কোভিড-১৯ এবং অভিবাসী কর্মীদের মজুরি ডাকাতি
করোনা মহামারির মধ্যে অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা তুলে ধরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি উল্লেখ করেছেন, ‘উপসাগরীয় দেশগুলো প্রায় প্রতিটি বড় খাতে অভিবাসী শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীল। তারপরও তারা অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা, প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।’
বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্র্যান্টস এক চিঠির মাধ্যমে জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা জানিয়েছে, কিছু শ্রম গ্রহণকারী দেশ মহামারি চলাকালীন সময় প্রবাসী কর্মীদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে তারা মহাসচিবের কাছে আহ্বান জানিয়েছে যেন তিনি ঐ সব সরকারকে অনুরোধ জানান ‘সংকটের এই সময়ে আর্থিকভাবে দুর্বল কর্মীদের দায়িত্ব নিতে’।
কয়েক দশক ধরে উপসাগরীয় ও অন্যান্য আরব দেশগুলোর অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অভিবাসী শ্রমিকদের অবদান অপরিসীম। কিন্তু, করোনা পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গে করা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা। এই পরিস্থিতিতে যদি কিছু ভালো হয়ে থাকে তা হচ্ছে, মহামারির কারণে এই শ্রমবাজারে বহুদিন ধরে বিরাজমান অন্যায্য ও অনৈতিক বাস্তবতা প্রকট ভাবে উন্মোচিত হয়েছে। এসব অতি ধনী দেশগুলো কিংবা শ্রমিক প্রেরণকারী দেশগুলো (রেমিট্যান্স প্রবাহ নিরাপদ রাখতে) শ্রমিকদের নানামুখী সমস্যার দিকে যথাযথ নজর দেয়নি যা পর্যায়ক্রমে বর্তমান সঙ্কটে রূপান্তরিত হয়েছে।
করোনা মহামারির মধ্যে বিভিন্ন দেশে থাকা অভিবাসী শ্রমিকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিবরণ থেকে জানা যাচ্ছে তারা কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আছেন। তাদের মধ্যে অনেকে দিনের পর দিন পর্যাপ্ত খাবার না খেয়ে আছেন। কেউ কেউ বড় সময় ধরে এধরনের খাদ্য সংকটে রয়েছেন। অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকেন তারা। অনেকের আবার সেই ঠাঁইটুকুও নেই। তাদের কাছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার উপদেশ উপহাসের নামান্তর মাত্র। তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ এখন কর্মহীন-অলস সময় কাটাচ্ছেন; কারণ, নির্মাণ ও অন্যান্য উৎপাদন কাজ, রেস্তোরা এবং মার্কেটগুলো বন্ধ। দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার চাপ প্রয়োগ করে অনেক শ্রমিককে কোনো প্রকার নিশ্চয়তা ছাড়াই মজুরি বকেয়া রাখতে বা কম মজুরি নিতে বাধ্য করা হয়েছে; যা শ্রম আইনের লঙ্ঘন। আয়হীন এই মানুষগুলোর মধ্যে যাদের কিছু সঞ্চয় আছে তারা খাবার যোগাড় করছে সেই সঞ্চয় ভেঙ্গেই। অনেকের তাও নেই। প্রতিটি অভিবাসী শ্রমিক দিন পার করছেন তীব্র মানসিক চাপের মধ্যে। যেসব ভাগ্যবান শ্রমিকরা তাদের চাকরি ধরে রাখতে পেরেছেন তারাও রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় নিজ দেশে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে পারছেন না। তাদের নিজ দেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোও হতাশ করছে। অভিবাসীদের যে পরিমাণ প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক কম পরিমাণ সহযোগিতা আসছে মিশনগুলোর কাছ থেকে।
