আদ্যাশক্তি ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড

Creation of universe
ছবি: সংগৃহীত

মানুষের মনে চিরশ্বাশত একটি প্রশ্ন আছে সেটি হলো এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি হয়েছিল কীভাবে? এর সঠিক উত্তর করো কাছ থেকে আজও মেলেনি: না বিজ্ঞানী না ধর্মীয় মহাপুরুষ। তবে সবাই কিছু না কিছু তথ্য আমাদেরকে দিয়েছেন তাদের বিদ্যা বা জ্ঞানভান্ডার থেকে, যদিও কোনটিই সম্পূর্ণ নয়। তাই চিন্তাশীল মানুষের মনে চিরজাগ্রত হয়ে আছে এই অসীম আকাশ, তার বুকে মিট মিট করে জ্বলে থাকা হাজারো নক্ষত্র ও তারকারাজি। মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীদের একটা বিশাল পার্থক্য আছে এবং সেটি হলো: মানুষ প্রশ্ন করতে পারে—কেন? আর এই ‘কেন’ মহামন্ত্রে বলিয়ান হয়ে মানুষ আজ অজানাকে জেনেছে এবং অপ্রাপ্যকে প্রাপ্ত হয়েছে। এবার আসুন দেখা যাক এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কেন্দ্র করে তাদের কী ভাষ্য।

বিজ্ঞানীরা দীর্ঘকাল গবেষণা করে নির্ণয় করেছেন যে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১৫০০ কোটি বছর পূর্বে এবং অদ্যাবধি এ সৃষ্টিধারা অব্যাহত রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এ তত্ত্বটির নাম দিয়েছিলেন বিগ ব্যাং থিওরি (Big Bang Theory)। তথ্যটি নেহাৎ অলিক নয়, কারণ এ আবিষ্কারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার জন্য বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানীরা তিন তিন বার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন: ১৯৭৮, ২০০৬ এবং ২০১১। জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা হলেন আর্ম পিনাজিয়াস ও রবার্ট উইলসন (১৯৭৮), এবং জন মাথার ও জর্জ স্মুট (২০০৬)।

এ আবিষ্কারের প্রথম দিকে ধর্মীয় নেতারা উচ্চ বাচ্চ্য করলেও নোবেল প্রাপ্তির পর তারা কিছুটা নড়ে চড়ে বসেন এবং বলতে শুরু করেন যে তাদের ধর্মেও এর কিছুটা আভাস আছে। একটি গবেষণার ফলকে অতি সহজেই তুলেধুনা করা যায় কিন্তু সেটি যখন নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়, তখন কটাক্ষ করলে জনরোষে পড়ার প্রভূত আশঙ্কা থাকে। তাই জগৎ সৃষ্টির এ তত্ত্বটিকে অগত্য মধুসুধনের মতো হজম করতে হয়েছে ধর্ম গুরুদের।

তবে একটি ধর্মের সঙ্গে এ সৃষ্টি তত্ত্বটির মিল ছিল এবং সেটি হচ্ছে সনাতন ধর্ম। মহামূল্য ঋগবেদের নিসা পর্বে ১৬টি শ্লোকে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্যের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি শুরু হয়েছিল একটি বিন্দু থেকে।

অতি সংক্ষেপে দেখা যাক বিগ ব্যাং (Big Bang) তত্ত্বে বিজ্ঞানীরা কী বলেছিলেন এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড উৎপত্তি কারণ হিসেবে। তাদের মতে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি শুরু হয়েছিল একটি অতি ক্ষুদ্র দানা থেকে এবং সৃষ্টির প্রাথমিক কালে মহাবিশ্ব সুষম এবং সমতাপীয় রূপে একটিই অতি উচ্চ শক্তি ঘনত্ব এবং উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপবিশিষ্ট পদার্থ দ্বারা পূর্ণ ছিল। পরবর্তিতে এ ক্ষুদ্রকায় বিন্দুটি সম্প্রসারিত হতে থাকে, তবে কোথায় হতে এবং কিভাবে এ অতি ক্ষুদ্র পিণ্ডটি আবির্ভূত হয়েছিল তার হদিস বিজ্ঞানীরা আজও খুঁজে না পেলেও এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ পেয়েছিলেন যে ওই ক্ষুদ্র বিন্দুটি ছিল একক্ধর্মী বা সুষম (singularity) এবং ওই বিস্ফোরণের পূর্বে না ছিল কোনো সময় (time), না জায়গা (space) এবং না কোনো পদার্থ (matter)।

