ভুলে যাওয়া অযোধ্যার পুরোহিত, হারিয়ে ফেলা পথ

বাবা লাল দাস। ছবি: সংগৃহীত

এই লেখাটি শুরু করার ঠিক আগেই সংবাদে পড়লাম অযোধ্যা রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

তারও আগে দেখলাম ইউটিউব চ্যানেলে এই মন্দির নির্মাণের রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে ১৯৯২ সালের একটি তথ্যচিত্র, ‘রাম কে নাম’। নির্মাতা আনন্দ পটবর্ধন।

তবে আমার লেখাটা মন্দির বা মসজিদ কোনোটাই নিয়ে নয়। বরং আমার আগ্রহের জায়গায় আছেন একজন মানুষ। তিনি বাবা লাল দাস।

যে তথ্যচিত্রটির কথা বললাম সেখানে বিজেপি নেতা আদভানির ‘রথযাত্রা’ আর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের রাম মন্দির নির্মাণের পক্ষে উগ্র প্রচারণা দেখানোর পাশাপাশি যাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় লাল দাস তাদের একজন।

চলচ্চিত্রটির প্রকাশ্যে প্রদর্শন শুরু হওয়ার দুই বছর পরে তাকে খুন করা হয়— দিনটি ছিল নভেম্বর ১৬, ১৯৯৩। আজকাল তার কথা তেমন একটা বলা হয় না।

১৯৪৯ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদে সবার অগোচরে শিশু রামচন্দ্রের যে মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল তার কোর্ট-নিযুক্ত প্রধান পুরোহিত এই লাল দাস। আশির দশকের গোড়া থেকেই তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন বলে ভারতীয় গণমাধ্যম থেকে জানা যায়।

আদভানির সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো ‘রথযাত্রার’ কট্টর বিরোধী এই পূজারী ধর্মের রাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলেন। অনেকেই মনে করেন এ জন্যই জীবন দিতে হয়েছে তাকে।

১৯৯১ সালের জুনে বিজেপি উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার ৪১৯টি আসনের অর্ধেকেরও বেশি জিতলে কল্যাণ সিং হন মুখ্যমন্ত্রী। এরপর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তাদের রাম মন্দির নির্মাণের মহাপরিকল্পনার দুটি ‘বাধা’ চিহ্নিত করে। একটি বাবরি মসজিদ, আরেকটা লাল দাস স্বয়ং। অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য অয়ার এর একটি লেখায় এমন তথ্যই উল্লেখ করা হয়েছে।

১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদ ভাঙার কয়েক মাস আগে কল্যাণ সিংহ প্রশাসন লাল দাসকে প্রধান পুরোহিতের পদ থেকে সরিয়ে দেয়।

এছাড়াও, টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘আদভানিকে যাত্রা থামাতে বলেছেন পুরোহিত’।

‘রাম কে নাম’ চলচ্চিত্রের জন্য অক্টোবর ৩০, ১৯৯০ তারিখে লাল দাসের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মন্দির নির্মাণের মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি অকপটে বলেন, এটি একটি রাজনৈতিক খেলা।

‘যারা এটি করতে চান তারা হিন্দু ভোটকে নগদ করার জন্য আসলে ভারতজুড়ে উত্তেজনা তৈরি করতে আগ্রহী। এ কারণে যে গণহত্যার ঘটনা ঘটবে তা নিয়ে তারা চিন্তা করে না— কত জন নিহত হবে, কতটা ধ্বংস হবে, এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে হিন্দুদের কী হবে তা নিয়েও তারা চিন্তা করে না।’

তবে এর বিপরীতে কয়েকজনের সাক্ষাৎকার আছে এই চলচ্চিত্রে। যাদের কথা শুনলে মনে হবে ঘৃণাই তাদের শেষ সম্বল এবং সেটা ছড়ানোই তাদের একমাত্র কাজ। এমনও বলা হলো যে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা ঠিক ছিল। দরকার হলে তারা সবাই খুনি নথুরাম গডসে হয়ে যাবে।

সব ধর্মেই এমন লোক আমরা পেয়েছি, যুগে যুগে ইতিহাসের নানা বাঁকে। এই উপমহাদেশের মানুষ এদের খুব ভালো করেই চিনেছে এতোদিনে।

তবে পূজারী লাল দাস শান্তির বাণীই শুনালেন। বললেন, ১৯৪৯ সাল থেকে কোনো মুসলিম সেখানে কোনো সমস্যা তৈরি করেনি। কিন্তু, যখন এই মানুষগুলো চিৎকার করতে শুরু করেছিল, ‘বাবরের পুত্রদের অবশ্যই তাদের রক্ত দিতে হবে’ তখন পুরো জাতি দাঙ্গায় লিপ্ত হয়, মারা যায় মানুষ। তবুও তারা তৈরি হওয়া উত্তেজনার জন্য কোনো অনুশোচনা বোধ করেনি।

‘এখনো অবধি, আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য আছে।’

তিনি মনে করেন, যে সমস্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সেগুলো ছিল আর্থিক ও রাজনৈতিক লাভের জন্য, এ ছাড়া আর কিছু না।

এই পুরোহিত হিন্দুত্ববাদী নেতাদের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, এটা কি রামের আদর্শ যে মানুষকে অনাহারে মরতে হবে? আমাদের দেশে এই বড় বঞ্চনা- আমাদের ধর্মীয় নেতাদের কি এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়? যদি আপনার কাছে অর্থ থাকে বা ধনী লোকেরা আপনার কথা শুনে, আপনি কি সেই অর্থ দরিদ্রদের সাহায্য করার জন্য ব্যবহার করবেন না?

রাম মন্দির বানানোর উন্মাদনার তিনি একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দেন, রামায়ণকে আশ্রয় করে। ‘যখন ভারী বৃষ্টিপাত হয়, তখন ঘাস এত লম্বা হয় যে সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন।’

কেউ যদি নেশা করে, তবে সে যে কোনো কিছু করতে সক্ষম। সে পাগল হতে পারে, যে কাউকে আক্রমণ করতে পারে, এমনকি আত্মহত্যাও করতে পারে। উন্মাদনার মুহূর্তে চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।

‘তবে বর্ষাকাল ক্ষণস্থায়ী। এরপরে লোকেরা যুক্তির পথ খুঁজে পায়।’

লাল দাসের জীবনটাও দীর্ঘ না। আর তেমন কেউ তাকে মনেও রাখেনি। কিন্তু, তার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা শুধু অযোধ্যাই না, এই পুরো উপমহাদেশের জন্য সবসময় প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ।

কেননা, দিন শেষে মানুষ চায় একটু খাবার আর একটু শান্তি।

শাহতাব সিদ্দীক অনীক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Abdul Hamid returns home after treatment in Thailand

Two police officials were withdrawn and two others suspended for negligence in duty regarding the former president's departure from the country

3h ago