যুবরাজ সালমানের বিলাসী জীবন
অনেক বছর ধরে সৌদি রাজপরিবারের তথ্য অনুসন্ধান করেছেন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের দুই সাংবাদিক ব্র্যাডলি হোপ ও জাস্টিন শেক। গতকাল ১ সেপ্টেম্বর তাদের বই ‘ব্লাড অ্যান্ড অয়েল: মোহাম্মদ বিন সালমান’স রুথলেস কোয়েস্ট ফর গ্লোবাল পাওয়ার’ প্রকাশিত হয়।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক পোস্ট।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা প্রায় ১৫০ জন নারী মালদ্বীপের একটি ব্যক্তিগত দ্বীপে পৌঁছেন। মধ্যপ্রাচ্যের ‘কয়েক ডজন’ পুরুষের সঙ্গে পার্টি করতে সেখানে যান তারা।
সেই পার্টির আয়োজক ছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমান। তখন ২৯ বছর বয়সী সৌদি যুবরাজ দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব ছিলেন। বর্তমানে তিনি দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী, সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ও এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিদের একজন। তিনি বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকাতেও রয়েছেন।
তার আয়োজনে ২০১৫ সালের জুলাইয়ে মালদ্বীপের ‘ভেলা’ নামের একটি ব্যক্তিগত দ্বীপে প্রায় এক মাস ধরে পার্টি চলে। ‘ভেলা’কে বলা হয় ‘বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল ও ব্যয়বহুল’ দ্বীপ।
ওই দ্বীপে প্রায় চার ডজন ব্যক্তিগত বাগানবাড়ি আছে, অনেকগুলো ভারত মহাসাগরের নীল পানির ওপর নির্মিত।
কোয়ার্টারে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ডেক ও সুইমিং পুল আছে। অতিথিদের প্রত্যেকেই নিজস্ব গৃহ পরিচারিকা নিয়ে সেখানে এসেছিলেন।
এমনকি, সেখানে একটি তুষার মেশিনও আনা হয় যাতে করে দর্শনার্থীরা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সৈকতে কৃত্রিম বরফখণ্ড তৈরি করে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন।
ব্র্যাডলি হোপ ও জাস্টিন শেক তাদের বইয়ে লেখেন, ‘দ্বীপটি একজন যুবরাজের অবকাশ যাপনের জন্য উপযুক্ত।’
এমবিএস হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ বিন সালমান পুরো দ্বীপটি ভাড়া নিয়েছিলেন। দ্বীপটি ছিল তার ও তার অতিথিদের দখলে।
বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, এতে খরচ হয় প্রায় পাঁচ কোটি ডলার। সে সময় রিসোর্টের ৩০০ জনেরও বেশি কর্মীর প্রত্যেকে নগদ অর্থের টিপসের বাইরে পাঁচ হাজার ডলার করে বোনাস পেয়েছেন। তারা সাধারণত মাসে এক হাজার ডলার থেকে ১ হাজার ২০০ ডলার আয় করে থাকেন।
এমবিএস ও তার কর্মীরা গোপনীয়তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেজন্য খরচও করেছেন অনেক। এই পার্টিকে সংবাদপত্র থেকে আড়ালে রাখতে মরিয়া ছিলেন সৌদি যুবরাজ।
লেখকরা বইতে লিখেছেন, ‘এমবিএস জানতেন যে সৌদি আরবের তরুণরা শাসক পরিবারের কয়েক দশকের অযাচিত ব্যয়ের জন্য বিরক্ত।’
গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে, দ্বীপে কাউকে স্মার্টফোন আনতে দেওয়া হয়নি। যোগাযোগের জন্য তারা কেবল নোকিয়া ৩৩১০ মডেলের মোবাইল নিতে পেরেছিলেন। এই নিয়ম ভঙ্গ করায় দুই কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়।