এই ক্ষুদ্র বিন্দুটি প্রসারিত হতে হতে এক সময় বিশালকায় পরিণত হয়ে বিস্ফোরিত হয় এবং তার সমস্ত শক্তিকে তিনটি ভাগে নির্গত করে: ১) তাপ (৪২০০০ ডিগ্রি কেলভিন) ২) শব্দ এবং ৩) আলোক রশ্মি, এবং একই সঙ্গে সময়ের সূচনা ঘটে। অতঃপর গত ১৫০০ কোটি বছর ধরে এ শক্তির প্রভাবেই সৃষ্টি হয়ে চলেছে আমাদের মহাবিশ্ব। মহাবিস্ফোরণের প্রায় ৩৮০,০০০ বছর পর শক্তি হতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণু, তার পর পরমাণু থেকে অণু এবং অণু থেকে মৌলিক এবং মৌলিক থেকে নানাবিধ যৌগিক ও মহাযৌগিক পদার্থের সৃষ্টির একেবারে শেষ পর্যায়ে আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অথচ অকৃতজ্ঞ জীব ‘মানুষ’ তৈরি হয়েছি। অকৃতজ্ঞ শব্দ শুনে হয়তো আমার ওপর অনেকেই রুষ্ঠ হতে পারেন কিন্তু নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করে দেখুন আমি হয়তো অত্যন্ত নিষ্ঠুর সত্য কথাটিই আমাদের সম্পর্কে বলেছি। যাই হোক এ বিষয়ে পরে আরও বিস্তর আলাপ করা যাবে।

বর্তমান মহাবিশ্বের অধিকাংশ স্থান জুড়ে একটি রহস্যময় শক্তি বিরাজ করছে। মহাবিশ্বের বিপুল ভর ও শক্তির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী এই শক্তিকে অদৃশ্য বা গুপ্ত (dark energy) বলা হয়। বর্তমান মহাবিশ্বের মোট শক্তির ঘনত্বের শতকরা প্রায় ৭৩ ভাগ জুড়েই রয়েছে এই অদৃশ্য শক্তি, বাকিমাত্র চার ভাগ হচ্ছে আমাদের এ দৃশ্যমান ব্রহ্মাণ্ড, ২৩ শতাংশ অদৃশ্য বস্তু। ধারণা করা হয় ওই ৭৩ ভাগ অদৃশ্য শক্তি বলে আমাদের বিশ্বব্রাহ্মাণ্ড অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে পরিচালিত করছে। সুতরাং এ বিশালকায় জগৎসহ আমরা সবাই ওই অসীম এবং অনন্ত শক্তির রূপান্তর মাত্র, এবং একদিন আমরা সবাই আবার সেই অদৃশ্য শক্তিতে মিশে যাব। অনন্ত্য বীর্য। মহাশক্তির অংশ বিশেষ বিধায় আমরা সবাই অমর, কারণ শক্তির কোনো বিনাশ নেই, আছে শুধু রূপান্তর।

এতো হলো বিজ্ঞানের কথা, এখন দেখা যাক ধর্ম কী বলছে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য নিয়ে। আমি অন্য কোনো ধর্মের বাণী নিয়ে বিতর্কে যাব না, কারণ অন্য ধর্ম নিয়ে নাক গলানোকে আমি অনধিকার চর্চা মনে করি। যে ধর্মের কোন বিনাশ বা পরিবর্তন নেই, সেই সনাতন ধর্মই আমার আলোচ্য বিষয়।

