ঢাকা দক্ষিণের প্রধান সমস্যা কুকুর?
‘ঢাকাবাসীর অভিপ্রায় অনুযায়ী বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে আমরা চিন্তাভাবনা করছি’- গত ৩০ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।
ওই বক্তব্যের পর আগস্টে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও জনসংযোগ কর্মকর্তার উদ্ধৃত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ৩০ হাজার কুকুর শহরের বাইরে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা রয়েছে করপোরেশনের।
এরপরই বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে শুরু হয় তীব্র আলোচনা-সমালোচনা। পরে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ জানায় যে, কুকুর সরানোর বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে মাত্র, চূড়ান্ত কিছু নয়।
এরমধ্যেই গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ও ধানমন্ডি এলাকা থেকে কিছু কুকুর সরিয়ে মাতুয়াইলে ফেলে রেখে এসেছে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ।
ডিএসসিসি’র মূল সমস্যা কি কুকুর? নিরীহ প্রাণীটির প্রতি ন্যূনতম মানবিক আচরণ কি দেখানো হচ্ছে?
এসব বিষয়ে আজ বুধবার একাত্তরের গেরিলা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু এবং বিশিষ্ট নগরপরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিবের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের কথা হয়।
একাত্তরের গেরিলা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে সমস্যার তো শেষ নেই। রাস্তাঘাট ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক নেই। এরমধ্যে বরং কুকুর গৃহস্থালি বর্জ্য খেয়ে শহরকে দুর্গন্ধমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন করে আমাদের বাঁচিয়ে দেয়। কুকুর শহর, ঘরবাড়ি ও দোকান রক্ষা করে। যখন দারোয়ানেরা ঘুমায়, পুলিশ যখন আসে না, তখন বাড়ি ও দোকান কুকুরেরাই পাহারা দেয়।’
‘কোনো মেয়ে রাস্তায় একা হেঁটে গেলে, তাকে যদি বখাটেরা শ্লিলতাহানীর চেষ্টা করে, কুকুরই প্রথম এগিয়ে যায়, কোনো মানুষ কিন্তু যায় না। আমি এর আগেও লিখেছি যে, “গুহামানব থেকে মহাকাশ অভিযান” এর পুরোটাতেই রয়েছে মানুষের সঙ্গে কুকুরের বন্ধুত্বের ইতিহাস। মহাকাশে মানুষের আগে কুকুরই গিয়েছে’, বলেন তিনি।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘কুকুরকে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ওদের যত্ন নিতে হবে, গলায় বন্ধনী দিয়ে চিহ্নিতকরণ, নিবন্ধন, বন্ধ্যাকরণ ও ভ্যাকসিন দিতে হবে। এসব করে কুকুরের সংখ্যা কমিয়ে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় আনতে হবে। বন্ধ্যাকরণের মাধ্যমে সেটি করা যায়, তবে কুকুর নিধন বা স্থানান্তর কোনো সমাধান নয়।’
‘আমি ঠিক জানি না, কী কারণে সিটি করপোরেশন এ ধরনের নৃশংস উদ্যোগ নিয়েছে। আমরাই তো শহরের মানুষ। আমরাই তো ভোট দিয়ে তাদের নির্বাচিত করি। আমার মনে হয় যে, বর্জ্য পরিষ্কার, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট ঠিক করা, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, এগুলো তাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি কাজ’, বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘কুকুর মানুষকে নিরাপত্তা দেয়, তাকে সরিয়ে নিলে শহর অনিরাপদ হয়ে যাবে। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে কুকুর মানুষের সঙ্গী হয়ে নগর পর্যন্ত চলে এসেছে। এমন কোনো জনপদ পাওয়া যাবে না, যেখানে কুকুর নেই। শিকার ও যুদ্ধেও কুকুর আছে। পাকিস্তানী হানাদাররাও যখন বিভিন্ন এলাকা ও গ্রামে আক্রমণ চালাত, তখন কুকুরই প্রথম তাদের দেখে সামনে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করেছে।’
