সরকার শুধু সরকারি লোকজনের জন্য?

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

সুরক্ষিত এবং অরক্ষিত, সরকারের পছন্দের এক অদৃশ্য রেখা যেন মানুষকে দুই ভাগ করে ফেলেছে। একদল মানুষ আছেন যাদের দায়িত্ব সরকারের হলেও, অপর দলটির দায়িত্ব যেন সরকারের না। একদল মানুষকে সরকার নিরাপত্তার চাদরে আগলে রাখলেও অপর দলকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে অরক্ষিতভাবে। সুবিধাপ্রাপ্ত দলটি— সরকারি কর্মচারীরা এবং অরক্ষিত দলটি— বেসরকারি কর্মজীবীরা।

বিভাজনের এই রেখা সবসময়ই ছিল। চলমান করোনাভাইরাস মহামারিতে সেটি বিব্রতকরভাবে আরও স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটেও তারই প্রতিফলন দেখা গেছে। আরও স্পষ্ট হয়েছে বৈষম্য।

করোনা মহামারির মধ্যে গত চার মাসে দেশের অর্থনীতির বেহাল দশা। একই অবস্থা পুরো পৃথিবীর। এর মধ্যে খুব কম দেশেই বাজেট ঘোষণা করেছে। আ হ ম মুস্তফা কামাল সেই অর্থে একজন সাহসী অর্থমন্ত্রী।

আমাদের দেখা ইতিহাসে আর কোনো অর্থমন্ত্রী এমন মাত্রার সংকটের মুখোমুখি হননি। ধনী থেকে গরিব— সবাই সরকারের কাছে সাহায্য চাইছেন। ফলে সরকারকে হাত বাড়াতে হচ্ছে বিদেশি ঋণদাতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক (টাকা ছাপার মাধ্যমে) এবং কালো টাকাওয়ালাদের কাছে।

আমরা যদি মহামারি এবং এর বাইরেও সবার জন্য স্বাস্থ্য ও আর্থিক সুরক্ষায় সরকারের নেওয়া ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করি, তাহলে বিভাজনের এই রেখাটি আরও স্পষ্টভাবেই দৃশ্যমান হয়। সরকার কেবলমাত্র সরকারি কর্মচারীদের জন্যই দায়িত্বশীল, বেসরকারি কর্মজীবীদের জন্য নয়।

সরকারি কর্মচারীদের চার মাসের আর্থিক সংকটে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য মুস্তফা কামালের কৃতিত্ব প্রাপ্য। যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা থাকুক আর নাই থাকুক, তিনি ১৪ লাখ সরকারি কর্মচারী (এক মাসের বেতন ও সুবিধা বাবদ ৫ হাজার ১২৫ কোটি টাকা) এবং সাড়ে ৬ লাখ পেনশনভোগীর (এক মাসে ১ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা) আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছেন।

বাস্তবতার নিরিখে মিতব্যয়ী না হয়ে বরং সরকারি কর্মচারীদের ক্ষতিপূরণে সরকারের খরচ বাড়ানো হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর জন্য পদ অনুযায়ী ৫০ লাখ টাকা এবং সংক্রমিত হলে ১০ লাখ টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেন তিনি। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মেডিকেলকর্মীদের পাশে থাকা পুলিশ ও অন্যান্য সম্মুখযোদ্ধারা আইজিপি (পুলিশ মহাপরিদর্শক) তহবিল থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ পাবেন।

আমরা সবাই করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখযোদ্ধাদের কাছে কৃতজ্ঞ। এটি ভালো উদ্যোগ যে সরকার তাদের যথার্থ ও সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। তবে, এই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে শুধু তাদের জন্য যারা সরকারি কর্মচারী।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে এখন পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। এর মধ্যে ২৮ জন চিকিৎসক রয়েছেন। এই ২৮ জনের মধ্যে আট জন চিকিৎসক বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তবুও, তারা ক্ষতিপূরণের জন্য বিবেচিত হননি।