‘বেদ’ সনাতন ধর্মের আদি গ্রন্থ যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘জ্ঞান’। মোট চারটি ভাগে এ জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থকে বিভক্ত হয়েছে এবং যার একটিতে (ঋগ বেদে) বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়েছে যা বিগ ব্যাং থিওরির (Big Bang theory) খুবই কাছাকাছি। ঋগবেদ (১০/১২৯/১) ‘নাসাদাসিস ন: সদাসিততদানিমনাসিদ রজ ন ব্যামাপ্রেযৎ’ অর্থ শুরুতে কোনো অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব বা বায়ু ছিল না। ঋগবেদ (১০/১২৯/৩) ‘তম অসিৎ তমস... তপসস্তন্মহিনাজাযাতৈকম’। অর্থ: চারিদিক ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। সমস্ত জিনিস একত্রে পঞ্জীভূত ছিল। সেখান থেকে প্রচণ্ড তাপের সৃষ্টি হলো। একইভাবে ঋগবেদ (১০/১২১/১) ‘হিরণ্যগর্ভ সমাভরতাগ্রে’ অর্থ: প্রথমে হিরণ্যগর্ভ সৃষ্টি হলো। ঋগবেদ (১০/১২১/৭) ‘আপ হ যদ বৃহতিরিবিশ্বমায়ান গর্ভম’ অর্থ: সেই হিরণ্যগর্ভ ছিল উত্তপ্ত তরল যাতে ছিল সৃষ্টির সমস্ত বীজ’। ঋগবেদ (১০/৭২ /২) তারপর যেখানে বিস্ফোরণ ঘটল, গলিত পদার্থ থেকে, বিন্দু থেকে যেন সব প্রসারিত হতে শুরু হলো। ঋগবেদ (১০/৭২ /৩) সেই বিস্ফোরিত অংশ সমূহ থেকে ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি হলো বিভিন্ন গ্রহ ও নক্ষত্ররাজি।

বেদের মতে সৃষ্টির শুরুতে ঔঁ উচ্চারিত হয় এবং এর প্রভাবেই হয় বিস্ফোরণ। বেদান্ত মতে ‘অনাবৃতিঃশব্দহম’ অর্থাৎ শব্দের মাধ্যমেই সৃষ্টির সূত্রপাত হয় যা মাত্র দুবছর আগে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন এবং নাম দিয়েছেন শব্দ তরঙ্গ (Cosmic sound wave)। বেদের সৃষ্টিতত্ত্ব পড়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরড. কেভিন হারলে বলেছিলেন, ‘How could Aryan Sages have known all these stories 6000 years ago when modern scientists have only recently discovered this using advanced equipment which didn’t exit that time”. Nobel Laureate Count Maurice Maeterlinck বৈদিক সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বলেন ‘A Cosmology which no European conception has ever surpassed.’

আমরা সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বিজ্ঞান ও বেদের কথা জানলাম কিন্তু আজকে আমি আর একটি অজানা বিষয়ের উপর আলোকপাত করব যা আমরা অনেকেই জানার বা বোঝার চেষ্ঠা করিনি। বছর দুই হলো আমি মহানির্বাণ তন্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করছি এবং তাতে একটি অভূতপূর্ব তত্ত্ব পেয়েছি যা মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য উন্ন্মচনে কোনো অংশেই বিজ্ঞান বা বেদ অপেক্ষা খাটো নয়।

মহানির্বাণ তন্ত্রের তৃতীয় অধ্যায় দেবাদিদেব মহাদেব মা দুর্গাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি নিয়ে বলছেন যে

