করোনায় শুধু গরিব মরলে এত কথা হতো কি?

ফাইল ফটো স্টার

বর্তমান সভ্যতা যে বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা, অনাচার আর অবিচারের উপর দাঁড়িয়ে আছে তা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল করোনাভাইরাস। এই মহামারিতে ধনীরা যখন শুধু রোগে আক্রান্ত তখন গরিবরা রোগ ও ক্ষুধা দুদিক থেকেই আক্রান্ত। করোনা প্রতিরোধে ধনীর পক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মানা যত সহজ, গরিবের জন্য তা প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে ধনীরা টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা পেলেও গরিবের সেই সুযোগ নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, করোনাভাইরাসে শুধু গরিব মরলে দুনিয়াজোড়া এত হইচই হতো কি?

৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে ১৮ জুন ২০২০ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে বিশ্বে সাড়ে চার লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গড় হিসেবে যা দিনে দুই হাজার ৬৩১ জন। ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দ্বারা মহামারি ঘোষণা হওয়ার পর থেকে হিসাব করলে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় দিনে সাড়ে চার হাজার।

কিন্তু বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় ক্ষুধায় বা ক্ষুধা সংশ্লিষ্ট রোগে। এ নিয়ে তো এত হইচই দেখি না! দূষিত বায়ুর কারণে বিশ্বে প্রতিদিন ১৯ হাজার ১৭৮ জন মানুষ মারা যান। এই সংখ্যা তো সাড়া ফেলে না!

যুদ্ধ, সংঘাত, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে বিশ্বে প্রতিদিন ৩০ হাজার মানুষ ভিটে ছাড়তে বাধ্য হন। এই ভিটেছাড়া মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট লাঘবে তো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না!

ডায়রিয়ায় বিশ্বে প্রতিদিন দুই হাজার ১৯৫ শিশুর মৃত্যু হয়। এই নিষ্পাপ শিশুদের জীবন বাঁচাতে নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা বিধানের জন্য তো কোন জরুরি পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না!

করোনাভাইরাসও নিঃসন্দেহে মানব সভ্যতার জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। ভয়ংকর এই সংক্রামক ভাইরাসে জীবন হারানো সব স্বজনের বেদনা সমান। ধনী-গরিব সব মানুষের জীবনের মূল্যও সমান। কিন্তু উপরের তথ্যগুলো যখন দেখি তখন মনে কিছুটা খটকা লাগে। সত্যিই যদি এই ভাইরাসে শুধু গরিব মারা যেত তাহলে এ নিয়েও এত হইচই হতো কি? 

যাই হোক, করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে যখন সব মানুষকে বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হয় তখন কিছু পরিসংখ্যান ভাবনার খোরাক যোগায়। বিশ্বের সাড়ে ১২ শতাংশ অর্থাৎ ১০০ কোটি মানুষ বস্তিতে বাস করেন। যেখানে শারীরিক দূরত্ব, হাইজিন বা পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব। আবার, বিশ্বব্যাপী গ্রামে বসবাসকারী ৮০ ভাগ মানুষকে অনিরাপদ পানি ব্যবহার করতে হয়। প্রতিবেশী ভারতের প্রায় ৫০ কোটি মানুষ উন্মুক্ত জায়গায় মল ত্যাগ করেন।

আবার যখন মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে তখন দেখতে হবে কত শতাংশ মানুষের কয়দিন ঘরে বসে খাওয়ার সামর্থ্য আছে। বাংলাদেশে লকডাউন শুরুর পর ব্র্যাকের এক জরিপে দেখা গেল নিম্ন আয়ের ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে খাবার নেই। পরে নিশ্চয়ই তা আরও বেড়েছে। অন্যদিকে, দেশের শ্রমজীবী মানুষের ৮৫ ভাগই অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কাজ করেন এবং ৫৫.৫ ভাগ মানুষের দৈনিক আয় মাত্র ১৬১-৩২২ টাকা। কয়দিনই বা তারা কাজে না গিয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন?

আজ থেকে ৭৯ বছর আগে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার শেষ বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘হিন্দু-মুসলমানে দিন রাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তূপের মতো জমা হয়ে আছে।’

বর্তমান বিশ্বে সেই বৈষম্য আরও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। ৪২ ধনী ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ বিশ্বের অর্ধেক মানুষের সম্পদের সমান। ২০১৭ সালে অর্জিত অর্থের ৮২ শতাংশ গেছে ধনী এক শতাংশের পকেটে এবং বিশ্বের অর্ধেক মানুষের ভাগ্যের কোনো উন্নতি হয়নি। কর ফাঁকি, নীতি নির্ধারণে ব্যবসায়ীদের প্রভাব, দুর্নীতি ও শ্রমিকের অধিকার খর্ব করা এর মূল কারণ। বাংলাদেশও এই বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক পদ্ধতির বাইরে নয়।

এই করোনাকালে আমরা আবারও দেখলাম আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার কি বেহাল দশা। কেউ বলতে পারেন, অনুন্নত দেশে এর চেয়ে ভালো আশা করা ঠিক না? গত দেড় দশকে কত টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে জানেন? ২০১৬ সালে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি-জিএফআই এর তথ্য নিয়ে সিপিডি তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, ১০ বছরে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। আর, গেল বছর সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন দাবি করেন, দেশ থেকে পাচার হয়েছে নয় লাখ কোটি টাকা।

সংখ্যাটা কম-বেশি যাই হোক না কেন, সুশাসন থাকলে নিশ্চয়ই এই টাকা দেশে থাকত। এর একটা অংশ যদি চিকিৎসা সেবা উন্নয়নে ব্যবহার হতো তাহলে নিশ্চয়ই এখন মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কম হতো। আবার, সীমিত সাধ্যের মধ্যেও যে বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতের জন্য ছিল তাও সঠিকভাবে কাজে লেগেছে কিনা তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হয় যখন দেখা যায় একটি হাসপাতালের আইসিইউর জন্য একটি পর্দা সাড়ে ৩৭ লাখ টাকায় কেনা হয়। 

আবার, এই মহামারির সময় সরকার যখন ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য কিছু সাহায্য-সহযোগিতা দেয় তাও মেরে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ১০০ জনপ্রতিনিধিকে ত্রাণ চুরির দায়ে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

তাই, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ চরিতার্থ করার রাজনীতি, কর ফাঁকি আর শ্রমিকের অধিকার খর্ব করে সম্পদের পাহাড় গড়ার অর্থনীতি এবং সেবা খাতের দুর্নীতি বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। নয়তো আরেক মহামারিতে কেউই পার পাবে না। যার আলামত করোনা মহামারিতে কিছুটা হলেও টের পাওয়া যাচ্ছে। 

মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র যদি তা করতে পারে একটি সমাজ আপনা-আপনিই রেজিলিয়েন্ট হয়ে ওঠে। একথা অনুধাবন করতে হবে যে, আমরা চারপাশে যত মানবিক বিপর্যয় দেখি তার মূল কারণ বৈষম্য। করোনাকালে সইে বৈষম্য আরও তীব্র হয়েছে। খবরের কাগজের তথ্য বলছে, দেশে মহামারি শুরুর পর হাসপাতালে ভর্তি না নেওয়া বা অবহেলায় কমপক্ষে ৫০ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

জি এম মোস্তাফিজুল আলম: উন্নয়নকর্মী

ইমেইল: mukta1331@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Bida’s one-stop service plagued by non-stop negligence

Services rendered by government agencies through a single-window platform to facilitate business remain marred by unscrupulous activities, despite expectations of improvement among entrepreneurs under the interim government.

15h ago