দ্বীপে কয়েকজন কর্মীর দায়িত্ব ছিল আমন্ত্রিত মডেলদের অভিবাদন জানানো। নৌকাগুলো দ্বীপে পৌঁছানোর আগে, ওই নারীদের একটি মেডিকেল হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে তাদের যৌনরোগের পরীক্ষা করা হয়েছিল।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের দুই সাংবাদিক আরও জানান, ‘পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর নারীরা যখন তাদের বাগানবাড়িতে পৌঁছান, তখন মোহাম্মদ বিন সালমান ও তার বন্ধুদের বহনকারী সমুদ্র বিমানগুলো আসে।’
বিনোদনের জন্য পিটবুল, গ্যাংনাম স্টাইল গানের জন্য খ্যাত কোরিয়ান র্যাপার সাই ও ডিজে আফ্রোজ্যাকসহ বিশ্বজুড়ে বড় বড় শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানান এমবিএস।
ওই ব্যক্তিগত দ্বীপের সূত্র অনুযায়ী, জেনিফার লোপেজ ও শাকিরাও সেখানে পারফর্ম করেছেন।
দিনের বেশিরভাগ সময়ই আমন্ত্রিত অতিথিরা ঘুমিয়ে থাকতেন। সূর্য ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উত্সব শুরু হতো। তারা পার্টির জন্য প্রস্তুত হতেন।
ডিজে ও ব্যান্ডগুলো একটি পুলের মেঝেতে তৈরি ড্যান্স ফ্লোরে পারফর্ম করতেন।
এক রাতে, আফ্রোজ্যাকের পারফরম্যান্সের সময় এমবিএস এতটাই উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন যে তিনি স্টেজে চলে এসেছিলেন।
বইটিতে বলা হয়েছে, ‘এমবিএস যখন ডিজে টেবিলে যান এবং তার পছন্দসই রেকর্ড বাজাতে শুরু করেন তখন অতিথিরা উৎফুল্ল হন। তবে, আফ্রোজ্যাককে তখন বিড়বিড় করে কিছু বলতে বলতে দূরে সরে যেতে দেখা যায়। তার আওড়ানো বুলি যাতে যুবরাজের কানে না পৌঁছে সে ব্যাপারে সাবধান হন আফ্রোজ্যাক।’
পার্টি প্রায়ই ভোর পর্যন্ত চলতো।
কিছু ক্ষেত্রে এমবিএস তার নিজস্ব কর্মীদের ওপর নির্ভর করতেন— যেমন মদপান। এটি সৌদি আরবে নিষিদ্ধ।
মদপানের সময় দ্বীপের কর্মচারীদের দূরে রাখা হতো; ‘কারণ অন্য মুসলিম দেশের বাসিন্দারা তাদেরকে পান করতে দেখুক সৌদিরা এটা চান না।’
কম সময়ের মধ্যেই এমবিএসের উপস্থিতির বিষয়টি স্থানীয় পত্রিকায় ফাঁস হয়। সংবাদটি দ্রুত সবখানে ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর এমবিএস দ্রুত সেখান থেকে চলে যান। আমন্ত্রিত মডেলরাও চলে আসেন।
লেখকরা বলছেন, এই ঘটনাটি রাজ পরিবারকে ‘লো প্রোফাইল’ এ থাকার ব্যাপারে শিক্ষা দিয়েছে বলে মনে হয়নি। তবে এটি গোপনীয়তার গুরুত্বকে আরও শক্তিশালী করেছে।
এরপরই এমবিএস ‘দ্য সিরিন’ কেনেন। এটি ৪৩৯ ফুটের একটি জাহাজ, যা বিলাসবহুলতাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়।
জাহাজমালিক এক রাশিয়ান ভদকা ব্যবসায়ী ধনকুবেরকে জাহাজটির জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ দেন সৌদি যুবরাজ, যা প্রকৃত মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ।
জাহাজটির প্রায় ৪৮ হাজার বর্গফুটের ডকে গ্র্যান্ড সেন্ট্রালের চাইতেও বেশি জায়গা রয়েছে।
জাহাজটিতে দুটি হেলিপ্যাড, একটি সাবমেরিন ডক, একটি আন্ডার ওয়াটার রুম, একটি জাকুজি, একটি সিনেমা থিয়েটার ও একটি পিয়ানোর মতো সর্পিল সিড়ি ছিল।
বইতে আছে, ‘এটি চকচকে ও বিলাসবহুল। ভিআইপিদের আপ্যায়নের জন্য উপযুক্ত। বিশেষ করে, নিকট বন্ধুদের সঙ্গে রাতে পার্টি করার মতো একটি উপযুক্ত জায়গা।’
শুকনো জমিতে অবকাশ যাপনের জন্য এমবিএস ভার্সাইয়ের কাছে একটি আকর্ষণীয় ফরাসি দুর্গও কিনেছেন। যার দাম ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
