বাবার জন্য, মুক্তির জন্য
দিনটা ছিল বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস আর এমন দিনেই মনোরম পলককে দেখতে হয় তার সাংবাদিক বাবাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জেলে।
এর আগের ৫৩ দিন পরিস্থিতি ছিল আলাদা— যখন শফিকুল ইসলাম কাজল নিখোঁজ ছিলেন। উদ্বেগ, অপেক্ষা ও অনিশ্চয়তা। আর এখন তার সন্ধান পাওয়ার পর এ এক ভিন্ন লড়াই।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই ইতোমধ্যে পলকের একটি ছবি দেখেছেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে আছেন প্ল্যাকার্ড হাতে, তাতে লেখা ‘আমার বাবা কাজলের মুক্তি চাই’।
বাবার মুক্তির দাবিতে এই তরুণ শুরু করেছেন খুব সাধারণ কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত ও সৃজনশীল এক প্রতিবাদ কর্মসূচি যার শিরোনাম ‘কাজলের মুক্তি এবং মুক্তচিন্তা’।
সপ্তাহব্যাপী এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনি প্রত্যেককে বিনীত অনুরোধ করেছেন যার যার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে জুলাই ২১ থেকে জুলাই ২৭ পর্যন্ত একটি সাদা কাগজে Free Kajol লিখে হ্যাশট্যাগ (#freekajol) সহ পোস্ট করতে।
সাড়ে তিন লাখেরও বেশি মানুষ সাড়া দিয়েছেন পলকের এই আহবানে। সংহতি জানিয়ে ফেসবুকে লাইভে হয়েছে গান আর আলোচনা; শাহবাগেও হয়েছে সমাবেশ।
কয়েকদিন আগে ফেসবুকে পলক লিখেছিলেন, ‘আমার সাংবাদিক এবং সম্পাদক বাবা আজ ১৩৪ দিন হলো বাসায় ফিরতে পারেননি। আমরা তার সঙ্গে দেখাও করতে পারছি না… আমি আজ জেলের গেট থেকে ফিরে এসেছি। আমার বাবার অপরাধ তিনি একটি জাতীয় দৈনিকের একটি সংবাদ শেয়ার করেছেন।’
পলকের বয়স খুব বেশি না। সবে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সঙ্গত কারণেই অসহায় বোধ করেন মাঝে-মাঝেই। ঠিকমত ঘুমাতে পারেন না, খেতে পারে না, আগের নিয়মিত কাজগুলো করতে পারছেন না।
এমনিতেই এখন পুরো দেশ এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের হানা, সঙ্গে বন্যা— সব মিলিয়ে এমন সঙ্কট কেউ দেখেনি কোনদিন। এই মহামারি পলকের পরিবারকেও করেছে বিপর্যস্ত। তার মা ছিলেন একজন গবেষণা সহকারী। করোনা আসার পর তিনি তার চাকরিটি হারিয়েছেন।
গত শনিবার এই লেখকের সঙ্গে আলাপচারিতায় পলক বলেন, তিনি এখন আর তার মা ও বোনের চোখের দিকে তাকাতে পারেন না। অনেকদিন হয়ে গেল কারো মুখে হাসি নেই, বাড়িতে নেই আনন্দ।
কাজল একজন ফটোসাংবাদিক, সেই সঙ্গে দৈনিক পক্ষকালের সম্পাদক। গত মার্চ ১০ সন্ধ্যায় হাতিরপুলের অফিস থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন।
এর বেশ-বেশ কয়েক দিন পর তার মোবাইল ফোনটি বেনাপোলে সক্রিয় অবস্থায় পাওয়া যায় বলে জানিয়েছিলেন এক তদন্তকারী কর্মকর্তা।
মে মাসের তিন তারিখে কাজলের ‘সন্ধান’ পাওয়ার পরপরই তাকে গ্রেপ্তার করে বেনাপোল পুলিশ— প্রথমে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে ও পরে সন্ধ্যায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার অধীনে। তারপর তাকে যশোর কারাগারে পাঠানো হয়।
এরপর তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে দায়ের করা তিনটি মামলায় আসামি করা হয়। সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা এখন পাঁচ।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন এই আইন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পরিপন্থি।
‘এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক,’ বলছেন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা নূর খান লিটন।
তিনি বলেন, ‘এই মহামারি চলাকালে একজন সাংবাদিককে অপহরণ করা হলো এবং তার উদ্ধারের জন্য সব মহলের আহ্বান সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান প্রচেষ্টা দেখা গেল না।’
‘পরে তাকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে উদ্ধার করা হয়, যা অনেকের কাছেই একটি সাজানো নাটক বলে মনে হয়। তবে যাই হোক না কেন, কাজলকে অন্তত জামিনে মুক্তি দেওয়া যেতে পারত,’ যোগ করেন তিনি।
তার মতে, ‘যখনই ক্ষমতাবান কেউ কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতি উৎসাহের কারণে এরকম “নাটক” মঞ্চস্থ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।’
পলকও জানান, তার বাবার বিরুদ্ধে মামলাগুলো রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা তিনি বুঝতে পেরেছেন। তার মন্তব্য, ‘সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে আমার বাবা নিখোঁজ হওয়ার পরও কর্তৃপক্ষ একটি বিবৃতিও দেয়নি। এখন আপনারা বাকিটা বুঝে নেন।’
তিনি আরও জানান, সম্প্রতি তার মা ও বোনকে নিয়ে তিনি কেরানীগঞ্জ জেলে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যান, কিন্তু পারেননি। শেষবার তিনি বাবাকে দেখেছিলেন মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে, যশোরে।
‘আমার বাবা ঠিক কেমন আছেন, আমি জানি না,’ বলেন পলক।
কাজলকে মুক্তির দাবিতে হওয়া কর্মসুচিতে অংশ নেন সাংস্কৃতিক কর্মী অমল আকাশ। তিনি এই লেখককে বলছিলেন, ‘একজন বাবার দুম করে গুম হয়ে যাওয়া এখন আর নতুন কিছু নয়। একজন সাংবাদিককে যে কোনো সময় জেলহাজতে পাঠিয়ে দেওয়া সেতো এখন রীতিমতো রাষ্ট্রের আইনি অধিকার। কিন্তু, রাষ্ট্রকে এই অধিকার কে দিলো?’