“সৃষ্টিশ্চতুব্বির্ধা দেবী প্রকৃত্যামনুবর্তে।

অদৃষ্টিজায়তে সৃষ্টিঃ প্রথমে তু বরাননে।

বিবর্তভাবে সম্প্রাপ্তে মানসীসৃষ্টিরুচ্য়তে।

তৃতীয় বিকৃতং প্রাপ্তে পরিনামান্তকে তথা।

আরম্ভসৃষ্টিশ্চ ততশ্চতুর্থেযৌগিকী প্রিয়ে।

ইদানিং শৃণু দেবেশী তত্ততত্বঞ্চ বিশেষতঃ।

সৃষ্টিশ্চতুব্বির্ধা দেবী যথাপ্ব্বং সমাসতঃ।

অর্থ: মহাদেব দেবীকে বলছেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চার পর্যায়ে সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত: অদৃশ্য বশত: প্রকৃতিতে ভোগকাল উপস্থিত হলে যে সৃষ্টি হয় তাকে অদৃষ্ট সৃষ্টি বলে এবং এতে মূল প্রকৃতি (অনাদিশক্তি) হতে শক্তির আবির্ভাব ঘটে। এই শক্তি আদ্যাশক্তি নামে কথিত হয়ে থাকে। এক প্রদীপ হতে প্রজ্বালিত অন্য প্রদীপের ন্যায় এই আদ্যাশক্তি অনাদিশাক্তির রূপান্তর মাত্র। এই আদ্যাশক্তি তমোগুণ সম্পন্ন (black Energy) যা প্রাথমিক পর্যায়ে অবৃকিত থাকে। কিন্তু অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মায়া দ্বারা পরিকল্পিত এই জগৎ ব্রাহ্মণের বিবর্ত্ত স্বরূপ এবং এটি দ্বিতীয় সৃষ্টি যা মানসী সৃষ্টি নামে পরিচিত।

এতমোগুনা আদ্যাশক্তিতে বিকৃতি প্রাপ্ত হতে শুরু করে এবং এক বস্ত হতে অন্য বস্ত উৎপন্ন হতে থাকে অর্থাৎ রূপান্তর ঘটতে থাকে এবং এটাকে পরিণামসৃষ্টি বা তৃতীয় সৃষ্টি বলে। মহত্ব হতে অহংকার তত্ত্ব এবং অহংকার তত্ত্ব হতে একাদশ ইন্দ্রিয় ও পঞ্চতন্মাত্র এবং পঞ্চতন্মাত্র হতে পঞ্চভুতের উৎপত্তিই এই তৃতীয় সৃষ্টির অন্তর্গত। বিজ্ঞানীরা এটিকে অনু সৃষ্টির নামে অভিহিত করেছেন।

যখন এই পঞ্চীকৃত পরমাণু সমুদায়ের পরস্পর যোগদ্বারা ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর উৎপত্তি হতে থাকে তখন তাকে আরম্ভসৃষ্টি বা যৌগিক সৃষ্টি বলে। এটিই চতুর্থ সৃষ্টি নাম অভিহিত।

সুতরাং মহানির্বাণ তন্ত্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনে বেদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছে। বেদের মতে সৃষ্টি তিন ধাপে হয়েছে, যথা: বিবর্ত্তসৃষ্টি, পরিনামসৃষ্টি এবং যৌগিকসৃষ্টি। কিন্তু তন্ত্র বলেছে চার ধাপে এ মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে, যথা: অদৃষ্টসৃষ্টি, বিবর্ত্তসৃষ্টি, পরিনামসৃষ্টি এবং যৌগিকসৃষ্টিবা আরম্ভসৃষ্টি। বিগ ব্যাং থিওরি ও (Big Bang theory) ঠিক এই কথাটিই বলছে।

বিজ্ঞানের মতে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে তা দৃশ্যমানই হোক আর অদৃশ্যমানই হোক তা সবই ওই Black Energy এর (অদ্যাশাক্তির) অংশ ছাড়া কিছুই নয়। তন্ত্র বলছে (৩/২৫-২৬):

সৃষ্টিরাদৌ ত্বমেকাশী তমোরুপমগোচরম।

ত্বত্তোজাতং জগৎসর্ব্বং পরব্রহ্মসিসৃক্ষয়া। (৩/২৫)

মহত্তত্বাদিভুতান্তং ত্বয়া সৃষ্টিমিদ্যং জগৎ।

নিমিত্তমাত্রং তদ্ব্রহ্ম সব্ব্কারণকারনম। (৩/২৬)

সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র তুমিই তমোরূপে বিরাজিতা ছিলে। তোমার সে রূপ, বাক্যও মনের অগোচর। পরে পরম ব্রাহ্মনের অর্থাৎ মূলপ্রকৃতির সহিত তাদাত্মা প্রাপ্ত তুরীয় ব্রহ্মের সিসৃক্ষা অনুসারে তোমারই রূপান্তর তমোগুন হতে এ নিখিল বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। মহতত্ত্ব অবধি পঞ্চীকৃত পঞ্চ্মহাভূত পর্যন্ত সুমদায় জগৎ তোমা হতেই সৃষ্টি হয়েছে। সকল কারণের কারণ পরমব্রহ্ম কেবল নিমিত্ত মাত্র।

ত্শ্য়েচ্ছামাত্রমালম্ব্যত্বং মহাযোগিনিপরা পর।

করোষি পাসিহংন্যন্তে জগদেতচ্চরাচরম। (৩/২৯)

ত্ব রূপং মহাকাল জগৎসংহারকারকঃ।

মহাসংহারসময়ে কাল: সর্ব্বং গ্রসিষ্যতি। (৩/৩০)

তুমিই তাঁর ইচ্ছা মাত্র অবলম্বন করে এ চরাচর সৃষ্টি করে তা আবার পালন করছ এবং প্রলয়কালে এই সমুদয়কে তুমিই সংহার করবে। তুমিই পরাৎপরা ও মহাযোগিনী। জগৎসংহার কালে মহাকাল তোমারই একটি রূপ মাত্র। এই মহাকাল মহা প্রলয়ের সময় সমুদয় জগৎ গ্রাস করবে। যাকে বিজ্ঞানরা Black Hole বলছেন।

কল্নাৎ সর্ববভুতানাং মহাকাল: প্রকির্ত্তিতঃ।

মহাকালশ্য কল্নাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পরাঃ। (৩/৩১)

কালসংগ্রসনাৎ কালীসর্ব্বেষামাদিরুপিনিঃ।

কালত্বাদাদিভূতত্বা আদ্যা কালীতে গীযতে। (৩/৩২)

তুমি সেই মহাকালকেই গ্রাস কর বলে তাই তুমি পারৎপরা আদ্যাকালীকা। তুমিই সকলের আদি এবং কালান্তে আবার সবাইকে গ্রাস করবে বলে সকলে তোমাকে অদ্যাকালী বলে কীর্ত্তন করে। বিজ্ঞান ঠিক এ কথাটিই বিগ ব্যাং থিওরির মাধ্যমে বলেছে যে অতি উচ্চ ঘনত্ব এবং ব্ল্যাক এনার্জির সম্প্রসারে এ মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছিল, সময়ান্তে আমরা আবার সবকিছুই সেই শক্তিতেই অদৃশ্য হয়ে যাব। সুতরাং হাজারো বছরের মহানির্বাণ তন্ত্রের তত্ত্বের সঙ্গে অধুনা বিজ্ঞানের কোনো ফারাক নেই।

শ্রীমদ্ভাগবত গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ের ২৯তম শ্লোক দিয়ে লেখাটি শেষ করব

সমং পশ্যানহি সর্বত্রমসমবিস্থিতম ঈশ্বরম

নহিনত্তাআত্মানাত্মান তত যাতিং পরম গতি।

অর্থ: যিনি তার আরাধ্য ঈশ্বরকে সর্বত্র সমান ভাবে দর্শন করেন তার আত্মার কোন অধপতন হয় না এবং তিনি অন্তে পরম গতি লাভ করেন। অত্যন্ত স্বাভাবিক কথা, কারণ মানুষ আর যাই করুক না কেন তার আরাধ্য দেবতার উপর রিপুর অপপ্রয়োগ করবে না বিধায় জীবদ্দশায় তার কোনো পাপ সঞ্চয় হবে না এবং অন্তে অবশ্যই মোক্ষ লাভ করবে। তবে এটা মুখে বলা যতটা সহজ বাস্তবে তার চেয়ে অধিকতর কঠিন। অবশ্য মহানির্বাণ তন্ত্রে এর একটা সমাধান দেওয়া আছে যা নিন্মরূপ:

সমাধিযোগৈস্তদ্বেদ্যংসর্বত্র সমদৃষ্টিভিঃ।

দ্বন্দ্বাতীতৈনির্ব্বকল্পৈ দ্দেহাত্মাধ্যাসবর্জ্জিতৈঃ। (৩/৮)

অর্থ: যাহারা শত্রূ মিত্র সমদর্শী, যাহারা শীতোঞ্চ সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্বভাব পরিশুন্য, যাহারা সংকল্প বিকল্প বিরহিত, যাহাদের দেহে আত্মোভিমান নেই, শুধু মাত্র তাহারাই সমাধি যোগ দ্বারা এই ব্রাহ্মরূপ ঈশ্বরকে সর্বত্র দর্শন করে থাকেন। এই যদি শর্ত হয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা কেউ এ সৌভাগ্যের অধিকারী নই, অন্তত আমার বেলায় এটা একশত ভাগ প্রযোজ্য।

তাহলে আমাদের কি মোক্ষ লাভ হবে না? অনেক ভেবে চিন্তে আমি একটা অতন্ত্য গোপন অথচ সহজ পথ খুঁজে পেয়েছি যা আমি আপনাদের অতি গোপনে বলছি কিন্তু আমাকে কথা দিতে হবে যে আপনারা কাউকে বলেন না।

ত্বমেব শুক্ষ্মাস্থুলা ত্বং ব্যক্তাব্যক্তস্বরূপনি।

নিরাকারাপি সাকারা কস্তূাং বেদিতুম্হর্তি। (৪/১৫)

মহানির্বাণ তন্ত্রের চতুর্থ অধ্যায়ে ১৫তম শ্লোকে দেবাদিদেব মা অদ্যাশাক্তিকে বলছেন যে ‘দেবী, তুমি শুক্ষ্মা অতএব অব্যক্ত স্বরূপা এবং নিরাকারা। আবার তুমিই স্থুলা অতএব তুমি ব্যক্তা এবং সাকারা। এটা কিভাবে সম্ভব, দেবাদিদেব একবার বলছেন হে দেবী তুমি শুক্ষ্মা আবার একই সঙ্গে বলছেন তুমি স্থুলা, বিষয়টি তালগোল পাকিয়ে গেল না। তবে কি দেবাদিদেব মহাদেব ভুল বলেছেন? কখনো নয়, উনি মহাদেব, তাই কখনো মিথ্যা বলতে পারেন না। তাহলে সত্যটা কী?

উনার কথার গুপ্ত রহস্য একমাত্র ঝানু পদার্থবিদ এবং রসায়ানবিদরা বুঝতে পারবেন কেন আদ্যাশক্তি একই সঙ্গে শুক্ষ্মা এবং স্থুলা। আমার দুর্ভাগ্য যে আমি ওই দুই শাস্ত্রের কোনটিতেই বিশেজ্ঞ নই। তাই অতন্ত্য সাদামাটা ভাষায় বিষযটি বিশ্লেষণ করি।

আসলে মায়ের মতো আমাদের শরীরের দুটি ভাগ আছে: একটি স্থুলা শরীর যা বাহিরে থেকে দেখা যায় এবং সেটি যদি একটু সুন্দর হয় তাহলে আমরা অতন্ত্য গর্ব সহকারে তা প্রদর্শন করি। আর অপরটি শুক্ষ্মা শরীর যা বাহির থেকে দেখা যায় না এবং এটি প্রদর্শন করে লাভ নেই কারণ এ শরীরটি সবার জন্য সমান। শুধু মানুষই নয়, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত দৃশ্যমান বস্তুতে এ শুক্ষ্মা শরীরটি বিরাজমান এবং তা সর্বতভাবে সমান। এটি হচ্ছে অণু। ঠিক ইটে গড়া অট্টালিকার মতো। একজন ধনীর যত বৃহৎ এবং সুরম্য অট্টালিকাই হোক না কেন তার সর্বশেষ অংশ হচ্ছে ইট যার সঙ্গে কিন্তু একজন গরীবের সাদামাটা দালানের ইটের কোনো পাথক্য নেই।

তাহলে এ শুক্ষ্মা শরীরটি দেখতে কেমন? এটি মূলত ত্রিবিধ বিন্দু দিয়ে তৈরি “অ, উ এবং ম’ যাকে একত্রে বলে ঔঁ এবং এটিই পদার্থ এবং রসায়ানবিদরা অ্যাটম বলে অভিহিত করেছেন। তাহলে এই ঔঁ এবং অ্যাটম এর সাদৃশ্য কোথায়?

ঔঁ এর তিনটি বিন্দুর একটি হচ্ছে রাজসিক বিন্দু (অ), যা সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত যাকে আমরা ব্রহ্মদেব বলে জানি, দ্বিতীয় বিন্দুটি হচ্ছে সাত্বিক (উ) ইনি স্থিতির কাজে নিয়োজিত এবং বিষ্ণুদেব নাম খ্যাত এবং তৃতীয়টি হচ্ছে তামসিক বিন্দু (ম) যিনি লয়ের কাজে সদায় নিয়োজিত এবং উনিই দেবাদিদেব মহাদেব। সনাতন ধর্মে ঔঁ কেই পরমব্রহ্মণ রূপে আখ্যায়িত করা হয়ছে যিনি সর্বত্র সমভাবে বিরাজমান।

পদার্থ এবং রসায়ানবিদরাও একই কথা বলছেন, তাদের মতে অ্যাটমই যেকোনো পদার্থের সর্বশেষ কার্যকর একক যাতে আছে তিনটি পরমাণু বা subatoms। যার প্রথমটি ইলেক্ট্রন যা নতুন যৌগ তেরির কাজে নিয়োজিত (ঠিক ব্রহ্মার মত), দ্বিতীয়টি প্রোটন যা atom এর স্থিতির (বিষ্ণুদেব) কাজে নিয়োজিত এবং সর্বশেষটি নিউট্রন (মহাদেব) যিনি atom এর লয়ের সুচনা করেন।

সুতরাং পাঠকগণ এটিই আমার সাদামাটা বিশ্লেষণ, এর অধিক বলতে গিয়ে আমি আপনাদের ধর্য্যের বাঁধ ভাঙতে চাই না। তাই শ্রীমদ্ভাগবত গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ের ২৯তম শ্লোকের সর্বত্র বিরাজমান ঈশ্বরকে যদি সত্যিই দেখতে চান তবে আপনার সামনে যা কিছু দৃশ্যমান: মানুষ থেকে শুরু করে একটি ধুলিকনা বা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে ঔঁ বা অদ্যাশাক্তি বা বিজ্ঞানীদের ভাষায় ATOMকে দেখার চেষ্টা করুন তাহলেই আমি হলফ করে বলতে পারি যে আপনার চোখে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। কারণ আপনি শুধুমাত্র অনন্ত্য বীর্যা অবিশনশ্বর শক্তিকেই দেখতে পারবেন। যমরাজ আপনার আশে পাশে ভিড়তে পারবে না এবং অন্তে আপনি অবশ্যই মোক্ষ লাভ করবেন।

জ্ঞানতোহজ্ঞানতো বাপি যন্ময়া ক্রিয়তে শিবে।

তবকৃত্যমিদং সর্বমিতিজ্ঞাত্বা ক্ষমস্ব মে।

জ্ঞানে বা অজ্ঞানে যা কিছু লিখেছি, ওগো মা আদ্যাশক্তি শিবে, সে তোমারই কৃত, এই জেনে আমাকে ক্ষমা কর।

ঔঁ শিবা-শক্ত্যায় নমঃ

সাহায্যকারী গ্রন্থসমুহঃ

১. মহানির্বাণতন্ত্রম

২. ঋগবেদ

৩. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা

৪. কুলার্নব তন্ত্রম

৪. শূন্য হতে মহাবিশ্ব

ড. বিজন কুমার শীল: অণুজীব বিজ্ঞানী, সার্স ভাইরাসের কিট উদ্ভাবক, করোনাভাইরাস শনাক্তের ‘জি র‍্যাপিড ডট ব্লট’ কিট উদ্ভাবক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।) 

Comments