গল্প, বিতর্ক আবার আমাদের হৃৎস্পন্দন ধীরে ধীরে ফিরিয়ে দিলো।
স্বাভাবিক নয় সবকিছু এখনও, নানারকম বিধিবদ্ধ নিয়মের বেড়াজালে আমরা এখনও বন্দি। তবুও হৃৎস্পন্দন যে খুঁজে পাওয়া গেল এই অমানিশায়, তাতেই আমরা খুশি।
মানুষ সবকিছু পারে, এ বিশ্বাসটুকু খেলাধুলার মাঠে ফিরে আসা আবার আমাদের জানান দিলো কিছুটা হলেও।
বৈশ্বিক ক্রীড়াঙ্গনের পথের দিশায় আমাদের দেশের খেলাধুলাও কিছুটা পথ খুঁজে পেল। এটা তো বলাই যায়, বছর শেষে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে হয়তো আমরা নতুন বছরকে বরণ করে নিচ্ছি। কিন্তু, ভয়কে পুরোপুরি জয় করে নয়।
তাই কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয়,
‘ভয় হতে তব অভয়মাঝে,
নূতন জনম দাও হে’
হ্যাঁ, নতুন বছরে আমাদের প্রার্থনা ভয়হীন নতুন জীবন। আমরা ক্রীড়াঙ্গনে মুক্ত হাওয়ার পন্থী হতে চাই আবার, প্রাণের স্ফূর্তি ছড়িয়ে দিতে চাই খেলার মাঠে।
Comments