বঙ্গবন্ধু, দেশের মানুষই ছিল তার পৃথিবী
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, তিনি মাত্র ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন (১৯২০-১৯৭৫)। আর এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এত কিছু অর্জন করেছেন। দর্শন, সাহিত্য বা বিজ্ঞানের কোনো ক্ষেত্রে তার নাম লেখা নেই। কিন্তু, তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে মানুষের মনে।
তিনি এমন একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক মহাকাব্য নির্মাণ করে গেছেন, লাখো বাঙালি শুধু যার স্বপ্নই দেখতেন। এমন স্বপ্ন যে সত্যি হতে পারে, সাধারণের পক্ষে তা বিশ্বাস করা ছিল কঠিনতর।
তার জীবনের প্রথম ১৮ বছর যদি বেড়ে ওঠার সময়কাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে পরবর্তী মাত্র ৩৭ বছরে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন সাহসী-বিচক্ষণ, দৃঢ়চেতা চরিত্রের একজন মানুষ হিসেবে। তিনি এ দেশের মানুষের হৃদয়ে মুক্তির বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করেছেন। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক তথা সাধারণ মানুষকে পরিণত করেছেন একক রাজনৈতিক শক্তিতে। মানুষের মাঝে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার দাবি জানাবার সাহস বুনে দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পথে চলার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি নিজে বিশ্বাস করেছেন, মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছেন। আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগের মহিমায় আধুনিক রাজনীতির ইতিহাসে নিজেকে সফল রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তার ৫৫ বছরের জীবনে প্রায় ১৩ বছরই কেটেছে কারাগারে। যা পরিণত হওয়ার পর তার রাজনৈতিক জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময়। তিনি মাত্র দুই দশক সময়কালের মধ্যে এ দেশের মানুষকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য সংগঠিত করেছেন, দিক নির্দেশনা দিয়ে প্রস্তুত করেছেন।
এই অল্প সময়ের মধ্যে এটা করা সম্ভব? কারও মনে এমন প্রশ্ন জাগলে উত্তর যদি হয় — হ্যাঁ, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এটা একজন নেতার অর্জন হিসেবে অলৌকিকতার চেয়ে কম নয়।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো — তিনি শুরু থেকেই ছিলেন জনমানুষের একজন।
সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে সবসময়ই তার মন টানত। তিনি সহজাতভাবেই মানুষের প্রয়োজন বুঝতে পারতেন। তিনি তার বিদ্যালয়, পাড়ার ফুটবল ক্লাবের মতো জায়গাতেও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়া মানুষের মাঝে সমঝোতা করেছেন, তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের একত্রিত করতে পেরেছেন।
যেকোনো পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া ছিল তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। তার ব্যক্তিত্বের এই বিশেষ গুণের কারণে তিনি সব সময়ই যেকোনো পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন। নিজেকে একজন দায়িত্বশীল ও নির্ভরযোগ্য মানুষ হিসেবে পরিচিত-প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ফলে মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতো তার অবস্থান।
তিনি কখনোই কোনো দায়িত্ব নিয়ে উদাসীন বা ভুলে যেতেন না। যেকোনো বিষয়ে তিনি দায়িত্ব নিলে তার যথার্থ সম্মান রাখতেন। নির্ভরতার সঙ্গেই আসে বিশ্বাসের প্রশ্ন। তিনি তার স্বভাবজাত কৃতকর্ম দিয়ে বিশ্বাস অর্জন করেছেন। মানুষ তার কাছে যেতেন। এর পেছনে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি কাজ করেছে, তা হলো তার প্রতি মানুষের বিশ্বাস। সবাই চোখ বন্ধ করে তার ওপর নির্ভর করতে পারতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, জিন্নাহর বক্তৃতায় শিক্ষার্থী এবং জনরোষ তৈরি (‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’), ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক অধিকার, নির্বাচন না হওয়া, সামরিক শাসন এবং রাজনীতিবিদদের কোণঠাসা করে রাখার ফলে চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়েও যে তরুণরা পাকিস্তানের সমর্থক ছিল, তারা সেই দশকের শেষের দিকে বা পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে উদীয়মান বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমর্থকে রূপান্তরিত হন। এই সময়ে তিনি অনুভব করেন যে কেবলমাত্র আলাদা দেশ তৈরির মাধ্যমেই তার জনগণ সত্যিকারের