সাদাকালো যুগের সিনেমার কয়েকটি কালজয়ী গান

এই উপমহাদেশে সিনেমার প্রাণ হচ্ছে গান। সিনেমায় গল্প থাকে, নাচ থাকে, কমেডি থাকে, অ্যাকশন থাকে, গানও থাকে। গান একটি সিনেমাকে খুব দ্রুত দর্শকদের কাছাকাছি নিয়ে যায়। সিনেমার কোনো গান হিট হলে সেই সিনেমা বেঁচে থাকে যুগের পর যুগ।
বাংলাদেশের সোনালি দিনের কিছু সিনেমার গান আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে মানুষের কাছে। আজও সেই সব গান এতো বছর পরও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সেই সব কিছু কালজয়ী গান নিয়ে এই ফিচার।
চোখ যে মনের কথা বলে— এই গানটির সঙ্গে এ দেশের মানুষের পরিচয় বহু বছরের। সোনালি দিনের আলোচিত একটি সিনেমার গান এটি। সিনেমার নাম ‘যে আগুনে পুড়ি’। নায়ক-নায়িকা হিসেবে ছিলেন রাজ্জাক ও সুচন্দা। গানটি গেয়েছেন খন্দকার নুরুল আলম। সিনেমাটির পরিচালক আমির হোসেন।
আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন আরেকটি ভীষণ জনপ্রিয় সিনেমার গান। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় গানটির বয়স। এখনো গানটির আবেদন কমেনি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আসছে, গানটির জনপ্রিয়তা রয়েই যাচ্ছে। কাউকে এই গানটির কথা বলা হলে গানের কথা ঠিকই বলতে পারবেন। সিনেমার নাম হয়ত বলতে পারবেন না। এটি ‘নাচের পুতুল’ সিনেমার গান। রাজ্জাক ও শবনমের লিপে ব্যবহার হয়েছে গানটি। ‘আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন’ গানটি ‘স্বরলিপি’ সিনেমার। গানটিতে কন্ঠ দিয়েছেন মাহমুদুন নবী।
গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে গানটিও বাংলাদেশের সোনালি দিনের সিনেমার একটি ব্যাপক জনপ্রিয় গান। সত্তর দশকের এই গানটি আজও মানুষকে মুগ্ধ করে। এটিও ‘স্বরলিপি’ সিনেমার গান।
বিখ্যাত এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা। রাজ্জাক ও ববিতা জুটির অন্যতম সফল একটি সিনেমা ‘স্বরলিপি’। সিনেমাটির পরিচালক নজরুল ইসলাম।
চুমকি চলেছে একা পথে দেশের সোনালি দিনের সিনেমার আরও একটি জনপ্রিয় গান। ‘দোস্ত দুশমন’ সিনেমার গান এটি। নায়ক নায়িকা ছিলেন শাবানা ও ওয়াসিম।
খুরশিদ আলমের গাওয়া গানটির আবেদন এখনো অনেক। ‘দোস্ত দুশমন’ সিনেমায় এই গানটির দৃশ্য এই রকম— শাবানা ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল চালিয়ে আসছেন ওয়াসিম। সেই সময় ওয়াসিম গানটি করেন শাবানার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য।
‘দোস্ত দুশমন’ সিনেমাটির পরিচালক দেওয়ান নজরুল। সংগীত পরিচালক আলম খান। ওয়াসিম ও শাবানা ছাড়াও এই সিনেমায় আরও নায়ক-নায়িকা ছিলেন সোহেল রানা ও সুচরিতা।
তুমি যে আমার কবিতা এই রোমান্টিক গানটি শুনেননি এরকম শ্রোতা কমই পাওয়া যাবে। সাদাকালো যুগের সিনেমার সময়ে এই গানটি শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্র শোনা যেত। এতো বছর পরও গানটি তরুণ-তরুণীদের কাছে জনপ্রিয়। রাজ্জাক ও কবরীর লিপে ব্যবহৃত গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন মামুদুননবী ও সাবিনা ইয়াসমিন। সিনেমার নাম ‘দর্পচূর্ণ’। পরিচালনা করেন চাষী নজরুল ইসলাম।
রাজধানীর বুকে সিনেমার একটি গান তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় আগের গানটি এখনো প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে প্রিয় গানের তালিকায় রয়ে গেছে। গানটি হচ্ছে— তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো, চাঁদ বুঝি তাই জানে।
ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান নায়ক রহমানের লিপে গানটি ব্যবহার হয় ‘রাজধানীর বুকে’ সিনেমায়। এই সিনেমায় রহমানের নায়িকা ছিলেন শবনম। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন তালাত মাহমুদ।
‘নীল আকাশের নীচে’ সিনেমার গান নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন খন্দকার ফারুক আহমেদ। নায়করাজ রাজ্জাক গেয়েছেন গানটি। সিনেমাটির পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা।
‘ওয়াদা’ সিনেমার যদি বউ সাজো গো আরও সুন্দর লাগবে গো। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা ও খুরশিদ আলম। এতে অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ ও ববিতা।
