ভুক্তভোগী থেকে ভিলেন

পাচার হওয়া অভিবাসী এবং দেশের ভাবমূর্তি

ছবি: সংগৃহীত

এমন নাটক আগেও মঞ্চস্থ হয়েছে। এই নাটকের স্ক্রিপ্টটাও আগের নাটকের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। মঞ্চায়নের জায়গাও এক। এমনকি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারীদের চরিত্রও প্রায় একই। পার্থক্য একটাই, এই অভিবাসীরা ফিরেছেন ভিয়েতনাম থেকে।

আগের মতোই, ভিয়েতনামফেরত অভিবাসীরা ‘ষড়যন্ত্র’ করবেন বলে ‘গোপন সূত্র’ থেকে জানতে পেরেছেন এই নাটকের প্রধান চরিত্ররা। ফলে তেমন কোনো চেষ্টা ছাড়াই এই অভিবাসীদের অন্ধকার কারাগারে পাঠানোর অনুমোদন তারা পেয়ে যান ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে। কে ‘প্রকৃত অপরাধী’ এবং কোন অপরাধের দায়ে, তা যতক্ষণ জানা যাচ্ছে না ততক্ষণ সবাই আটক থাকবে। বুঝতে হবে যে তারা শুধু ‘দেশের ভাবমূর্তি ক্ষূণ্ন’ করেছে তাই নয়, তারা ‘দেশ, সরকার’ এবং জনগণের বিরুদ্ধেও গুরুতর অপরাধমূলক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে।

প্রতারণার শিকার, বিচলিত ও হতাশাগ্রস্ত এই প্রবাসফেরত মানুষগুলো আশায় থাকে, শিগগির সবাই ভুল বুঝতে পারবে, তাদের এই দুঃস্বপ্নের সমাপ্তি হবে। কিন্তু, সেই সমাপ্তির সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়, যখন তাদের আটকের সময়সীমা আরও বাড়ানোর জন্য আবেদনের পর আবেদন জমা পরে।

তাদের পরিবারের সদস্যরা তাদের ঘরে ফিরিয়ে নিতে ছোটাছুটি করতে থাকেন। কিন্তু, তারা স্রষ্টার আশীর্বাদ পাওয়ার মতো যথেষ্ট ভাগ্যবান না। তাদের জীবন তাদের শিখিয়েছে, ঈশ্বর তাদের পক্ষে না। ঈশ্বর শুধু পক্ষপাতদুষ্ট ধনী ও শক্তিশালীদের পক্ষে থাকে। এই দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারগুলোর সামনে আসা এই অপ্রত্যাশিত এবং বিরাট বাধা তাদেরই অতিক্রম করতে হবে।

দুর্দশাগ্রস্ত এই দলটি দেশে ফিরে আসার পর তাদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষ যে আচরণ করেছে তা নিয়ে দেশের সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক নিজের হতাশা প্রকাশ করেছেন। ৪৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক এবং অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ১৯টি সংস্থার প্ল্যাটফর্ম দাবি করেছে যেন ‘অবরুদ্ধ অভিবাসীদের তাৎক্ষণিক ও নিঃশর্ত মুক্তি এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ দেওয়া হয়।

নাটক একটি আকর্ষণীয় মোড় নেয় যখন পশ্চিম এশিয়ার দেশটি থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফেরা অভিবাসীদের নামে দায়ের করা অভিযোগের উপর ভিত্তি করে সাজানো হয় এই মামলা। বলা হয়, ভিয়েতনামে আইন অমান্য করায় তাদের শাস্তি হয়েছিল। তুরাগ থানার উপপরিদর্শক বলেন, ‘তারা সবাই সেদেশে কারাগারে ছিল’। শুধু এটা বলেই ক্ষান্ত হননি তিনি। তিনি এটাও যোগ করেছেন যে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ পুলিশকে ‘ভিয়েতনাম থেকে নির্দেশনা’ দেওয়া হয়েছে। এটা স্পষ্টতই একটি মিথ্যা দাবি। এদের কেউই ভিয়েতনামে কোনো ধরনের অভিযোগের মুখোমুখি হননি। বরং, তাদের মধ্যে অনেকে দাবি করেছেন যে তারা ভিয়েতনাম পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েও পাননি।

প্রায় এক বছর ধরে দেশের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ায় পাচারের শিকার হওয়া অভিবাসীদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হচ্ছে। এসব প্রতিবেদনে রিক্রুটিং এজেন্সি, দালাল এবং ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলোর সম্পর্কেও চমকপ্রদ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ভুক্তভোগীদের প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজের জন্য মাসে ৫০০-৬০০  মার্কিন ডলার বেতন (নিয়মিত দিনের জন্য প্রতি ঘণ্টায় দেড় ডলার এবং ছুটির দিনের জন্য প্রতি ঘণ্টায় আড়াই ডলার বাড়তি পারিশ্রমিক), বিনামূল্যে খাবার, আবাসন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, দুই বছর পর ওয়ার্ক পারমিট পুনরায় নবায়ন এবং দেশে ফেরার বিমান টিকিট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এর জন্য দালালদের দিতে হয়েছিল জনপ্রতি গড়ে চার হাজার ৭০০ থেকে পাঁচ হাজার ৭০০ ডলার।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, বিদেশগামীদের ফ্লাইটের একদিন আগে ঢাকায় আসতে বলা হয়েছিল এবং সাদা কাগজে তাদের সই করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এই সই করা কাগজগুলো ব্যবহার করেই ‘চুক্তিপত্র’ তৈরি করা হয়। এই অভিবাসীদের ব্যবহার করা হয়েছে অর্থ পাচারের মাধ্যম হিসেবেও। তাদের প্রত্যেকের কাছে এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার ডলার দেওয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল সেদেশে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতিনিধিদের কাছে এই অর্থ তুলে দেওয়ার জন্য। সাদা কাগজে সই করতে বা টাকা বহন করতে অস্বীকৃতি জানালে হুমকি দেওয়া হয় ফ্লাইট বাতিল করে দেওয়ার এবং তাদের জমা দেওয়া টাকা ফেরত না দেওয়ার।

গন্তব্য দেশে পৌঁছে তারা তাদের প্রত্যাশার বিপরীত চিত্রটাই দেখতে পান। কোম্পানির প্রতিনিধির বদলে তাদের সেখানে নিতে আসেন বাংলাদেশি দালালরা। সেখান থেকেই তাদের পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়। নোংরা টয়লেট সংযুক্ত ছোট্ট একটা ঘরে তাদের থাকতে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে যারা ভাগ্যবান ছিলেন তারা খাবার পেতেন। যদিও সেগুলোর মধ্যে শুয়োর এবং ব্যাঙের মাংস থাকতো। চুক্তিতে খাবার দেওয়ার কথা থাকলেও অন্যদের নিজের খাবারের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হয়।

এদের কারোই ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হয়নি। যেখানে তাদের নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল সেখানে না দিয়ে, একেক সময় একেক জায়গায় তাদের কাজে পাঠানো হয়। বেতনের টাকাও দিত অনিয়মিতভাবে। সেখানে এই অভিবাসীদের বেতনের নিয়ম হচ্ছে ‘অল্প টাকায় বেশি কাজ এবং কাজ নাই তো টাকা নাই’। যৎসামান্য বেতন থেকে দেশে পাঠানোর জন্য টাকা বাঁচাতে পারতো অল্প কয়েকজন অভিবাসীই। বাঁচানো টাকা দেশে পাঠাতে তাদের আবার যেতে হতো সেই দালালদের কাছেই। কারণ, তাদের বৈধ কাগজ না থাকায় বৈধ পথে দেশে টাকা পাঠানো সম্ভব না। অনেক সময় জানতে পারত যে তাদের প্রিয়জনের কাছে সেই টাকা পৌঁছেনি।

দলের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বাকীদেরই তার সেবা করতে হতো। চিকিত্সকের সেবা পাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে অন্য শ্রমিকদের মধ্যে কেউ একজন তার জন্য ওষুধ কিনতেন। তারা জানিয়েছেন যে তাদের ধরে নিয়ে নিয়মিত নির্যাতন ও অপমান করা হতো। সার্বক্ষণিক তারা আতংকের মধ্যে থাকতেন।

ওয়ার্ক পারমিট নেই, নিয়মিত কাজ ও আয় নেই, পাসপোর্টসহ অন্যান্য কাগজপত্র হাতে নেই, অস্বাস্থ্যকর কাজ এবং জীবনযাপন, অকারণে নির্যাতন, দালালদের হুমকি এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতা না পাওয়ায় তাদের কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না। জুনের প্রথম দিকে তারা পালিয়ে ভিয়েতনামের হ্যানয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে অভিযোগ জানাতে যায়। অভিযোগ আমলে না নেওয়ায় তারা দূতাবাসের সামনেই অবস্থান গ্রহণ করেন।

চাপের মুখে পরে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং ভিয়েতনাম কর্তৃপক্ষ তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার আগে হোটেল ও ডরমিটরিতে থাকার ব্যবস্থা করে। বলাই বাহুল্য, দেশে ফিরে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন শেষ করার পরই তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে।

প্রথম পর্বের মতো, কর্তৃপক্ষ এখনও পর্যন্ত তাদের দাবির পক্ষে কোনো ধরনের প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। এই প্রত্যাবর্তনকারীরা যে ‘দেশের ভাবমূর্তি ক্ষূণ্ন’ করেছে এবং ‘দেশ, সরকার’ ও জনগণের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধমূলক কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে, তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। এর সবই কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে।

প্রথমত, এই অভিবাসীরা ভিয়েতনামে কারাগারে ছিল বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে তা একেবারেই মিথ্যা। এছাড়াও, যদি এই ফেরত আসা অভিবাসীরা (যারা প্রত্যেকেই প্রচুর নির্যাতন সহ্য করেছে) সত্যিই দূতাবাসের নিয়ম লঙ্ঘন করে থাকে তাহলে সে বিষয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে কেন জানানো হয়নি?

দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কোয়ারেন্টাইনে থাকা ভিয়েতনামফেরত প্রত্যেকে কীভাবে একটি বিশাল চক্রান্তের অংশ হতে পারেন?

তৃতীয়ত, ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত স্পষ্টভাবে বলেছেন, সেদেশে বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ নেই। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে ভিয়েতনামে শ্রমিক পাঠাচ্ছে দালালরা। ভিয়েতনামে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে যে অনিয়ম হচ্ছে তা তিনি বারবার জানিয়েছেন বাংলাদেশে। প্রশ্ন জাগে- রিক্রুটিং এজেন্সি, ট্র্যাভেল এজেন্সি এবং দালালদের একটি সিন্ডিকেটের মানবপাচার রোধ করতে ঢাকার কর্তৃপক্ষ কী দৃঢ় ব্যবস্থা নিয়েছে?

চতুর্থত, রাষ্ট্রদূত আরও প্রকাশ করেছেন যে এই ভুক্তভোগীদের ছাড়পত্র বা স্মার্ট কার্ড দেওয়ার আগে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এ বিষয়ে তার কার্যালয়ে কখনোই যোগাযোগ করেনি। কেন এবং কীভাবে দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ না করে এগুলো করা হলো? বিএমইটি দাবি করেছে যে যারা উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন, তাদের মধ্য থেকে কিছু ছাড়পত্র তারা দিয়েছেন। ছাড়পত্র দেওয়ার আগে এধরণের আবেদনপত্রের তথ্য মূল্যায়ন করার কী ব্যবস্থা আছে?

পঞ্চম, এ বছর মার্চের মাঝামাঝি সময়ে কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামে যেতে আগ্রহী ৮০ জনের পাসপোর্ট একজন অভিযুক্ত পাচারকারীর মতিঝিল অফিস থেকে পাওয়া যায়। গ্রেপ্তার ও বিচার না করে তাকে তিন লাখ টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হলো কেন?

ষষ্ঠত, ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে কিছু সংশোধনী দেন। সেখানে বলা হয়েছে, ৫৪ ধারার অধীনে কাউকে ১৫ দিনের বেশি সময়ের জন্য আটকে রাখা যাবে না। পাচার হওয়া এবং পরবর্তীতে ফিরে আসা অভিবাসীদের ১৫ দিনের বেশি সময় আটকে রাখা কি আইনের প্রতি অসম্মান জানানো ও অবজ্ঞা করা নয়?

এবং সর্বশেষ, এই অভিবাসীদের ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষূণ্ন করার’ দায়ে যে কর্তৃপক্ষ নৈতিক কর্তৃত্ব দেখাচ্ছে, তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে যখন একজন সংসদ সদস্যের নামে উপসাগরীয় অঞ্চলে মানব পাচার সিন্ডিকেট চালানোর অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন স্থানে মাদক ও মানব পাচারকারীরা নির্বিঘ্নে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়, কোন রাজনৈতিক খুটির জোরে?

উপরের বর্ণনা থেকে এটা পরিষ্কারভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে ভিয়েতনামফেরত বাংলাদেশিরা পাচারের শিকার হয়েছিলেন। অস্পষ্ট কারণ দেখিয়ে তাদের আটকে রাখা চূড়ান্ত অবিচার। এভাবে সম্পদের অপচয় করার পরিবর্তে কর্তৃপক্ষের উচিত অনতিবিলম্বে এবং নিঃশর্তে তাদের মুক্ত করে দেওয়া। সেই সাথে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারের আওতায় আনা। এতে করে, যারা বিদেশে যাওয়ার যারা স্বপ্ন দেখে শুধু তারাই উপকৃত হবে না, ‘দেশের ভাবমূর্তি’ও অক্ষূণ্ন থাকবে।

 

(এই লেখার জন্য দ্য ডেইলি স্টারের পরিমল পালমা, প্রথম আলোর নিলয় মহিউদ্দীন এবং নিউ এজের ওয়াসিমুদ্দিন ভূইয়ার প্রতিবেদনের সাহায্য নেওয়া হয়েছে)

 

সি আর আবরার একজন শিক্ষাবিদ।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
tailor injured during July mass uprising fights for dignity

Is respect too much to ask for?

Rasel Alam, 36, a tailor from Mohammadpur, has been fighting two battles since the July mass uprising -- one for his health and another for his dignity.

19h ago