মুক্তি পেতে পারেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার দেওয়া ২১ দফা কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রাথমিক, স্পষ্ট ও শক্তিশালী প্রতিফলন। এই রাজনৈতিক কর্মসূচির বাস্তবায়ন নতুন দেশ গঠনের নয় বছরেরও কম সময়ের মধ্যেই হয়েছে। এই দাবি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে উত্সাহিত করেছিল এবং আক্ষরিক অর্থেই রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগকে প্রায় বিলুপ্ত করে দিয়েছিল। একটি নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার দল এত অল্প সময়ের মধ্যে জনগণের কাছে এত বড়ভাবে প্রত্যাখ্যানের শিকার হওয়ার নজীর খুব বেশি নেই।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুবের অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী ১০ বছরের সামরিক শাসনের সময়টিই ছিল দৃঢ়, দূরদর্শী ও ব্যাপক জনপ্রিয় বঙ্গবন্ধুর নেতা হিসেবে উত্থানের সময়। বারবার কারাগারে যাওয়া, অন্তর্দর্শন এবং কারাগারে থাকাকালীন চিন্তার পরিপক্বতাই পরবর্তীকালে তার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তগুলোকে আরও দৃঢ় করেছে। তার বিশ্বাসের দৃঢ়তা বাড়ানোর পাশাপাশি বাড়িয়েছে তার মনের জোর। পরবর্তীতে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে তিনি পেয়েছেন পরিষ্কার ধারণা। তার এই দৃঢ়তা মানুষ দেখেছেন যখন লাহোরে একনায়ক আইয়ুব খানের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে তিনি ছয় দফা দাবি তুলে ধরেছেন।
ছয় দফার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হচ্ছে — দাবির বিষয়গুলো অত্যন্ত সহজ-সরল ও সাধারণের কাছে বোধগম্য। নিপীড়িত জনগণের মুক্তির সনদ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় ছয় দফায় স্থান পেয়েছিল। যার ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছয় দফা জনগণের স্বপ্নে পরিণত হয়। বিশেষ করে তখন, যখন পাকিস্তানি শাসকরা এই দাবিকে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করে।
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ করা হয়েছিল। এটি ছিল রাজনৈতিক বিভ্রান্তির এক সর্বোত্তম উদাহরণ। জেনারেল আইয়ুবের পরিকল্পনা ছিল, ভারতের সহায়তায় পাকিস্তানকে ভাগ করা হচ্ছে — এমন অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে দোষী সাব্যস্ত করা। সে লক্ষ্যে সরকার নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানি গণমাধ্যম প্রতিদিনই এ জাতীয় খবর প্রকাশ করছিল, যাতে দেশের সাধারণ মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। সে সময় রেডিও ও টেলিভিশন সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ছিল।
এখানেই তার প্রতি মানুষের কতটা ‘বিশ্বাস’ তা ফুটে ওঠে। কারণ, জনগণ শেখ মুজিবকে বিশ্বাস করেছিলেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা যা চেয়েছিল, হয়েছিল তার ঠিক উল্টো। শেখ মুজিবের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার পরিবর্তে দূরত্ব আরও কমে যায়। আরও বেশি মানুষ তার পাশে এসে দাঁড়ান এবং তার আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। তিনি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যান এবং তাকে ভূষিত করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে।
পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি কারাগারে বন্দী করে রাখা, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, আমাদের দেশ ও দেশের জনগণের বিপর্যস্ত পরিণতি, ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থী, যুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা, বিশেষত ইন্দিরা গান্ধীর উজ্জ্বল ভূমিকা, সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে আমাদের স্বাধীনতা ও পূর্ণ বিজয় অর্জন, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশে ফিরে আসার বিষয় সবারই জানা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। হত্যাকারীরা পুরস্কৃত হয়েছে, বিচার বা জবাবদিহিতার আওতায় আসেনি। সেই দুঃসহ বিভীষিকাময় রাতে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটে যাওয়া সেই দুঃসহ রাতটির স্মরণেই আমরা পালন করি জাতীয় শোক দিবস।
আমরা যারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে রেডিওতে শুনেছি ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’, তারা নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি। যার হাত ধরে দেশে স্বাধীনতা এল, সেই স্বাধীন দেশে তাকেই এমন ভাগ্য বরণ করতে হলো!