কাজী জহির পরিচালিত ‘বধূ বিদায়’ সিনেমার একটি গান বেশ সাড়া ফেলেছিল। গানটি হলো একটুশ খানি দেখো– একখান কথা রাখো। এতে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। কবরীর লিপে এটি ব্যবহার হয়। অভিনয় শিল্পীরা হলেন: কবরী, বুলবুল আহমেদ ও শাবানা।
রহমান ও আনোয়ারা জুটি হয়ে ‘অংশীদার’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। সেই সিনেমার একটি গান আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। গানটি হলো: ‘তোমারই পরশে জীবন আমার ওগো ধন্য হলো’। আনোয়ার লিপে গানটি ব্যবহার হয়। সাবিনা ইয়াসমিন কণ্ঠ দিয়েছেন গানটিতে। ‘অংশীদার’ সিনেমাটির পরিচালক দিলীপ বিশ্বাস।
সাদাকালো যুগের সিনেমার অসংখ্য গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তেমনি আরও একটি গান ওরে হলুদ পাখি বল কোথায় তোরে রাখি। গানটি ‘বদলা’ সিনেমার। সিনেমাটি পরিচালনা করেন নায়ক-পরিচালক আজিম। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন আঞ্জুমান আরা বেগম ও সুবীর নন্দী। রাজ্জাক ও নতুনের লিপে গানটি ব্যবহার করা হয়।
সাদাকালো যুগের ‘তুফান’ সিনেমার একটি গান সে সময়ে অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গানটি হলো: হীরার চেয়ে দামি ফুলের চেয়ে নামি আমার নূরজাহান। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা ও খুরশিদ আলম। সিনেমাটির পরিচালক অশোক ঘোষ।
রাজ্জাক অভিনীত অনেক সাদাকালো যুগের সিনেমার গানই হিট হয়েছে। মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। এখনো ফেরে। তেমনি একটি হচ্ছে ঢাকা শহর আইস্যা আমার আশা ফুরাইছে। ঢাকা শহরে বসবাসরত মানুষরা গানটি বেশ মজা করেই গায় এটি। এটি ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার গান। সিনেমাটি পরিচালনা করেন আজিজুর রহমান। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন শাম্মী আখতার ও খন্দকার ফারুক আহমেদ। রাজ্জাক ও অঞ্জনার লিপে গানটি ব্যবহার হয়েছে।
‘অশিক্ষিত’ সিনেমার আরও একটি গান সাড়া ফেলেছিল দর্শকদের মাঝে। গানটি হচ্ছে মাস্টার সাব আমি নাম দস্তগত শিখতে চাই। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন সুবীর নন্দী ও সাবিনা ইয়াসমীন।
এ দেশের অন্যতম প্রেমের সিনেমা ‘সুজন সখী’ সিনেমার বেশ কয়েকটি গান সুপারহিট হয়েছিল। সেই গানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা। প্রখ্যাত শিল্পী আবদুল আলীম গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। ফারুক ও কবরী জুটির ব্যবসাসফল সিনেমা এটি। ‘সুজন সখী’ সিনেমাটি পরিচালনা করেন খান আতাউর রহমান।
জাফর ইকবাল ও সুবর্ণা মুস্তাফা জুটি হয়ে অভিনয় করেন ‘নয়নের আলো’ সিনেমায়। এই সিনেমার বেশ কয়েকটি গান জনপ্রিয়তা পায়। একটি গান হলো: আমার বুকের মধ্যে খানে মন যেখানে হৃদয় সেখানে। গানটিকে কণ্ঠ দেন এন্ডু কিশোর।
এই সিনেমায় একই শিল্পীর গাওয়া আরেকটি গান সবার মন জয় করে নেয়। গানটি হলো আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি চোখ দুটি তুমি খেয়ো না। সিনেমাটি পরিচালনা করেন বেলাল আহমেদ।
‘পূত্রবধূ’ সিনেমার একটি গান সেই সময়ে খুব সাড়া ফেলে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মাঝে। গানটি হলো: সন্ধ্যার ছায়া নামে এলোমেলো হাওয়া। গানটিতে কণ্ঠ দেন সাবিনা ইয়াসমীন। গানটি শাবানার লিপে ব্যবহার করা হয়।
নায়িকা অলিভিয়া অভিনীত ‘দি রেইন’ সিনেমার একটি গান সোনালি দিনের সিনেমার যুগে খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গানটি হলো: একা একা কেন ভালো লাগে না। গানটির শিল্পী রুনা লায়লা। সিনেমাটি পরিচালনা করেন এস এম শফি। এতে অলিভিয়ার নায়ক ছিলেন ওয়াসিম।
যদি সুন্দর একটি মুখ পাইতাম গানটি ‘অনুভব’ সিনেমার। শাবানা ও উজ্জল সিনেমাটির নায়ক নায়িকা। শাবানার লিপে গানটি ব্যবহার হয়। এতে কণ্ঠ দেন সাবিনা ইয়াসমীন। সিনেমাটির পরিচালক আজিজুর রহমান।
আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘নয়ন মনি’ সিনেমার বেশ কয়েকটি গান জনপ্রিয় হয়েছিল। ফারুক ও ববিতা জুটির ব্যবসাসফল সিনেমা এটি। এর একটি গান সাদাকালো যুগের দর্শকদের মনে দাগ কেটে গেছে। গানটি হলো: চুল ধইরো না খোঁপা খোলে যাবে হে নাগর। গানটিতে কণ্ঠ দেন সবিনা ইয়াসমীন।
সোনালি যুগের সিনেমায় এ রকম আরও অনেক গান রয়েছে যা এখনো মানুষের মনকে ছুঁয়ে যায়।
Comments