আরও একদল সম্মুখযোদ্ধা রয়েছেন যারা খবরের পেছনের মানুষ। প্রতিদিন মহামারিজনিত ঝুঁকিতে ফেলছেন নিজেদেরকে। তারা তা জনগণ ও সরকারকে অবহিতও করেছেন। কিন্তু, তারপরও তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ফেলে গেছেন। এখন পর্যন্ত করোনায় চার জন এবং করোনার লক্ষণ নিয়ে তিন জনসহ মোট সাত জন সাংবাদিক মারা গেছেন এবং ২৮১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। কোনো সরকারি ক্ষতিপূরণ তাদের পরিবারে পৌঁছেনি। সেই সঙ্গে তাদের মৃত্যুর পর বকেয়া বেতনের টাকাও পরিশোধ করেনি তাদের নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। তবে, অপ্রত্যাশিতভাবে পুলিশপ্রধান তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে প্রতিটি পরিবারকে এক লাখ টাকা দিতে চেয়েছেন।

এই মহামারির ধাক্কায় বদলে যাচ্ছে অর্থনীতি। বদলে যাবে ব্যবসা ও কাজের সুযোগ। ব্যবসাগুলো কীভাবে পুনরায় চালু হবে এবং এই ক্ষয়ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধার পাবে— তা বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। তাই অন্তত আরও এক বা দুই বছরের জন্য বোনাস কাটা, বেতন কাটা, সুবিধা কাটা এবং চাকরিচ্যুত করা বাংলাদেশে সাধারণ বিষয়ে পরিণত হবে।

তবে, এই উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তাগুলো শুধুমাত্র বেসরকারি খাতে কাজ করা ৭৫ লাখ মানুষের জন্য।

দেশের ২২ লাখ ব্যক্তিগত করদাতার মধ্যে বেসরকারি চাকরিজীবী ৮৬ শতাংশ। এই বিপদের সময়ে সরকারি কোষাগারে অর্থের যোগানদাতা এই বিপুলসংখ্যক কর প্রদানকারীরা অর্থমন্ত্রীর বিবেচনার বাইরে থেকে গেছেন। তাদের উপেক্ষা করেছেন অর্থমন্ত্রী। তাদের প্রতি বাড়তি নজর দেওয়া অবশ্যই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু, তা করা হয়নি।

শুধুমাত্র সরকারি কর্মচারীদের আর্থিক সুরক্ষা দেওয়া কতটা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত? যাদের মধ্যে মাত্র তিন লাখ করদাতা? ১৯ লাখ করদাতা যারা বেসরকারি চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী— তাদের প্রতি সরকার কেন এতটা উদাসীনতা দেখাবে? তারা কর দিবেন, তারাই চাকরি হারাবেন? তাদেরই বেতন কাটা হবে বা তারাই ব্যবসা হারাবেন?

মুস্তফা কামালের বাজেটের কোথাও চাকরির সুরক্ষা দেওয়া বা কর্মসংস্থানের বিষয়ে কোনো স্পষ্ট রূপরেখা দেখা যায়নি। কেন এই করদাতারা সরকারের কাছ থেকে করোনাকালীন কোনো সুবিধা পাবেন না? যদি করদাতারা তাদের সংকটে সুরক্ষা না পান, তাহলে তারা কেন কর দেবেন?

এই সংকটময় সময় মুস্তফা কামালের কাছে ভিন্ন ধরনের কিছু প্রত্যাশা করেছিল। তবে, তার বাজেট বক্তব্যে তা প্রকাশ পায়নি। অন্তত এখন পর্যন্ত তো না।

Comments

The Daily Star  | English

What's causing the unrest among factory workers?

Kalpona Akter, labour rights activist and president of Bangladesh Garment and Industrial Workers Federation, talks to Monorom Polok of The Daily Star about the recent ready-made garments (RMG) workers’ unrest.

8h ago