প্রবাসে

প্রবাসে পরদেশি

ক্রিশ্চিয়ানসান্দ শহর, নরওয়ে। ছবি: তারেক হাবিব

খুব শখ পৃথিবীটা ঘুরে দেখার। ছোটবেলায় একটা মানচিত্রের বই কিনেছিলাম পুরানো বইয়ের দোকান থেকে। নানান দেশের মানচিত্র, নিজ দেশের মানচিত্র, ট্রেন-বাস-উড়োজাহাজের পথনকশা দেখানো ছিল সেখানে। দেখতে দেখতে মনে মনে হিসেব করতাম, কীভাবে কোন পথে, কোন দেশে যাওয়া যায়। বই পড়তাম, সেবা প্রকাশনীর কিশোর ক্লাসিক, তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা এবং আরও সব বইটই পড়ে রকি মাউন্টেইন, প্যারিস, লন্ডন, নেপলস, কায়রো -- শহরের পর শহর ঘুরে ফেলছি আর আশা-আকাঙ্ক্ষারা ডালপালা মেলছে - হয়তো একদিন আমিও!

অবশেষে ভাগ্যের সিঁকে ছিড়লো, আমিও প্রবাসীর খাতায় নাম লেখালাম। অযুহাত পড়ালেখা, আসলে বিদেশ দেখা- নরওয়ে। গত বছর বর্ষার শেষ দিকে ঢাকার রানওয়ে থেকে উড়লাম, অসলোর মাটিতে পা রাখলাম বৃষ্টিতে ভিজেই। তবে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। আহা! স্বপ্নের বিদেশ ভ্রমণ, স্বপ্ন হলো সত্যি- এমনধারা অনুভূতি। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে নরওয়েতে বিদেশি ছাত্র হিসেবে আমার প্রবেশ- গন্তব্য দেশটির দক্ষিণের শহর ক্রিশ্চিয়ানসান্দ।

অসলোতে একরাত হোস্টেলে কাটিয়ে সকালে বাস ধরলাম ক্রিশ্চিয়ানসান্দের উদ্দেশে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার বাসযাত্রা। বেশ আরামদায়ক বাস, ভেতরে ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা। তবে ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো সরাসরি বাস সার্ভিস না, এদের দেশে বাস বিভিন্ন স্টপেজে থামে, যাত্রী ওঠানামা করায়। বেলা ১০টায় অসলো থেকে রওনা দিয়ে ক্রিশ্চিয়ানসান্দ বাস টার্মিনালে নামলাম বিকাল পৌনে ৩টায়। আমাকে পথ দেখিয়ে নেয়ার জন্য আগেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমার কলেজের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী সমন্বয়কারী মারি সাগুলিন।

বাস থেকে নেমেই তাকে দেখতে পেলাম। ক্রিশ্চিয়ানসান্দে আমাকে স্বাগত জানালেন, জিজ্ঞেস করলেন, পথে কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা। এরপর দুজনে আমার মালপত্র সমেত চার মিনিট হেঁটে পৌঁছে গেলাম শহরের লোকাল বাসের স্টপেজে। সেখানে দুমিনিট অপেক্ষার পর আমাদের বাস এলো- মারি আমার ও তার জন্য টিকিট কিনলেন। আমরা বাসে চড়ে পৌঁছে গেলাম আমার ছাত্রাবাসে। মূল শহর- যাকে এখানে লোকে বলে ডাউনটাউন বা সিটি সেন্টার এবং আমার কলেজ ক্যাম্পাসের প্রায় মাঝামাঝিতে আমার ছাত্রাবাসের অবস্থান। অর্থাৎ দুই জায়গা থেকেই আমার ডরমেটরির দূরত্ব প্রায় সমান- হেঁটে যাতায়াত করলে প্রায় ৩০ মিনিট।

দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশের ঢাকা থেকে চলে এলাম উত্তর ইউরোপের নরওয়ের ক্রিশ্চিয়ানসান্দে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের বেশিরভাগই এই শহরের নাম জানেন না। যেমনটি এখানকার অনেকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা রাখে না। এটি আয়তনের দিক থেকে নরওয়ের পঞ্চম বড় শহর, কিন্তু লোকসংখ্যা মাত্র ১,১২,০০০ যদিও নরওয়ের বিবেচনায় এটা বেশ বড় লোকসংখ্যা। রাজধানী অসলো থেকে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার দক্ষিণে নর্থ সি বা উত্তর সাগরের উপকূলে শহরটির অবস্থান। বাস, ট্রেন ও প্লেনে অসলো থেকে যাতায়াত করা যায়। তাছাড়া ডেনমার্কের সঙ্গে জাহাজ চলাচল করে, যদিও এরা এটাকে বলে ফেরি সার্ভিস। উত্তর সাগর পাড়ি দিয়ে ফেরিতে গাড়ি ও মানুষ পারাপার করে দিনে দুবার।

