এক ল্যাবে করোনা নেগেটিভ অন্য ল্যাবে পজিটিভ কেন?

Corona test logo
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমরা অনেক সময়ই দেখতে পাচ্ছি এক ল্যাবে কারো করোনা নেগেটিভ আসলো, কিন্তু অন্য ল্যাবে তা পজিটিভ আসছে। আবার উল্টোটাও হচ্ছে। অর্থাৎ, এক ল্যাবে পজিটিভ আসলেও তা অন্য ল্যাবে নেগেটিভ আসছে। এর সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত।

প্রথমে আসি এক ল্যাবে করোনা সনাক্তকরণ পরীক্ষায় কোনো নমুনা নেগেটিভ আসলে, তা অন্য ল্যাবে পজিটিভ আসার বিষয়ে। উদাহরণ হিসেবে একটা নিউজের কথা ধরি, যেখানে দেখলাম একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং সাতক্ষীরার দুজন নারীর নমুনা করোনা পরীক্ষার জন্য খুলনা মেডিকেলে পাঠানো হলে সেখানে ফলাফল নেগেটিভ আসে। কিন্তু একসপ্তাহ পরে ঢাকায় তাদের পরীক্ষার ফলে দেখা যায় তারা করেনা পজিটিভ। আমাদের মনে রাখা উচিৎ, এক সপ্তাহ অনেক সময়। এই সময়ে করোনাভাইরাস সংখ্যা বৃদ্ধি করে কয়েকশ গুণ বাড়তে পারে। এক সপ্তাহ আগে ভাইরাস কম থাকা স্বাভাবিক। তাই করোনা সনাক্তকরণেও তারতম্য হতে পারে।

তবে এই সমস্যা আরও কিছু কারণে হতে পারে। যদি সাধারণ স্যালাইন পানির (০.৯% সোডিয়াম ক্লোরাইড) টিউবে নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং তা ছয় ঘণ্টার বেশি সময় রেখে দেওয়া হয় বা নমুনা ল্যাবে আনতে সময় বেশি লাগে বা নমুনা পরিবহনের তাপমাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে নমুনায় ভাইরাস থাকলেও তার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তখন এই নমুনা কোনো ল্যাবে পরীক্ষা করলে করোনা নেগেটিভ দেখাতে পারে, যদিও নমুনাটি করোনা পজিটিভ ছিল। অন্য ল্যাবে নমুনা যদি সকল বিষয় ঠিক রেখে ভাইরাল ট্রান্সপোর্ট মিডিয়ায় যায় বা স্যালাইন পানিতে নমুনা সংগ্রহ করে কম সময়ের মধ্যে ল্যাবে পাঠানো হয় এবং নমুনা পরিবহনের সময় তাপমাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে ঐ নমুনার ফলাফল পজিটিভ আসার কথা। আবার, কোনো ল্যাবে যদি করোনাভাইরাসের আরএনএ নিষ্কাশন ভালোভাবে না করা হয় বা লাইসিস বাফার বেশি সময় নমুনায় দিয়ে রাখা হয় তাহলে ভাইরাসের আরএনএ ভেঙে যেতে পারে। তখন ঐ ল্যাবে ঐ নমুনা নেগেটিভ রেজাল্ট দিবে। অন্য কোনো ল্যাবে এই কাজগুলো সঠিকভাবে করলে সেখানে পজিটিভ আসতে পারে।

আবার যে কাঠি দিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে তার মাধ্যমে বা নমুনায় অন্য কোনো ভাবে যদি উদ্ভিদ ও প্রাণীজ কোষে থাকা নিউক্লিয়েজ নামক এনজাইম নমুনায় লেগে যায় তবে তা করোনাভাইরাসের আরএনএকে ভেঙে দিতে পারে। তখন ফলাফল নেগেটিভ দেখাবে, যদিও নমুনাতে করোনাভাইরাস ছিল।