এই মারাত্মক অনিশ্চয়তার মধ্যে বাড়তি কষ্ট যোগ হচ্ছে যখন নিয়োগকর্তারা স্বেচ্ছাচারিতা করে শ্রমিকদের ছাঁটাই করছে। বিপুল সংখ্যক অভিবাসীকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে তাদেরকে আর প্রয়োজন নেই। অথচ তখনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শ্রমিকদের চুক্তি বলবৎ রয়েছে। এখানেই শেষ নয়। এভাবে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ছাঁটাইয়ের জন্য তাদের কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণও প্রদান করা হচ্ছে না। উপরন্তু তাদের বাধ্য করছে বকেয়া থাকা মজুরি এবং অন্যান্য সুবিধা না দিয়েই প্রতিষ্ঠান ছাড়তে। এ যেন মড়ার উপর খাড়ার ঘা।
যেসব নিয়োগকারীরা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারত তারাও তাদের সরকারের নেওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনার সদ্ব্যবহার করে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করছে। এই নিয়োগকারীদের জন্য করোনা স্রষ্টা প্রদত্ত এক আশীর্বাদ; যার ফলে কার্যত ডাকাতির মাধ্যমে তারা শ্রমিকদের বিপুল পরিমাণ মজুরি আত্মসাৎ করছে। এমন প্রচুর অভিযোগ এসেছে যেখানে অভিবাসীরা জানিয়েছেন যে তাদের কয়েক মাসের মজুরি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অর্থ বাকী রয়ে গেছে।
এসব দেশের নিয়োগকর্তারা বেশ ভালো করেই জানে যে শ্রমবাজারের উপর তাদের কতটা প্রতাপ রয়েছে। তারা আরও জানে যে ভবিষ্যতে তাদের অভিবাসী শ্রমিকের প্রয়োজন হলে তাদের সরকার শ্রমিক আনার অনুমতি দেবে; এ ব্যাপারে কোনো সমস্যা হবে না। সেই সঙ্গে উভয় দেশের নিয়োগকারীরা নতুনভাবে উচ্চমূল্যে শ্রমিকদের কাছে ভিসা বিক্রি করে বাড়তি আয় করবে। শ্রমিকদের উৎস দেশগুলোর সরকার চাইবে যেকোনো ভাবেই হোক একজন অতিরিক্ত শ্রমিক প্রবাসে যাক এবং আয় করে টাকা পাঠাক। সেই টাকার পরিমাণ যত কমই হোক না কেন তা জাতীয় উন্নয়নে এক বড় মাপকাঠি রেমিট্যান্সের জন্য তো গুরুত্বপূর্ণ!
অপেক্ষাকৃতভাবে যেসব অভিবাসীরা সাধারণভাবে ভালো অবস্থায় থাকতেন তারাও এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে যারা বছরের পর বছর ধরে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে ঠিকাদার হয়েছেন বা ব্যবসা করছেন তারাও বিরূপ অবস্থায় পরেছেন। অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হওয়ায় ইতোমধ্যে যে কাজগুলো শেষ করেছে তার পাওনা আদায় করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দিহান তারা।
দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে, বিভিন্ন শর্ত মেনে অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে যারা পরবর্তীকালে (টেইলারিং শপ, মোটর গ্যারেজ এবং সুপার মার্কেটের মতো) উদ্যোগের সহ-মালিক হয়ে উঠেছেন তাদের অবস্থা আরও খারাপ। আরব দেশগুলোতে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয় সেদেশের নাগরিকদের নামে। এত পরিশ্রম করে দাড় করানো প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যদি তাদের আরব অংশীদার বিতাড়নের চেষ্টা করে তাহলে সেসব দেশের কঠোর নীতির প্রেক্ষিতে সব ফেলে নিজ দেশে চলে আসতে তারা বাধ্য হবে। বলা বাহুল্য, উপসাগরীয় এবং অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোর সরকার এইধরনের অভিবাসীদের বিনিয়োগের কোনো প্রকার নিরাপত্তা দেয় না। করোনা মহামারি এমন ব্যবসার অংশীদার আরব মালিকদের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় একচ্ছত্র মালিক হওয়ার সোনালী সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
করোনা পরিস্থিতিতে অভিবাসী শ্রমিকদের বড় একটি অংশকে দেশে ফেরত পাঠানো বা কাজ থেকে ছাটাই করে দেওয়া একটি নির্মম বাস্তবতা। মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর থেকে ২ লাখেরও বেশি শ্রমিককে এশিয়াতে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ফ্লাইটগুলো পুনরায় চালু হলে এই সংখ্যাটি বহুগুণ বাড়বে। মাইগ্রান্ট ফোরাম ইন এশিয়া (এমএফএ) পূর্বাভাস দিয়েছে যে ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ এবং ফিলিপাইনের মতো দেশগুলোর বিরাট সংখ্যক অভিবাসী করোনার প্রভাবের কারণে দেশে ফিরে আসবে - ‘লাখ লাখ মানুষ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরবে। কারণ দেশে ফিরে এসে ব্যয়কৃত অভিবাসনের খরচ মেটাতে তারা বাধ্য হবেন।’