ক্রিশ্চিয়ানসান্দ শহরটি এক কথায় সুন্দর সাজানো-গোছানো একটি শহর। ঝকঝকে-তকতকে, কোথাও সামান্য আবর্জনা নেই, চারপাশে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। একদম ইউরোপীয় শহর বলতে যা বোঝায়। তবে, ইউরোপের শহরগুলোর মধ্যেও ফারাক আছে। উত্তর ইউরোপ আর দক্ষিণ ইউরোপ যেমন খুবই আলাদা তেমনি পার্থক্য আছে পূর্ব আর পশ্চিম ইউরোপের মধ্যেও। যাইহোক, ক্রিশ্চিয়ানসান্দ সম্পর্কে আরেকটু বলি, শহরটিকে নরওয়ের সামার-সিটিও বলা হয়, কারণ এর অনন্য আবহাওয়া। গোটা নরওয়ে যেখানে শীতে মুড়ে থাকে সেখানে ক্রিশ্চিয়ানসান্দের আবহাওয়া তুলনামূলক উষ্ণ। গরমে তাপমাত্রা গড়ে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (মে থেকে সেপ্টেম্বর) আর শীতে সাধারণত সর্বনিম্ন মাইনাস ফাইভ (-৫) ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। তবে কখনো কখনো মাইনাস ১৫ এমনকী ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও নেমেছে, এমন রেকর্ড আছে এখানে। তবে আবহাওয়ার বিচারে ক্রিশ্চিয়ানসান্দের আবহাওয়া নরওয়েতে সেরা।

ক্রিশ্চিয়ানসান্দ শহরের আরেকটি আকর্ষণ এর চিড়িয়াখানা। নরওয়ের সবচেয়ে বড় চিড়িয়াখানা এই শহরের উপকণ্ঠে। এর নাম দ্রি পারকেন- ইংরেজিতে মানে অ্যানিম্যাল পার্ক। চিড়িয়াখানা হলেও এটি মূলত এক ধরনের রিসোর্ট বা পর্যটন কেন্দ্র। গ্রীষ্মের ছুটিতে সারা নরওয়ে,এমনকী প্রতিবেশি ডেনমার্ক, সুইডেন ও ইউরোপের অন্য দেশ থেকে এখানে ভ্রমণকারীরা ছুটি কাটাতে আসেন। দ্রি পারকেনের খুব কাছেই পুরো স্ক্যানডেনেভিয়ার সবচেয়ে বড় শপিং কমপ্লেক্স সোরলান্দ সেন্তেরেত। বাংলাদেশে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স বা যমুনা সিটির মতো বড় বড় বিপনী, শো-রুম, ফুড কোর্ট দিয়ে সাজানো এই সোরলান্দ সেন্তেরেত।

ক্রিশ্চিয়ানসান্দ শহরকে নরওয়ের চিলড্রেন সিটিও বলা হয়ে থাকে- বিশেষ করে শহর ও আশপাশের এলাকায় প্রচুর বার্নাহাগে বা কিন্ডারগার্টেন এবং শিশু-কিশোরে জমজমাট পারিবারিক পরিবেশের কারণে। নরওয়ের অন্যতম নামকরা আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়টি এই শহরেই অবস্থিত- ইউনিভারসিটি অব আগডার। এটি ২০০৭ সালে নরওয়ের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩০০০ ছাত্রী-ছাত্রের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ক্যাম্পাস- একটি মূল শহরের সাথে, অন্যটি কিছুটা দূরে আরেকটি ছোট শহর গ্রিমস্তাদ-এ অবস্থিত। এছাড়া বেশকিছু পাবলিক ও বেসরকারি কলেজ আছে, আছে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

ক্রিশ্চিয়ানসান্দ শহরের আরেকটি বিশেষ পরিচতি আছে বাংলাদেশিদের জন্য- সেটা হলো এই শহরটি বাংলাদেশের রাজশাহী-র 'সিস্টার সিটি' বা ‘বোন শহর’ । এখানে বাংলাদেশের একটি মুরাল রয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে দেশের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। ক্রিশ্চিয়ানসান্দ-এ বাংলাদেশি কমিউনিটি খুবই ছোটো। এখানে এমনিতেই অভিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কম। তাছাড়া নরওয়েরে অন্যতম রক্ষণশীল এলাকা হিসেবে এই শহরের পরিচিতি রয়েছে।

তারপরেও বলতে হয়, এখানকার মানুষ অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত এবং সৎ। বিদেশে এসে বিশেষ করে নরওয়েতে আমার অন্যতম ভালোলাগার অভিজ্ঞতাটি হচ্ছে নরওয়েজিয়ানদের সততা এবং সরাসরি কথা বলার রীতি। নরওয়ের বাসিন্দারা ভালোকে ভালো এবং খারাপকে সরাসরি খারাপ বলে কোনো ভনিতা ছাড়াই। এখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক ধরনের সামাজিক প্রতিরোধ আছে- অর্থাৎ কেউ অন্যায় অপরাধ করলে সে সামাজিকভাবে এক ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। বলতে চাইছি, আমাদের দেশের মতো অন্যায় প্রশ্রয় দেয়ার সংস্কৃতি এদের নেই। সর্বোপরি, ক্রিশ্চিয়ানসান্দ শহরে এক বছর কাটিয়ে চমৎকার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। তবে দেশের চেয়ে বিদেশ ভালোবাসার না-- এই সত্য উপলব্ধি করার জন্যও বিদেশে পরদেশি হওয়ার অভিজ্ঞতা নিতে পারেন, এটা আমার মতামত।

(তারেক হাবিব, ক্রিশ্চিয়ানসান্দ, নরওয়ে)    

Comments

The Daily Star  | English

Jatiyo Party's office set on fire in Khulna

Protesters vandalised the Jatiyo Party office in Khulna's Dakbangla area last evening

1h ago