স্বাধীন গণমাধ্যমের ‘মহাপ্রাচীর’ ভেঙে পড়েছে

লতিফুর রহমান। ছবি: স্টার

‘জানিস, আমি কে!’

দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ওঠা, তীব্র-তীক্ষ্ণ চাহনির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। কর্তৃত্ব দেখানো, ক্ষমতাবান হিসেবে নিজেকে জাহির করা এবং অন্যের কাছে নিজের গুরুত্ব বাড়াতে— তার যে ক্ষমতা আর যে ক্ষমতার স্বপ্ন তিনি দেখেন তার সবটা নিয়েই তিনি তখন ঝাঁপিয়ে পড়েন।

বিনয় হলো এমন এক দুর্লভ বস্তু যা ক্ষমতাবান মানুষের মধ্যে নিদারুণভাবে অনুপস্থিত। আমাদের সমাজে প্রভাবশালীদের ভিড়ে, আলোকবর্তিকার মতো খুব অল্প কয়েকজন মাত্র আছেন, যারা ঔদ্ধত্য প্রকাশের বিরুদ্ধে। গত ১ জুলাই লতিফুর রহমানের মৃত্যুতে এমনই এক আলোকবর্তিকা নিভে গেল চিরদিনের জন্য।

বাংলাদেশে আরও অনেক ব্যবসায়ী আছেন যারা খ্যাতিমান, কিন্তু লতিফুর রহমানের মতো সম্মান তারা কেউ পাননি। তার কারণ হলো— সাফল্য তাকে কখনোই দাম্ভিক করে তোলেনি। বাংলাদেশের অন্যতম ধনী আর সবচেয়ে প্রভাবশালীদের একজন ছিলেন তিনি। কিন্তু, তার নিজস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, চারপাশের মানুষ আর যাদের সঙ্গে তিনি মিশেছেন— সেখানে তার ক্ষমতার প্রভাব কখনও ছাপ ফেলেনি। সবার সঙ্গেই তিনি ছিলেন অমায়িক।

প্রতিটি পয়সা উপার্জনের সঙ্গে তিনি শিখেছেন আরও সৎ হতে, প্রতিটি দায়িত্ব তাকে আরও বিনয়ী করেছে, প্রতিটি সংকট থেকে তিনি আরও দৃঢ় হয়েছেন আর প্রতিটি শোক তাকে করেছে আরও অবিচল।

সব ব্যবসার লক্ষ্যই মুনাফা অর্জন। যারাই এটি করতে পারেন, তাদেরই সফল ব্যবসায়ী হিসেবে গণ্য করা হয়। আর যারা নীতি বজায় রেখে ব্যবসা করেন, তারা বিবেচিত হন সম্মানীয় হিসেবে।

কেবল মুনাফা করে, এমন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অনেক আছে। তবে, খুব অল্প প্রতিষ্ঠানই আছে যারা সততা আর নৈতিকতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ। আর এক্ষেত্রে, অন্য অনেকের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান। অর্ধশতকের কাছাকাছি তার বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তিনি নৈতিকতা চর্চার পাশাপাশি সামাজিক ও জাতীয় দায়িত্বও পালন করেছেন নিষ্ঠা আর সততার সঙ্গে।

অসলোতে ২০১২ সালে সম্মানজনক ‘বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণের সময় তিনি বলেছিলেন, ‘নিয়োগকর্তার বাইরেও (কর্মীদের জন্য) অনেক দায়িত্ব আছে।’ তিনি এমন একজন ছিলেন, যিনি তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রতি আলাদা খেয়াল রাখতেন এবং সংকটের সময় তাদের পাশে দাঁড়াতেন। কঠোর দায়িত্ববোধ তাকে অন্য উদ্যোক্তাদের থেকে আলাদা করেছিল।

উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে চলায় তার মূলমন্ত্র ছিল— ‘বিনিয়োগ, ক্ষমতায়ন এবং তারপর হস্তক্ষেপ না করা’। তিনি মনে করতেন, একজন উদ্যোক্তা ব্যবসার উদ্যোগ নেন। তবে, সেটি সফল হয় তখনই, যখন প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী— প্রধান নির্বাহী (সিইও), ব্যবস্থাপক ও নির্বাহী কর্মকর্তারা ক্ষমতার চর্চা করতে পারেন।

কয়েক বছর আগে তার সম্মানে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘শুধু পদবী নয়, সঠিক ক্ষমতায়ন হলে প্রতিষ্ঠানের সব সিদ্ধান্তগ্রহণকারী কর্মকর্তাই ধীরে ধীরে উদ্যোক্তাতে পরিণত হয়।’

তিনি যা করতেন, তাই বলতেন। তার একক বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতায়নের চিত্র এমনি। প্রতিদিন এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। কিন্তু, লতিফুর রহমান একটিতেও সাইন করতেন না।