রয়্যাল এয়ার ফোর্সের প্রতি চার্চিল শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বলেছিলেন, ‘মানব ইতিহাসে এত কমসংখ্যক মানুষের কাছে এত বেশিসংখ্যক মানুষ ঋণী ছিল না।’ শেখ মুজিবকে নিয়ে আমরা বলতে পারি, মানব ইতিহাসে একজন মানুষের কাছে একটি জাতির এতটা ঋণী থাকা নজীরবিহীন।
আমার বিনীত দৃষ্টিতে, এটি বলা অত্যুক্তি হবে না যে শেখ মুজিব কেবল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বই দেননি, তিনি ছিলেন এর ধারক, পরিকল্পনাকারী, উদ্যোক্তা এবং সর্বোপরি স্বপ্ন দ্রষ্টা। এ দেশের যুবসমাজ আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছে বলেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। এই সত্য সব সময় মনে রাখতে হবে যে, ভালোবেসে যাকে আমরা বঙ্গবন্ধু বলে ডাকি তিনি না থাকলে একাত্তরে আমরা একটি স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না।
প্রশ্ন হলো, কেন তাকে পরিবারের এতজন সদস্যসহ হত্যা করা হলো? কেন এমন এক নৃশংস কায়দায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো? কী অপরাধ ছিল তার? স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরিতে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধেই তাকে এমন নির্মমভাবে আমাদের মাঝে থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো? এটা ছাড়া আমি আর কোনো কারণ খুঁজে পাই না। যারা তাকে হত্যা করেছিল, তারা বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সে সম্পর্কে আমাদের কোনো সন্দেহ থাকা উচিত না।
বঙ্গবন্ধুর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণ করে আমাদের অবশ্যই উচিত তার স্বপ্ন, আমাদের স্বপ্ন এবং লাখো শহীদের কাছে করা আমাদের প্রতিশ্রুতির সোনার বাংলা গড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়া।
সেই সোনার বাংলা কেমন হবে? অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে সেদিকে অনেকটা পথ আমরা এগিয়েছি। কিন্তু, আমাদের সোনার বাংলা হবে স্বাধীনতা, সাম্য, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, মানবাধিকার, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মর্যাদার অধিকার এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রের।
আমরা যখন ‘কৃত্রিম গণতন্ত্রের’ সঙ্গে উন্নয়নের বিতর্ক তৈরি করি, তখন আমাদের জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি অবমাননা করা হয়। গণতন্ত্র না থাকলে উন্নয়ন আসে না। কারণ, উন্নয়ন অর্থ শুধু রাস্তাঘাট, সেতু ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা না। বরং জনগণকে স্বাবলম্বী ও আত্মবিশ্বাসী করার মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতা বজায় রাখা। যা স্থায়ী মানব উন্নয়নের মাধ্যমে করা সম্ভব। এটিই উন্নয়নের একমাত্র এবং আসল পরিমাপক।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বছর এবং শাহাদতের ৪৫তম বার্ষিকীতে আসুন আমরা নিজেদের উৎসর্গ করি তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
Comments