প্রবলের নির্মাণে ‘অন্যের’ পূজা

ছবি: পলাশ খান

প্রতিবারের মতো এবারও শারদীয় উৎসবের শুরুটা হয়েছিল একটা ভাঙনের গল্প দিয়ে। ফরিদপুরের রামদিয়া গ্রামে প্রতিমা ভাঙা দিয়ে এর শুরু। আপাতত শুধু এই খবরটি পত্রিকার পাতা পর্যন্ত উঠে এসেছে। সারা দেশের আনাচে কানাচে আরও কতো রামদিয়ার প্রতিমা টুকরো হয়ে পড়ে আছে তার হদিস পাওয়া সবসময় আমাদের হয়ে ওঠে না।

উৎসব কখন, কিভাবে, কার হাত ধরে তার ‘উৎসব’ হারায় তা আমাদের দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে যায়। তাই একটা স্বঘোষিত ‘অসাম্প্রদায়িক’ দেশে ধর্মীয়ভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিচিতি নির্মাণে স্থান (স্পেস), শব্দ (সাউন্ড), সংখ্যা নিয়ে যে রাজনীতি চলে এবং তার সঙ্গে করোনার মহামারির ইস্যুকে যুক্ত করে কিভাবে সেই রাজনীতির বেশ একটা সেনসেশনাল আবেদন তৈরি করা হয় তা দেখা খুব জরুরি। পাশাপাশি কিভাবে, কখন, কিছু মানুষের অনুভূতি বা চেতনাতে আঘাত হানার গল্প দৃশ্য থেকে লোপাট হয়ে যায় সেই প্রশ্নটি দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবস্থান সাপেক্ষে ভেবে দেখাও ভীষণ প্রয়োজনীয়।

সম্প্রতি উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরে ফ্রেন্ডস ক্লাব মাঠে দুর্গা পূজার আয়োজনে ‘ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের’ ধর্মীয় অনুভূতিতে ‘চরম আঘাত’ হানায় তা বন্ধ করার দাবি জানিয়ে উপ-পুলিশ কমিশনারের কাছে ‘এলাকাবাসীর’ পক্ষ থেকে একটি আবেদন পত্র পাঠানো হয়েছে। 

দুর্গা পূজা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের মাঠ বা খোলা এলাকা, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক মন্দিরে হয়ে থাকে। এই স্থানগুলোর কোনোটিই কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয় বরং সরকারি বা ব্যক্তিগত জায়গায় দুর্গা পূজা করা হয়ে থাকে রাষ্ট্রের এবং সংবিধানের সকল নিয়ম মেনে যেখানে রাষ্ট্রের নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বীকৃতি রয়েছে। এ বিষয়টি সম্পর্কে বেশিরভাগ মুসলিম ওয়াকিবহাল হলেও প্রতিবছরে পূজার আয়োজনে আমরা দেশের বহু মুসলমানের ‘হৃদয়ে রক্তক্ষরণ’ এর খবর পাই, যেমনটা পাওয়া গেছে উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরের আবেদন পত্রে। তো এই অহেতুক রক্তক্ষরণের কারণ জানা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য খুব প্রয়োজনীয়।

এর একটা বড় কারণ হলো রাষ্ট্র যে সবার, তার মাটি, জমি, পানি, আকাশ, বাতাসে যে সবার সমান অধিকার আছে সে কথা আমাদের ‘রক্ত ক্ষরিত হৃদয়’ মানতে চায় না। স্পেস বা স্থান-পরিসর কিন্তু শুধু ডেসিমালে মাপা যায় এমন এক টুকরো জমির বিষয় নয়। বরং স্থান সকল সময়ই সামাজিক অসমতা, বৈষম্য, সংগ্রামকে আদল দেয়। আধিপত্য কায়েম করার একটা মোক্ষম অস্ত্র যে রাষ্ট্রের বা দুর্বলের জমি, প্রতিষ্ঠান, সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা তা কিন্তু আমরা বাবরি মসজিদ ভাঙার রাজনীতি থেকে দেখে আসছি। কে, কোন স্থান, কার নামে লেখালো বা ভাঙলো বা অপবিত্র করলো তার মধ্যে দিয়েই তৈরি হতে থাকে ‘নিজ’ আর ‘অন্য’ এর পরিচিতি নির্মাণ, চলতে থাকে ক্ষমতা দেখানো ও প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া। স্থান রাজনীতির এই পরিচিতি নির্মাণ চলে রাষ্ট্র তার নাগরিকের পরিচিতি কিভাবে নির্মাণ করে তার হাত ধরে। রাষ্ট্র সবার—এই বোঝাপড়া তখনই গায়েব হয়ে যায় যখন রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হয়ে ওঠে। তখনই তো দেশের বেশিরভাগ মুসলিমেরই গোটা রাষ্ট্র, তার আবাদি-অনাবাদি জমি, নদী, পার্ক, প্রতিষ্ঠান, বন-জঙ্গল, অলি-গলি, বারান্দা-কার্নিস, আনাচে-কানাচকে শুধুমাত্র মুসলিমদের সম্পত্তি হিসেবে দেখতে মন চায়। প্রবল মুসলিম মনোজগতে রাষ্ট্রের মাঠ বা জমির ওপর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরও যে অধিকার রয়েছে সে বিষয়টি মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শুধু রাষ্ট্রের পরিসর নয়, বরং রাষ্ট্রে বাস করা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভূমি ও সম্পত্তির ওপরেও সংখ্যাগরিষ্ঠের যথেচ্ছ অধিকার রয়েছে বলে দেশের বহু মুসলিম বিশ্বাস করে থাকেন। এর প্রমাণ আমরা বারবার শুধু হিন্দুদের মন্দির ভাঙার মধ্যে দিয়ে নয় বরং সমতল ও পাহাড়ের নৃগোষ্ঠীদের ভিটে মাটি থেকে রাষ্ট্রীয় ও স্থানীয়-বহিরাগত মুসলিমদের মদতে উচ্ছেদের ঘটনার মধ্যে দিয়ে পেয়ে আসছি। রাষ্ট্র যেই মুহূর্ততে কারও ধর্মকে রাষ্ট্রীয় বানায় অন্য ধর্ম তখন ঠিক রাষ্ট্রীয় না, তার চাইতে কম কিছু। আর সেই অন্য ধর্মের মানুষরাও ঠিক পুরোপুরি রাষ্ট্রের ‘সহি’ নাগরিক না। সেই ‘অন্য’ নাগরিকদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ‘অন্য’, তাদের উৎসবও ‘সহি’ না।  রাষ্ট্রটাই তো পুরোটা প্রান্তিকের নয়, যেমনটা তারা, তাদের সংস্কৃতি ঠিক ‘রাষ্ট্রীয়’ নয়। ক্ষমতাবান জনগোষ্ঠীর কাছে তাই এই অন্য জনগোষ্ঠীর ‘সহি’ না হওয়া ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান রাষ্ট্রের জমি, বা স্থান পাবার মতো যোগ্য বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। এভাবে প্রান্তিকের ভূমি, মন্দির, ধর্মীয় উৎসবের স্থানের ওপর খবরদারি জারি রাখার মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রের পাশাপাশি ক্ষমতাশালী মুসলিম জনগোষ্ঠীও কিন্তু প্রান্তিকের প্রান্তিকতা পুনপ্রতিষ্ঠা করে। আর সেকারণেই অমুসলিমের ছয় দিনের পূজা ‘হৃদয়ে রক্ত ঝরায়’। উত্তরায় কিংবা অন্য কোনো মাঠে প্রান্তিকের মাত্র ছয় দিনের দৃশ্যমানতাই প্রবল ও ক্ষমতাবানের মাঝে ‘সীমাহীন ক্ষোভের সৃষ্টি’ ঘটায়।

দ্বিতীয়ত, শুধু স্থান না, বরং শব্দ, তার আওয়াজ, ধরন সোজা কথায় পুরা সাউন্ডস্কেপকে নিয়ন্ত্রণ করাও কিন্তু খবরদারী জারি করার এবং অন্যতা তৈরি করার একটা বড় অস্ত্র। দেশের বহু গ্রাম, শহর, পাড়া-মহল্লার পূজা যেমন: উত্তরার তিন নম্বর সেক্টর মাঠের পূজার বিরুদ্ধে বরাবরের মতো এবারেও অভিযোগ আনা হয়েছে যে পূজা হলে ঢাক-ঢোল, গান বাজনার শব্দে ‘মসজিদের কার্যক্রম’ আর ‘এলাকাবাসীর বাসাবাড়িতে এবাদত বন্দেগিতে বিঘ্নতা সৃষ্টি হবে।’ সত্যি কি তাই? বরং অতীতের অভিজ্ঞতা বলে যে দীর্ঘদিনের নিপীড়নের ঘা যার পিঠে সেই হিন্দুদের, আযানের সময় ঢাক ঢোল পেটানোর অভ্যাস বলে কিছু নেই। বরং আযানের বহু আগে পিছেই তো তাড়া থাকে উলু আস্তে দেবার জন্য, শাঁখ ধীরে বাজানোর, ঢাকে কাঠি আস্তে চালানোর জন্য। বহু পাড়ার পূজায় এবার ঢাকিদের হদিস মেলেনি, বাজেনি দুর্গা মাকে বরণ করার কোনো গান। খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে কর্তৃপক্ষের নিষেধে এবার তারা কিছুটা ‘নিঃশব্দে’ পূজার আয়োজন শেষ করেছেন। এমনকি অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে অঞ্জলি দিতে এসে ‘এসো সচন্দন পুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলি নমো:’ এর মন্ত্রও তারা ঠিক মতো শুনতে পারেননি। শব্দ, আওয়াজ কখন, কেন এতো আপত্তিকর হয়ে ওঠে প্রবলের কানে? শুধু তাই নয় ভেবে দেখার বিষয় যে সব ধরনের শব্দই কি এবাদত-বন্দেগির জন্য সমস্যাজনক, নাকি কিছু বিশেষ শব্দ, আওয়াজের কিছু নির্দিষ্ট ধরন শুনতে ভীষণ বেমানান, অসহনীয়? শীতকালে যখন রাত-ভোর নারী-বিদ্বেষী চিন্তা ধারণা প্রচার করা হয়, কিংবা হিন্দি গানের তালে তালে যখন মাঠে মাঠে মাঝ রাত পর্যন্ত চিৎকার হৈ হুল্লোড় চলে তখন ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যে আঘাত আসে না! ধর্ম যায় শুধু হিন্দুর ঢাকের আওয়াজে?

সংখ্যার গুটি চেলে সুবিধা অনুযায়ী কাটাকুটি খেলাও কিন্তু আধিপত্য কায়েমের দারুণ হাতিয়ার। প্রায়শই পাড়ার বিভিন্ন পূজার ক্ষেত্রে মুসলিম এলাকাবাসী তাদের মহল্লায় পূজার কোনো জরুরত দেখেন না এই অজুহাতে যে সেখানে ‘যথেষ্ট’ সংখ্যার হিন্দু নেই। সংখ্যার এই একই যুক্তি দেখিয়ে উত্তরার তিন নম্বর সেক্টরের আবেদনকারীরা ভিন্ন স্থানে পূজা সরিয়ে নেবার দাবি জানিয়েছিলেন এই বার। আমি, আপনি, রাষ্ট্র যেই অমুসলিম গোষ্ঠীর ধর্মকে দ্বিতীয় শ্রেণির কাতারে সাংবিধানিকভাবে উপস্থাপন করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করি তাদের সংখ্যা যে খুব বেশি হবে না এই দেশে তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সংখ্যার অনুপাতে কবে এই দেশে অঞ্চলভেদে ধর্মীয় আচার নিষ্ঠা পালন করা হয়েছে? যখন মুসলমানের সংখ্যা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেখানকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর তুলনায় কম ছিল, তখনও  স্থানীয়দের ভিটেমাটি, জুম ক্ষেত দখল হয়েছে,ধর্মীয় উৎসব পালন করা হয়েছে।