সৌদি বাদশাহ সালমানের তৃতীয় স্ত্রীর প্রথম সন্তান সালমান বিন মোহাম্মদ। সৌদি বাদশাহর অষ্টম সন্তান তিনি।
তরুণ বয়সে তিনি স্কুবা ডাইভিং, ফাস্ট ফুড ও ভিডিও গেইম পছন্দ করতেন। ‘এজ অব এম্পায়ার’ সিরিজ তার পছন্দের ভিডিও গেইম।
অন্যান্য ভাইবোনের মতো তিনি স্কুলে পড়াশুনার জন্য বিদেশে- ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স যাননি। তিনি সৌদি আরবেই ছিলেন। এ কারণেই তিনি ‘রাজপরিবারের মধ্যে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বলতা সম্পর্কে গভীরভাবে’ জানতে পারেন।
তিনি ১৫ বছর বয়সে জানতে পেরেছিলেন যে, কয়েক দশক অফিসে থাকার পরও তার বাবা ‘তেমন সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেননি’। তিনি বিপৎজনকভাবে ব্যবসায়ীদের কাছে ঋণী হয়ে পড়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে এটিই প্রথম শক ও চ্যালেঞ্জ ছিল।’
এই আর্থিক উদ্বেগের কারণে এমবিএস অর্থ উপার্জনের উপায় খুঁজতে থাকেন।
একবার তিনি যুবরাজ হিসেবে এক অস্বাভাবিক অনুরোধ নিয়ে তার বাবার কাছে যান। বাবাকে তিনি দোকান খোলার কথা জানান। তার বাবা তখন এটা শুনে হেসেছিলেন।
তবে খুব দ্রুতই তিনি অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ধনী পরিবারের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া স্বর্ণের কয়েন ও বিলাসবহুল ঘড়ি বিক্রি করে প্রায় ১ লাখ ডলার জোগাড় করেছিলেন যুবরাজ সালমান। তা দিয়ে তিনি স্টক ব্যবসা শুরু করেন।
পরে তিনি নিজস্ব কোম্পানি চালু করেন। তিনি একটি ‘ট্র্যাশ কালেকশন’ ব্যবসা শুরু করেন। একটি গ্রুপ অব রিয়েল এস্টেট কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে, প্রায়শই তাকে নির্দয় হতে দেখা যায়।
লেখকরা বইতে জানান, তার দাবি করা এক টুকরো জমি তাকে দিতে অস্বীকৃতি জমির মালিককে গুলি করেন তিনি। এ কারণে তাকে ‘ফাদার অব দ্য বুলেট’ নামে ডাকা হয়।
সরকারি সংযোগগুলোও তার পকেট ভারি করতে সহায়তা করেছে। তিনি ও অন্যান্য রাজ পরিবারের সদস্যরা অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় জড়িত ছিলেন।
সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশটি রাজপরিবার দ্বারা শাসিত হয়েছে। তাদেরকে ক্ষমতা ভাগাভাগি ও ঐক্যবদ্ধ হতে হয়েছিল। তবে প্রায়ই তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়।
উত্থানের পর মোহাম্মদ বিন সালমান তার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে সব ক্ষমতা নিজের হাতে রাখার ব্যাপারে অপ্রতিরোধ্য প্রমাণিত হন।
তিনি শেষ পর্যন্ত সবাইকে ছাড়িয়ে সৌদি আরবের অঘোষিত শাসক হয়ে উঠেন। কয়েক মাস পর, ২০১৭ সালে ‘দুর্নীতি’র অভিযোগে রাজ পরিবারের অসংখ্য সদস্যকে কারাগারে যেতে হয়েছিল।
এক সূত্র জানায়, যুবরাজ সৌদি আরবের ‘ডি ফ্যাক্টো’ শাসক হয়ে উঠেছেন।
২০১৭ সালের নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়ার মতো দেশটির সাম্প্রতিক সংস্কারের পিছনে তার হাত আছে। তরুণ এই নেতার প্রভাব এবং ব্যয়বহুল জীবনযাপন দীর্ঘ সময় পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে।
বইতে লেখা হয়েছে, ‘স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য মোহাম্মদের হাতে এখনো অনেক বছর আছে। তিনি এখনও বাদশাহ নন। উত্তরাধিকার হিসেবে তিনি ১০, ২০ এমনকি ৩০ বছর পরও ক্ষমতায় আসতে পারেন।’
Comments