তিনি আরও বলেন, ‘কোনো সরকারের যদি জনগণের প্রতি আস্থা না থাকে তখন সে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ভয় পায়। তখন সে সাংবাদিকসহ সমাজের সব সত্যদর্শীর চোখে রঙিন চশমা পরিয়ে দিতে চায়, সব প্রতিবাদের ভাষা গলা টিপে স্তব্ধ করতে চায়। কিন্তু, তা কি শতভাগ সম্ভব?’
অমল আকাশ মনে করেন, মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস তা বলে না।
‘তবু তো দেখি কেউ না কেউ কথা বলছেই! তাদেরই দলের লোক সাংবাদিক কাজল। আর রাষ্ট্র জানে না, কাজলকে জেলে পুরলে কাজলের ছেলেরা কথা বলা শুরু করে। সে আওয়াজ আপাত মনে হয় ক্ষীণ, কিন্তু তার প্রতিচ্ছাপ পড়তে থাকে সমাজের ভেতরে ভেতরে, যা যে কোনো সময় বিস্ফোরণে রূপান্তরিত হতে পারে। আর এটা ভীষণ ভয়ের কারণ রাষ্ট্রের জন্য। তাই তারা ডিজিটাল আইনের মতো নিপীড়নমূলক আইন তৈরি করে। আজকে এর বিরুদ্ধে আমাদের সবার আওয়াজ তোলা উচিৎ,’ বললেন এই গায়ক।
‘আমাদের ভয়কে জয় করে জানান দিতে হবে, কাজলের সন্তান শুধু পলক একা নয়, আজকের বাংলাদেশের অধিকাংশের সন্তানই আসলে কাজলের সন্তান। আর তরুণরাই সবচাইতে সাহসের পরিচয় দিয়ে এসেছে যুগে যুগে। তারা এসে পলকের পাশে দাঁড়ালে পাল্টে যেতেই পারে সব হিসাব-নিকাষ। আমরাও বলতে চাই পলক, তোমার বাবার মুক্তির লড়াই শুধু একজন পিতার মুক্তির লড়াই নয়, আমার বাকস্বাধীনতার মুক্তির লড়াই, গণতন্ত্র মুক্তির লড়াই। আর সে লড়াইয়ে আমাদেরও পাবে তুমি তোমার পাশে,’ যোগ করেন আকাশ।
এখন পর্যন্ত যে তিনি তার বাবাকে মুক্ত করতে এই কর্মসূচিটি চালাতে পারছেন, সে জন্য পলক সবার কাছে কৃতজ্ঞ প্রকাশ করেন।
‘আমার একটিই দাবি— তা হলো আমার বাবার মুক্তি এবং অন্য কিছু নয়। তিনি ফিরে আসলেই শেষ হবে এই ক্যাম্পেইন।’
তিনি মনে করেন যে এই প্রচারণার সবচেয়ে বড় শক্তি এটি আন্তরিক এবং আর এটা খুব ভালো করে বুঝিয়ে দেয় নিপীড়ন একটা পরিবারকে কী করতে পারে।
‘আমি আমার বাবার জন্য অনেক কিছু করার চেষ্টা করছি, তবুও কিছুই যেন যথেষ্ট না,’ তিনি আরও বলেছিলেন। ‘বাবা যখন ফিরে আসবেন, অন্তত এই প্রতিবাদ দেখে হয়ত কিছুটা সান্ত্বনার পাবেন।’
পলক বলেন, তিনি সব কিছুই নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই করতে চান, যদি প্রতিবাদ হয় সেটাও।
‘প্রতিদিন যেন আমি আমার বাবার মুক্তির দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছি। বুকে কষ্ট চেপে হলেও আমি কিন্তু আশাবাদী,’ এমনভাবে দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করলেন কাজলের ছেলে পলক।
Comments