নিজের ব্যবসার মতোই স্বচ্ছ ছিলেন লতিফুর রহমান। ১৯৯১ সালে দ্য ডেইলি স্টার এবং ১৯৯৮ সালে প্রথম আলোতে বিনিয়োগ করেন তিনি। পত্রিকা দুটি কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের সর্বাধিক প্রচারিত এবং গ্রহণযোগ্য দৈনিক হয়ে উঠে। গণমাধ্যমে বিনিয়োগের পর থেকেই অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রমী এই মানুষটি এবং তার সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষমতাসীনদের তীক্ষ্ণ নজরদারিতে ছিল। যদিও বাংলাদেশে ৬০০’র বেশি জাতীয় দৈনিক, ৩২টির মতো টিভি স্টেশন ও আট হাজারেরও বেশি নিউজ পোর্টাল আছে, যার প্রায় সবগুলোরই মালিক কোনো না কোনো ব্যবসায়ী। নিজেদের অন্য ব্যবসার স্বার্থে অপব্যবহার করার জন্যই ব্যবসায়ীরা সাধারণত গণমাধ্যমের মালিক হতে চান। তবে, লতিফুর রহমানের মতো গণমাধ্যমকে প্রভাব ও হস্তক্ষেপমুক্ত রাখার সাহস ও নৈতিকতা মিডিয়া মালিকরা খুব কমই দেখিয়েছেন।

যাদের টাকার ক্ষমতা আছে, স্বৈরতন্ত্র ও দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণমাধ্যম তাদের সেই ক্ষমতায় আলাদা মাত্রা যোগ করে। নতুন এই ক্ষমতাকে যদি ক্ষমতাসীন মানুষের পক্ষে ব্যবহার করা হয়, তাতে দুই পক্ষেরই সুবিধা। লতিফুর রহমান চাইলে খুব সহজে তেমন একজন হতে পারতেন। দুটি সর্বাধিক জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমের সূত্রে দেশের অন্যতম ক্ষমতাবানদের একজন হয়ে ওঠা তার জন্য সহজ ছিল। তবে, দুর্লভ ব্যক্তিত্বের এই মানুষটি ক্ষমতাহীন হয়েই থাকতে চেয়েছেন।

তিনি ও তার সঙ্গে যারা বিনিয়োগ করেছেন, তারা সবাই লতিফুর রহমানের, ‘বিনিয়োগ, ক্ষমতায়ন ও হস্তক্ষেপ না করা’— নীতিতে বিশ্বাসী। হস্তক্ষেপ না করার চর্চা এতটাই দৃঢ় যে, দ্য ডেইলি স্টার কর্মীদের একটি বড় অংশই জানেন না বোর্ডে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কত। আর সংবাদে প্রভাব বিস্তার তো পরের কথা।

আর এই স্বচ্ছন্দে ভর করেই সংবাদপত্র দুটি সত্যিকারের স্বাধীন গণমাধ্যম হয়ে উঠে। যা একইসঙ্গে গণমানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয় এবং বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা সব সরকারের কাছে ঠিক ততটাই অপ্রিয়।

প্রতিটি সাহসী প্রতিবেদন, সমালোচনা বা মতামত একদিকে যেমন প্রশংসা পেয়েছে, অন্যদিকে রোষেরও জন্ম দিয়েছে। তবে, স্বাধীন গণমাধ্যম হিসেবে এই দুটি পত্রিকা প্রভাবশালীদের অবজ্ঞা আর কোপানলের মধ্যে কীভাবে টিকে থাকতে হয় তা শিখে নিয়েছে।

আর এই স্বাধীনতার জন্য লতিফুর রহমানকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। যদিও এই দুই পত্রিকার সাংবাদিকতায় তার কোনো ভূমিকা বা হস্তক্ষেপ কখনই ছিল না, তারপরও তাকেই মূল ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এজন্য তার ব্যবসার ক্ষতি করা হয়েছে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অনুমোদন পেতে দেরি হয়েছে, কখনো কখনো অনুমোদন দেওয়াই হয়নি, বছরের পর বছর শীর্ষ করদাতা হওয়া সত্ত্বেও কর অফিস থেকে হয়রানির শিকার হয়েছেন।

নানা সময়ে বিভিন্ন মহল লতিফুর রহমানকে তীব্র চাপের মধ্যে ফেললেও কখনোই এই দুই পত্রিকার সাংবাদিকতা নিয়ে তিনি অভিযোগ কিংবা হস্তক্ষেপ করেননি, বলেননি থেমে যেতে। সব আঘাত তিনি নীরবে সয়েছেন, সংকল্পে হয়েছেন আরও দৃঢ়। জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে তিনি চীনের মহাপ্রাচীরের মতো বাইরের সব আঘাত সয়েছেন, সুরক্ষিত রেখেছেন পত্রিকাকে। আর সেই মহাপ্রাচীর গত ১ জুলাই ভেঙে পড়েছে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতাহীনতার এই সময়ে লতিফুর রহমানের মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি এমন এক সময়ে চলে গেলেন, যখন তাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। করোনাভাইরাস মহামারি দেশের প্রতিটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে, লাখো মানুষকে করেছে কর্মহীন।

দুঃখজনক হলো লতিফুর রহমানেরা ক্ষণজন্মা। স্বাধীন গণমাধ্যমগুলো সহসাই এমন আরেকজন লতিফুর রহমানকে পাবে— সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তবে, যতক্ষণ পর্যন্ত এরকম আরেকটি মহাপ্রাচীর তৈরি না হচ্ছে, সে পর্যন্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে তার অবদান আমাদের শক্তি যোগাবে।

সৈয়দ আশফাকুল হক, দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক

Comments

The Daily Star  | English

Managing expectations the challenge for EC

The EC was a rubber stamp to legalise AL's usurpation of power in last three elections

1h ago