‘পৃথিবীর পুরো বাস্তুসংস্থান থেকে যদি একটি উপাদান সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলেই কিন্তু বিপর্যয় নেমে আসে, মহামারি হয় এবং তাই ঘটছে’, যোগ করেন তিনি।
একাত্তরের এই গেরিলা ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এ ধরণের উদ্যোগ বন্ধ করে কার্যকরী ব্যবস্থা নিন। কুকুরের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে এগুলোকে বাঁচিয়ে শহরে রাখার ব্যবস্থা করুন। আমাদের জীবনকে নিরাপদ করুন। কুকুরের মাধ্যমে হলেও আমাদের শহরটিকে পরিচ্ছন্ন রাখুন।’
নগরপরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আমাদের মাথা বদলে গেলে নীতি বদলে যায়। দেশে কুকুর নিধনবিরোধী যেসব মামলা হয়েছে, তার কোনো কোনোটিতে যারা কুকুরের পক্ষ নিয়েছেন, নির্বিচারে কুকুর নিধনের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তারাই যখন মেয়র হন, তখন তারাই আবার উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেন।’
‘মুশকিল হচ্ছে- নগরীর এই মুহূর্তে সমস্যা অনেক বেশি। সমস্যা জর্জরিত নগরীতে প্রাধিকার তৈরি করতে হয়। যেমন: কিছু কাজকে প্রাধিকারের আওতায় রেখে আগে বাস্তবায়ন করতে হয়। পরে অন্য সমস্যা সমাধানের কথা ভাবা উচিত’, যোগ করেন তিনি।
ইকবাল হাবিব বলেন, ‘আপনি যখন কুকুর নিধনের মতো বিষয়কে প্রাধান্য দেবেন, তখন আপনাকে বুঝতে হবে যে, আপনি আপনার মূল কাজকে সত্যিকার অর্থে চিহ্নিত করতে পারেননি।’
তিনি বলেন, ‘ধারণাগতভাবে চিন্তা করলে, বিষয়টি হওয়ার কথা ছিল কুকুর নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে কুকুর নিধন। সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে- কুকুরই তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। দুর্ভাগ্য যে, আমাদের খাবার পানি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা, বস্তিবাসীর সেবাপ্রাপ্তি, অগ্নিকাণ্ড, নিরাপত্তা ও নিরাপদ ভবনের সংকট নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।’
‘এগুলো নিয়ে কথা বলতেও এখন রুচিতে বাধে। দুঃখজনক হচ্ছে- সত্যিকার অর্থে তারা যখন প্রতিশ্রুতি দেন, তখন তো কুকুর নিধনের প্রতিশ্রুতি ছিল না। তাহলে প্রতিশ্রুতির প্রথম দায়িত্ব হিসেবে কুকুর নিধন আসলো কেন? মেয়রের মূল প্রতিশ্রুতি ছিল পাঁচটি। সেখানে কোথায় কুকুর নিধনের কথা বলা আছে, তা আমি জানতে চাই?’, বলেন তিনি।
এই নগরপরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, ক্ষমতা বা দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা খেই হারিয়ে ফেলি। ফলশ্রুতিতে এক ধরণের ভুলভুলাইয়া দিয়ে জনগণের মধ্যে ডাইভারশন তৈরির চেষ্টা করি। এটি নিয়ে বিতর্ক হলে, আসল কাজের যে দেরি হচ্ছে, সেটি নিয়ে জনগণ আর বিচলিত থাকেন না।’
উল্লেখ্য, আগে আদিম নৃশংসতায় পিটিয়ে কুকুর নিধন করত পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন। ২০১২ সালে উচ্চ আদালত নির্বিচার কুকুর নিধনকে অমানবিক উল্লেখ করে তা বন্ধের নির্দেশ দেন। এরপর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে কুকুরকে বন্ধ্যা করে তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের প্রাণিকল্যাণ আইনের সপ্তম ধারায় বলা হয়েছে, মালিকবিহীন কোনো প্রাণীকে নিধন বা অপসারণ করা যাবে না।
আরও পড়ুন:
‘মেয়রের আদেশ’: টিএসসি ও ধানমন্ডি থেকে কুকুর ফেলে আসা হলো মাতুয়াইলে
Comments