নেগেটিভ নমুনা পজিটিভ হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো তা সংগ্রহ  পরীক্ষায় দক্ষ জনবলের অভাব। আমরা যারা স্বেচ্ছাসেবক মলিকুলার বায়োলজিস্ট হিসেবে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে চিকিৎসক ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ট্রেনিং দিচ্ছি, তারা সেখানে একসপ্তাহের জন্য যাচ্ছি। যারা আরটি-পিসিআর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না তাদের একসপ্তাহে ভালোভাবে সব কিছু শেখানো যায় না।

করোনাভাইরাস মানবদেহে প্রবেশের পর সংখ্যায় অনেক কম থাকে। সাত দিন পর সাধারণত ভাইরাসের পরিমাণ অনেক গুণ বাড়ে। তাই ভাইরাস শরীরে প্রবেশের দু-তিন দিন পরই যদি নমুনা সংগ্রহ করা হয় তাহলে নমুনাতে ভাইরাস কম থাকে এবং পজিটিভ রেজাল্টের জন্য কম্পিউটারে যে ‘এস’ আকারের রেখা দেখা যায় তা এই ক্ষেত্রে খুব ভালোভাবে বোঝা যায় না। তখন যদি সেখানে অভিজ্ঞ কেউ না থাকেন তাহলে সেই নমুনায় করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নেই মনে করে রেজাল্ট নেগেটিভ দিয়ে দিতে পারেন। তাই যে রেজাল্ট এনালাইসিস করে নমুনা পজিটিভ নাকি নেগেটিভ সেটার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন তাকে অনেক অভিজ্ঞ হতে হবে। সেই সঙ্গে সব কিছু বিবেচনা করে এবং রোগীর লক্ষণের ইতিহাস জেনে তারপর এই ধরনের নমুনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে।

দ্বিতীয়ত আসি এক ল্যাবে রেজাল্ট পজিটিভ আসলে তা অন্য ল্যাবে নেগেটিভ হয়ে যায়, এই বিষয়ে। এমনটি হয়েছিল কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে। সেখানে পরীক্ষা করা ৬৬টি নমুনা পজিটিভ আসার পর সংখ্যা বেশি হওয়ায় তা আবার পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। ঢাকায় পরীক্ষার পর সেখানকার ৬৪টি নমুনাকে নেগেটিভ বিবেচনা করা হয়। এখানে আগে যেমনটা বলেছি, দক্ষ জনবলের অভাবে এমনটা হতে পারে। কারণ আরটি-পিসিআর মেশিন বলে দেয় না যে কোন নমুনা করোনা পজিটিভ বা কোনটা নেগেটিভ। মেশিন শুধু আমাদের ডাটা দেয় আর সেগুলো দেখে এবং বিশ্লেষণ করে আমরা ফলাফল নির্ধারণ করি। যদি দক্ষ জনবল না থাকে তবে ফলাফল ভুল হতেই পারে। আবার এক ল্যাবের পরীক্ষায় পজিটিভ আসা নমুনা যদি সঠিক নিয়ম না মেনে, অর্থাৎ তাপমাত্রা, সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং পরিবহন পদ্ধতি ঠিক না রেখে, অন্য ল্যাবে পাঠানো হয় তাহলে তার ফলাফল নেগেটিভ হতে পারে।

তাই আমি মনে করি, এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রত্যেকটা মেডিকেল কলেজে যত দ্রুত সম্ভব তিন থেকে চার জন বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্ট স্থায়ীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই প্রয়োজন, যারা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে আরটি-পিসিআর ল্যাব সেট আপ, করোনা সনাক্তকরণ এবং বায়োসেফটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন এবং এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ।

 

লেখক: বায়োমেডিসিন গবেষক, স্বেচ্ছাসেবক বায়োকেমিস্ট ও মলিকুলার বায়োলজিস্ট এবং প্রশিক্ষক, কোভিড-১৯ সনাক্তকরণ

Comments

The Daily Star  | English
India visa restrictions for Bangladeshi patients

A wake-up call for Bangladesh to reform its healthcare

India’s visa restrictions on Bangladeshi nationals, while initially perceived as a barrier, could serve as a wake-up call for Bangladesh to strengthen its healthcare system and regain the confidence of its patients.

12h ago