আরব দেশগুলো অভিবাসী শ্রমিকদের তাদের ন্যায্য প্রাপ্য অর্থের ব্যবস্থা না করেই তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কঠোর হয়ে উঠছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে আদালত এবং অন্যান্য বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া বন্ধ থাকার মাঝেই এই প্রত্যাবাসন পদ্ধতি কার্যকর করা হচ্ছে।
১ জুন প্রকাশিত পাঁচ শীর্ষস্থানীয় আইএনজিও এবং ট্রেড ইউনিয়নের একটি যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে ‘প্রত্যাবাসিত অভিবাসী শ্রমিকদের মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার রক্ষার জন্য সংস্থাগুলো ও নিয়োগকারীরা যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করছে না, ... লাখো শ্রমিক কষ্টার্জিত আয় ছাড়াই দেশে ফিরে আসছে…, ন্যায়বিচার পাচ্ছে না।’ নিয়োগকর্তারা এই শ্রমিকদের কোনো দলিলের অনুলিপি (চুক্তি, বেতন স্লিপ, হাজিরা ইত্যাদি) সরবরাহ করছে না যার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎতে তারা ন্যায়বিচার বা ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে। শ্রমিকরা যখন অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছেন, তখন অপরিকল্পিত ‘প্রত্যাবাসন’ (যা মূলত বিতাড়ন) নিয়োগকারীদের সব ধরনের জবাবদিহিতার দায় থেকে মুক্তি দিচ্ছে।
বঞ্চিত ও দরিদ্র এই অভিবাসী শ্রমিকদের মানসিক চাপের মাত্রা কোন মাপকাঠিতে নির্ধারণ করা যাবে না। নিয়োগকারী দেশগুলো এভাবে মজুরি চুরির মাধ্যমে বহু মিলিয়ন ডলার সম্ভব রেমিট্যান্স আত্মসাৎ করছে। এখনও এর প্রকৃত পরিমাণ নিরূপণ করা হয়নি। অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমপ্যাক্ট, নিউ ইয়র্ক ঘোষণা ২০১৬, আঞ্চলিক কলম্বো প্রক্রিয়া ও আবুধাবি সংলাপ এবং আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া - জিএফএমডি লাখ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসীদের আশার আলো এখনো দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
১৬ জুন আন্তর্জাতিক পারিবারিক রেমিট্যান্স দিবস। এই দিনে লাখ লাখ পরিবারে, এবং একই সঙ্গে সমাজ, দেশ এবং সমগ্র অঞ্চলে, অভিবাসীদের অবদান উদযাপন করা হয়। করোনা অভিবাসী আয়ের ওপর নির্ভর এসব পরিবারের আর্থিক অবস্থায় ব্যাপক আঘাত হেনেছে। গত ১৯ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় বিশ্ব সংহতির আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘উন্নয়নশীল বিশ্বে রেমিট্যান্সই চালিকা শক্তি, বিশেষ করে এই সময়ে।’
দুর্ভাগ্যক্রমে করোনা মহামারি প্রবাসী শ্রমিকদের বিষয়ে ‘বিশ্ব সংহতি ও সহযোগিতা’ এর লালিত ধারণার অসারতা প্রমাণ করেছে। যদি ‘নতুন করে উন্নত সৃষ্টি’র (বিল্ড-ব্যাক-বেটার) আহ্বানকে সফল করতে হয়, যদি এসডিজির লক্ষ্য অর্জন করতে হয়, যদি বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে প্রান্তিক মানুষের জন্য অর্থবহ করতে হয় তাহলে প্রতিটি দেশ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে এই মজুরি ডাকাতদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায়, কঠোর পরিশ্রমে গড়ে ওঠা অভিবাসন এবং উন্নয়নের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভয়ংকর ভাবে ধাক্কা খাবে।
সি আর আবরার একজন শিক্ষাবিদ। তিনি শরণার্থী এবং অভিবাসী সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরু-র সমন্বয়ক।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments