প্রসঙ্গ: রবীন্দ্রনাথের গান

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি

সম্প্রতি ইউটিউবে আপলোডকৃত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি জগদ্বিখ্যাত গান নিয়ে রবীন্দ্র সংগীতপ্রেমীদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। গানটি হচ্ছে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। দুই বাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘জীবনমুখী’ বাংলা গানের কন্ঠশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তী, শুভমিতা, রূপঙ্কর, জয়তী চক্রবর্তীসহ পশ্চিমবঙ্গের মোট নয় জন শিল্পী এতে কণ্ঠ দিয়েছেন। ‘তোমার আকাশ তোমার বাতাস’ নামে অ্যালবামটিতে এই গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং অ্যালবামটি বাজারে এনেছে আশা অডিও কোম্পানি। পরিবেশিত গানটি তার সুর ও গায়কীর কারণে শ্রোতাদের একাংশের কাছে নন্দিত ও অপরাংশের কাছে নিন্দিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচকদের কেউ কেউ গানটির বাণী’র ভেদ নিয়েও কথা বলেছেন।

‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি ১৯০৫ সালের ৭ই আগস্ট কোলকাতা টাউন হলে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে আয়োজিত প্রতিবাদ সভা উপলক্ষে রচিত। এটি সঞ্জীবনী পত্রিকায় (২২ ভাদ্র, ১৩১২ সংখ্যা) কবির স্বাক্ষরসহ প্রকাশিত হয়েছিল। কবির বয়স তখন ৪৪ বছর। ১৩৩৮ সনে প্রকাশিত গীতবিতানের প্রথম সংস্করণের প্রথম খণ্ডে এবং ১৩৪৫ সনে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণের প্রথম খণ্ডে গানটি সন্নিবেশিত হয়। এর স্বরলিপি স্বরবিতান-৪৬-এর অন্তর্ভুক্ত যার স্বরলিপিকার কবির ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী। দাদরা তালাশ্রিত এই গানটি বাউল সুরে সুরারোপিত; বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহের গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটির সুরের সঙ্গে মিল রেখে রবীন্দ্রনাথ এই গানের সুর করেছিলেন।

আমি খুব সাধারণ একজন শ্রোতা, সংগীতের ব্যাকরণ বুঝি না। তবে ভালো কথা ও সুরের গান শুনতে ভালবাসি আর রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে অপার আনন্দ ও অনাবিল প্রশান্তি খুঁজে পাই। আলোচ্য গানটির অংশবিশেষ আমাদের জাতীয় সংগীতও বটে। সেই সূত্রে জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই গানটি শুনে ও গেয়ে আসছি (যদিও জাতীয় সংগীতের সুর রবীন্দ্রনাথকৃত সুরের অনুরূপ নয়, সে আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক)। পরবর্তীকালে যখন সম্পূর্ণ গানটি শুনতে পেলাম তখন গানটিকে এত ভালোবেসে ফেললাম যে এখন পর্যন্ত বোধ হয় গানটি আমার হাজার বার শোনা হয়েছে। তাই সমালোচনা না করে শুধু সাহস করে এটুকু বলতেই পারি— আলোচ্য গানটির বাণীতে কোনো পরিবর্তন করা না হলেও সুর যথাযথ হয়নি। বাকি রইলো গানটির ‘গায়কী’ বা স্টাইল।

সংগীতপিপাসু মাত্রই জানেন যে, বিশেষ বিশেষ ধরনের সংগীতের পরিবেশনার আলাদা আলাদা স্টাইল বা ধরন রয়েছে। উচ্চাঙ্গ সংগীতের কথা বলছি না; গজল, আধুনিক গান, লোকসংগীত বা গণসংগীত শুনলেই বোঝা যায় যে, এটা কোন ধরনের গান। রবীন্দ্র সংগীতও ঠিক সে রকম। তারও রয়েছে নিজস্ব স্টাইল এবং সেটি রচয়িতা কর্তৃক নির্দিষ্টকৃত। রবীন্দ্র সংগীত ইচ্ছা করলেই ঠুংরির মতো করে বা লোকসংগীতের মতো করে গাওয়া যায় না। যদিও লোকজ সুরে প্রচুর রবীন্দ্র সংগীত রয়েছে। কিন্তু সেটি রবীন্দ্র সংগীতই, লোকসংগীত নয়।

আবু জাফর শামসুদ্দীন তার এক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ সংগীতকে প্রথাসিদ্ধ আঞ্চলিক ব্যকরণের বৃত্তসীমার মধ্যে নজরবন্দি করে রাখেননি। তাই রবীন্দ্র সংগীতের প্রথম দুটি পংক্তি শোনামাত্র যে কোনো সচেতন শ্রোতা বলতে পারেন, রবীন্দ্র সংগীত শুনছি’। নচিকেতা প্রমুখের গাওয়া গানটি যদি বহুল প্রচলিত একটি রবীন্দ্র সংগীত না হতো তবে শুনে বোঝা কঠিন হতো যে এটি একটি রবীন্দ্র সংগীত। কাজেই খুব সহজেই বলা যেতে পারে যে, গানটি রবীন্দ্র সংগীতের স্টাইলে গীত হয়নি বা গানটি ‘রবীন্দ্র সংগীত’ হয়ে উঠেনি। যারা এই গানটির পক্ষে নিয়েছেন, তারা বলতে চাইছেন— যে কোনো সংগীতের স্টাইল পরিবর্তিত হয়ে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার ‘আধুনিক’ হওয়াই উচিত; তাহলে রবীন্দ্র সংগীত তার বাইরে থাকবে কেন? অন্যদের আপত্তি ঠিক এখানেই।

রবীন্দ্র সংগীতের ক্ষেত্রে তার কোনো বৈশিষ্ট্যকে ‘গায়কী’ বলা হয়? শৈলজারঞ্জন মজুমদারের বক্তব্যের সূত্র ধরে এক কথায় বলা যায়, যা এই গানকে (রবীন্দ্র সংগীত) সম্পূর্ণতা দান করে, গানের ভাব ও রসকে তীব্রতর, গাঢ়তর করে তুলতে পারে, অলঙ্করণ, মীড় বা ছন্দের কোনো একটি নয় বরং সব কিছুরই অকৃত্রিম নিখুঁত সমাহার যা আপনা থেকেই গায়কের উপলব্ধির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ, রবীন্দ্র সংগীতের ক্ষেত্রে গায়কের উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশটাই হলো মুখ্য। শুদ্ধ সুরের যথাযথ অনুসরণ, তাল, লয় ও ছন্দের নিখুঁত প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয় তো রয়েছেই, সবকিছুর ওপর গায়কের গলায় যে জিনিসটি ফুটিয়ে তুলতে হবে তা হলো গানের কথার অন্তর্নিহিত ‘ভাব’; এটি কতটা জীবন্ত হয়ে উঠছে পরিবেশনায়, কতটা প্রাণসঞ্চার হচ্ছে বাণীর উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে তা-ই হচ্ছে প্রধান বিবেচ্য। আর এটিই রবীন্দ্র সংগীতের গায়কী।

বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত সম্পর্কে যাঁরা খোঁজ-খবর রাখেন তাদের হয়তো মনে আছে, ১৯৯৬ সালের শেষদিকে ‘ঢাকা’ ব্যান্ডগ্রুপের কর্ণধার ও প্রধান গায়ক মাকসুদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথের ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ গানটি তার নিজস্ব ‘স্টাইলে’ পরিবেশন করেছিলেন; তা নিয়ে বোদ্ধা মহলে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। ওই সময়ের জনপ্রিয় দৈনিক মতিউর রহমান (বর্তমানে প্রথম আলোর সম্পাদক) সম্পাদিত ‘ভোরের কাগজ’-এ গানটির পরিবেশনা নিয়ে মাকসুদ সাহেবের পক্ষের ও বিপক্ষের লোকজনের নানা মন্তব্য প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছিল। একদিন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার মাকসুদ সাহেবকে সমর্থন করে বিশাল এক প্রবন্ধ লিখলেন। ভোরের কাগজের মাঝের পাতায় তা সাড়ম্বরে প্রকাশিত হলো।

প্রবন্ধের সব কথা মনে নেই, তবে তিনি যে ‘রক’, ‘পপ’, ‘জ্যাজ’ ইত্যাদি সংগীতের উদাহরণ টেনে রবীন্দ্র সংগীতের ‘আধুনিকীকরণ’ ও ‘বৈশ্বিকরণ’-এর স্বপক্ষে জোরালো বক্তব্য রেখেছিলেন— তা বিলক্ষণ মনে আছে। সম্ভবত পরের দিন বা একদিন পরেই বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক সমআয়তনের একটি প্রবন্ধে ফরহাদ মজহারের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং রবীন্দ্র সংগীতকে ‘দেশীয় সংগীতবৃক্ষের বীজ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন যে, আমাদের দেশীয় ধানের মতো রবীন্দ্র সংগীতকেও দেশীয় সংগীত হিসেবেই বিকশিত হতে দিতে হবে, ‘আধুনিকীকরণ বা বৈশ্বিকরণ’-এর নামে এর কোনো ধরনের পরিবর্তন করা যাবে না। সেটা সুরের ক্ষেত্রেই হোক বা স্টাইলের ক্ষেত্রেই হোক। তার ক্ষুরধার বক্তব্য ও বিভিন্ন রেফারেন্স পড়ে অভিভূত হয়েছিলাম।

নচিকেতা প্রমুখদের গানটি শুনে কেউ একজন মন্তব্য করেছেন যে, যেহেতু রবীন্দ্র সংগীতের শতবর্ষ পার হয়ে গেছে তাই এর সুরেও পরিবর্তন করা যায়। এই বক্তব্যটি কি সঠিক? এ বিষয়ে আইন সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। আমি যতদূর জানি আমাদের দেশে লেখক/রচয়িতার মৃত্যুর তারিখ থেকে পরবর্তী ষাট বছর পর্যন্ত রচিত বিষয়ের ওপর তার ‘মেধাস্বত্ব’ থাকে। ভারতে তা ৫০ বছর, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় ৭০ বছর। মেধাস্বত্ব বা কপিরাইট হচ্ছে রচিত বিষয় থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রচয়িতা, তার উত্তরাধিকারী বা রচয়িতা-মনোনীত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের রয়্যালিটি পাওয়ার অধিকার, আর সেটি উঠে যাওয়া মানে হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় পরে আর উল্লেখিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট রচনা থেকে এককভাবে রয়্যালিটি পাওয়ার অধিকার রাখেন না। এই বিষয়কে কি মৃত্যুর পঞ্চাশ/ষাট/সত্তর বছর পর একজনের রচিত বা সুরারোপিত গানের কথা বা সুর পরিবর্তন করে ফেলার মতো বিষয়ের সঙ্গে এক করে দেখা যায়? তাহলে তো রচনাটাই পরিবর্তন করে ফেলা সম্ভব! কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব না থাকার অর্থ কি মূল রচনা পরিবর্তন করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া? বিষয়টি আইনজ্ঞদের সদয় বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করছি।

রবীন্দ্রনাথ তার রচিত ও সুরারোপিত গানকে পরিবর্তনের অধিকার দেননি। দিলীপকুমারের (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমার রায়) সঙ্গে গান সম্পর্কে আলোচনার এক পর্যায়ে কবি বলেছেন, ‘আমি তো নিজের রচনাকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে অনুমতি দেইনি… রচনা যে করে, রচিত পদার্থের দায়িত্ব একমাত্র তারই; তার সংশোধন বা উৎকর্ষ সাধনের দায়িত্ব যদি আর কেউ নেয় তাহলে কলাজগতে অরাজকতা ঘটে।’ জীবনসায়হ্নে রবীন্দ্রনাথ একবার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আজ বাংলাদেশে গানে একটা খেলোভাব এসে পড়েছে। কারণ, গান নিয়ে দোকানদারি প্রবল হয়ে পড়েছে। আমি তো ভীত হয়ে পড়েছি। দোকানের মালেতে দর অনুসারে বাঁকাচোরা করে তার রসটস চেপেচুপে চলেছে আমারই গান।’

গানের বিকৃতি কবির কাছে কতটা অসহনীয় ছিল আর তার শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য তিনি যে কতটা আকুল ছিলেন তা তার কথাতেই বোঝা যায়— ‘আমার গান যাতে আমার গান বলে মনে হয় এইটি তোমরা কোরো। আরও হাজারো গান হয়তো আছে-তাদের মাটি করে দাও-না, আমার দুঃখ নেই। কিন্তু তোমাদের কাছে আমার মিনতি–তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি। এখন এমন হয় যে, আমার গান শুনে নিজের গান কি না বুঝতে পারি না। মনে হয় কথাটা যেন আমার, সুরটা যেন নয়। নিজে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে, এ যেন অসহ্য। মেয়েকে অপাত্রে দিলে যেমন সব-কিছু সইতে হয়, এও যেন আমার পক্ষে সেই রকম।’

তার গান বিকৃত করে গাইলে কতটা ব্যথিত হতেন তা তিনি জানকীনাথ বসুকে লিখিত এক চিঠিতে অসহায়ের মতো উল্লেখ করেছেন— ‘আমার গান (গায়ক) তার ইচ্ছামতো ভঙ্গি দিয়ে গেয়ে থাকেন। তাতে তাদের স্বরূপ নষ্ট হয় সন্দেহ নেই। গায়কের কণ্ঠের ওপর রচয়িতার জোর খাটে না, সুতরাং ধৈর্য ধরে থাকা ছাড়া অন্য পথ নেই। আজকালকার অনেক রেডিও গায়কও অহংকার করে বলে থাকেন, তারা আমার গানের উন্নতি করে থাকেন। মনে মনে বলি পরের গানের উন্নতি সাধনে প্রতিভার অপব্যয় না করে নিজের গানের রচনায় মন দিলে তাঁরা ধন্য হতে পারেন।’

রবীন্দ্রনাথের গানে সুর-তাল-লয় ইত্যাদির বিশুদ্ধতা ও যথাযথ অনুসরণের পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়, তা হলো যন্ত্রের ব্যবহার। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে ঢালাওভাবে পাশ্চাত্যের যন্ত্র বাজানোকে রবীন্দ্র সংগীতবিশারদগণ সমর্থন করেননি, ‘বিশুদ্ধ ভারতীয় তারযন্ত্রের মধ্যে যেগুলি মীড় দিয়ে বাজানো হয়— যেমন এসরাজ, বেহালা, সেগুলো রবীন্দ্র সংগীতের সঙ্গে বাজানো যেতে পারে’ বলে তাঁরা মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা রবীন্দ্র সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্যের যন্ত্র যেভাবে বাজিয়ে চলেছি তাতে রবীন্দ্র সংগীতের স্বকীয়তা কতটুকু বজায় থাকছে সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। বাংলাদেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেল আছে যেখানে দিবারাত্র কেবলই সংগীত প্রচারিত হয়; সেখানে আমি দেশের অনেক প্রথিতযশা রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীকে কিবোর্ড, গিটার, ড্রামস ইত্যাদি পাশ্চাত্য যন্ত্রের সহযোগে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করতে দেখেছি যা তাদের সুনামের সঙ্গে বেমানান মনে হয়েছে। শিল্পীদের কেউ কেউ বলে থাকেন যে সনাতন পদ্ধতিতে গান করলে তা জনপ্রিয় হয় না, অর্থাৎ পাবলিক ‘খায়’ না। কাজেই রবীন্দ্র সংগীতকে পাশ্চাত্যের মোড়কে আবৃত করে পরিবেশন করলেই তা পাবলিক ‘খাবে’, মানে ব্যবসা সফল হবে। বোঝা যাচ্ছে যে, বাণিজ্য স্বার্থই এখানে প্রবল।

আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান রবীন্দ্র সংগীত বিশেষজ্ঞ ও গবেষক প্রয়াত ওয়াহিদুল হক সংগীতের বাণিজ্যিকীকরণ সম্পর্কে বলেছেন, ‘সংগীত প্রচার ও প্রসারের এখন সকল বৃহৎ মাধ্যমই অবিমিশ্র বাণিজ্যিক, রেডিও-টেলিভিশন-গ্রামোফোন-চলচ্চিত্র। এদের কল্যাণে রবীন্দ্র সংগীতেরও একটা বাণিজ্যিক সংস্করণ স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে এবং সাধারণ্যে এইটিই রবীন্দ্র সংগীতের একমাত্র এবং এই কারণে উত্তম রূপ বলে দাঁড়িয়ে গেছে।’ ওয়াহিদুল হক যখন এই লেখা লিখেছিলেন, তখন ভাগ্যিস ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ইত্যাদির এত ব্যাপক প্রসার ঘটেনি! হাজারটা টেলিভিশন চ্যানেল আকাশটাকে ছেয়ে ফেলেনি। যদি উনি দেখতে পেতেন টেলিভিশন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সর্বস্তরের শিল্পীদের কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীতের এই পরিণতি তাহলে উনি কী যে বলতেন তা অনুমান করতেও ভয় হয়।

পরিশেষে বলা যায়, যদি কোনো গায়ক রবীন্দ্র সংগীতের প্রচলিত আবহমান কাল ধরে চলে আসা ‘স্টাইল’কে পছন্দ না করেন তাহলে তার রবীন্দ্র সংগীত গাইবার দরকার নেই, তিনি অন্য গানে নিজেকে নিয়োজিত রাখুন; রবীন্দ্র সংগীতের প্রবহমান ধারাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা তার না করাই ভালো। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়— চাঁপা ফুল পছন্দ নয় ব’লে তাকে নিয়ে স্থলপদ্ম গড়বার চেষ্টা না করে সে স্থলে উচিত চাঁপার বাগান ত্যাগ করে স্থলপদ্মের বাগানে আসন পাতা। আর নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পী যারা রবীন্দ্র সংগীতকে ভুল সুরে এবং বিকৃত করে নিজস্ব গায়কীতে পরিবেশন করছেন, তাদের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য দিয়েই শেষ করি— ‘সংসারে যদি উপদ্রব করতেই হয় তবে হিটলার প্রভৃতির ন্যায় নিজের নামের জোরে করাই ভালো’।

তথ্যসূত্র:

০১. রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রসঙ্গ : শৈলজারঞ্জন মজুমদার

০২. গীতবিতান তথ্যভান্ডার : পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার

০৩. গীতবিতানের জগৎ : সুভাষ চৌধুরী

০৪. সঙ্গীত সংস্কৃতি (সাময়িকী)

০৫. বাংলাপিডিয়া

লেখক: রবিউল হাসান, ব্যাংকার ও রবীন্দ্র সংগীতানুরাগী।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

People will have to take to the streets for voting rights: Fakhrul

People will have to take to the streets like they did on August 5 to realise their voting rights, said BNP Secretary General Mirza Fakhrul Islam Alamgir today

17m ago