আবার রোগ-বালাইয়ের সঙ্গে প্রান্তিকের ধর্মকে মিশিয়ে তা দিয়ে জুজু ভয় দেখানোর রেওয়াজও কিন্তু সমাজে বহুকাল ধরেই প্রচলিত। করোনা পরিস্থিতি ধর্মীয় আধিপত্য স্থাপনের তাই দারুণ হাতিয়ার। একদিকে বয়ান চলছে যে ‘ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি বলে কিছু নাই।’

অন্যদিকে ভিন্ন ধর্মের মানুষরা ‘শিরক’ করার অপরাধে কিভাবে করোনার মহামারিতে মরবে তা নিয়েও গল্প ঘরে-বাজারে চলছে। শুধুমাত্র পূজার ছয় দিনে করোনা যে মহামারির আকার ধারণ করবে সে বিষয়ে সচেতনতা প্রচার করে নিজেদের ধর্মের ‘সাচ্চা’ শ্রেষ্ঠত্বটাই জারি রাখছেন।

এই প্রবলের চোখে প্রান্তিকের ঈশ্বরের ঘরের মতো তার দিলও ভীষণ ‘ঝুটা’। যুগে যুগে এই ‘ঝুটা’, ‘অন্য’, ‘ভিন্ন’, ‘প্রান্তিক’ মানুষকে আমরা জীবাণুর জীবন্ত কৌটা হিসেবে উপস্থাপন করে ফায়দা লুটেছি। উদ্বাস্তু মানুষ রোগের আখড়া—তাকে ঘরে জায়গা দিতে নেই, শ্রমজীবী মানুষ ভীষণ আঁশটে—তার বেশি কাছে যাওয়া বারণ, ‘ময়লাওয়ালা ভীষণ ময়লা’–সে তো অস্পৃশ্য। এই দৃষ্টি নিয়ে চলা মুসলিমদের প্রবল চোখ শুধু হিন্দুর অঞ্জলির পদ্মফুলে করোনা মহামারি খুঁজবে এ আর নতুন কি।

এভাবেই অধিপতিশীল যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ‘প্রবল’ তখন সে ভীষণ সাহসী হয়ে প্রান্তিকের প্রান্তিকতার পুনরুৎপাদন ঘটায়। সে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মচারীকে পূজা সরিয়ে ফেলা না হলে ‘দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলার’ এবং এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় না রাখার হুমকি দেয়। কখনো পূজা মণ্ডপ ভাঙে, প্রতিমার গায়ে হাত তোলে। প্রবল জানে যে বাংলাদেশে প্রচলিত দণ্ডবিধি আইনের ২৯৫ এবং  ২৯৫(ক) এর ধারা অনুসারে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও অনুভূতিতে আঘাত করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তবুও সে লিখিতভাবে ‘মূর্তি পূজার অসাড়তা,’ ও মূর্তি পূজা থেকে মুক্তি দেবার মিশনের কথা উপস্থাপন করে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বন্ধ করার দাবি জানায়। এটি কি হিন্দু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে এক চরম আঘাত নয়? নাকি প্রান্তিকের চামড়া আরও মোটা হওয়া লাগে? চেতনা, অনুভূতিতে আঘাত, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ, অপমানের জ্বালা শুধুই সংখ্যাগুরু মুসলিমের একার সম্পত্তি?

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: গবেষক, পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গ, যুক্তরাষ্ট্র

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।) 

Comments

The Daily Star  | English

BB tightens loan classification rules to meet IMF conditions

Payment failure for three months or 90 days after the due date will now lead to classification of loans regardless of type, according to new rules announced by the central bank yesterday, aligning with international best practices prescribed by the International Monetary Fund (IMF).

4h ago