ধনীদের জন্য বার্তা

সংকট মুহূর্তে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সাফ ফাউন্ডেনশনের প্রতিষ্ঠাতা
আনিস আহমেদ এবং সুহানা লুৎফা আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাস মহামারিতে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে এক অভূতপূর্ব মানবিক সঙ্কট। এই সময়ে সুহানা ও আনিস আহমেদের একটি বেসরকারি ফাউন্ডেশন দাঁড়িয়েছে এমন কিছু মানুষের পাশে যাদের কিছুই নেই। আর এর মাধ্যমে তারা একটি বার্তা দিচ্ছেন তাদের, যাদের সব আছে। বার্তাটি হলো- শেয়ার করেই কেয়ার করা যায়।

মানুষের জন্য কাজ করা সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশনের (সাফ) জন্য নতুন কিছু না। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মিলিতভাবে তারা গ্রামাঞ্চলে ২২ হাজার পরিবারকে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকার করোনাকালীন সহায়তা দিয়েছেন। দুই মাসে এক কোটি ৮৪ লাখ টাকা প্রায় তিন হাজার দিন এনে দিন খাওয়া অটোরিকশা চালকের মধ্যে বিতরণ করেছেন। যাতে তারা এই লকডাউনের কর্মহীন দিনগুলোতে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন।

সুহানা লুৎফা আহমেদ ও তার স্বামী আনিস আহমেদের একটি উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন রয়েছে। তারা দেখতে চান একদিন তাদের ফাউন্ডেশন বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মতো সম্মান পাবে।

দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে এমজিএইচ গ্রুপের মালিক আনিস আহমেদ-এর সঙ্গে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় সিঙ্গাপুর থেকে তিনি জানান তার দাতব্য কার্যক্রম সম্পর্কে।

মহামারিটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং স্বল্প আয়ের মানুষগুলো এই সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আনিস আহমেদের প্রত্যাশা, তাদের এই উদ্যোগ আমাদের সমাজের ধনী ব্যবসায়ীদের অনুপ্রাণিত করবে দরিদ্রদের জন্য কিছু করার জন্য। সঙ্কটের এই সময়ে একটা কাঠামোর মধ্য দিয়ে যাকাত বণ্টন করা গেলে সমাধানের পথে অনেকটাই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনি কত সালে এই ফাউন্ডেশনের শুরু করেছিলেন?

আনিস আহমেদ: ফাউন্ডেশনটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সালের ১২ জুলাই।

২০০৯ সালে আমি করাচিতে যাই একটি ব্যবসায়িক সফরে। তখন পাকিস্তানে বাংলাদেশের উপ হাইকমিশনার ছিলেন আমার বন্ধু। তার সঙ্গে কফি খেতে খেতে এই জাতীয় দাতব্য কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করি। আমি তার কাছে জানার চেষ্টা করেছিলাম যে করাচি ও লাহোরে থাকা আমার এমজিএইচ গ্রুপের শাখার মাধ্যমে দেশটিতে থাকা বাংলাদেশিদের সহায়তা করা যায় কিনা। পাকিস্তানে আমাদের দেশের অনেক কর্মী সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন।

আমার কাছে তিনি জানতে চান, করাচি কারাগার থেকে আট বছর পর মুক্তি পাওয়া সাত বাংলাদেশিকে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য টাকা দিতে পারব কিনা। তারা দেশে ফিরে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করতে পারছে না। টাকার অভাবে এবং বিকল্প কোনো উপায় না পেয়ে মুক্তি পাওয়া ওই বাংলাদেশিরা কারাগারেই আছেন কেবলমাত্র দিনে তিন বেলার খাবার ও মাথা গোঁজার একটু জায়গার জন্য। আমি সেই অর্থায়ন করেছিলাম।

২০১২ সালে আমরা তানজানিয়ার জেল থেকে ২০ জন, মিশর থেকে ১৮ জন এবং লেবানন থেকে এক নারী শ্রমিককে দেশে ফিরিয়ে এনেছি। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এনজিওর সহায়তার অভাবে এই প্রকল্পটি বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।

দ্য ডেইলি স্টার: এমন একটি ফাউন্ডেশন তৈরির অনুপ্রেরণা পেলেন কোথায়?

আনিস আহমেদ: সাহায্যের প্রয়োজন এমন আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য এটি একটি কাঠামোগত ও টেকসই পদ্ধতি। দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে চাই। সেই লক্ষ্য অর্জনের পর আমাদের ইচ্ছা আন্তর্জাতিক অঙ্গণে সহায়তার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করার। যদিও এরই মধ্যে আমরা তা শুরুও করেছি।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনি যে পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন, এভাবে দাতব্য কাজে উত্সাহ পেয়েছেন কিভাবে?

আনিস আহমেদ: আমি বিল গেটসের একজন বড় অনুরাগী এবং বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ দ্বারা প্রভাবিত। আমি সবসময় মনে করি, আপনি নিজের ব্যবসা করবেন, অবসর নেবেন এবং তারপরে বাকী জীবনটা ব্যয় করবেন মানুষের কল্যাণে। আর এই যাত্রায় আপনার পাশে থাকবে আপনার জীবন সঙ্গী।

আমার বয়স এখন ৫৫ বছর। আমি মনে করি, মানুষের জন্য আরও বেশি সময় দেওয়ার জন্য এটাই আমার আদর্শ বয়স। তাই আমরা আগের চেয়ে আরও নিবিড়ভাবে এই কাজের জন্য পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিচ্ছি।

দ্য ডেইলি স্টার: ফাউন্ডেশন করার আগে কি কোনো বড় উদ্যোগ নিয়েছিলেন?

আনিস আহমেদ: আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে একটি আধুনিক অপারেশন থিয়েটার তৈরি করতে সহায়তা করেছি এবং এটি এখনও আমাদের মানসিক প্রশান্তি দেয়। ২০১৩ সালে এই জীর্ণ অপারেশন থিয়েটারটিকে আধুনিকায়নে সহায়তা করার জন্য বিখ্যাত প্লাস্টিক সার্জন ডা. সামন্ত লাল সেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন আমরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডা. সেনের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি। বার্ন ইউনিটে এখন একটি অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার রয়েছে।

আমরা গুরুতর রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার জন্য অনেকগুলো হাসপাতালে অর্থায়ন করেছি। আমরা নবজাতকের মৃত্যু কমাতে ইনকিউবেটর ও ওয়ার্মার দিয়েছি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল ও ঢাকা শিশু হাসপাতালে। এছাড়াও দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের দিয়েছি স্মার্ট ছড়ি।

দ্য ডেইলি স্টার: ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রথম দাতব্য কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

আনিস আহমেদ: ফাউন্ডেশনের প্রথম কাজটি ছিল একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশুদের লিউকিমিয়া ওয়ার্ড করা হয়েছিল। ২০১৮ সাল থেকে হাসপাতালটির শিশু বিভাগের সঙ্গে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট ওয়ার্ডটির সকল শিশু রোগীদের জন্য ২৪ ঘণ্টার সামগ্রিক সহায়তা করছে ফাউন্ডেশন।

ফাউন্ডেশন এই রোগীদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ সরবরাহ করে। সেই সঙ্গে পেইড অ্যাটেন্ডেন্ট, পরিচ্ছন্নতা, স্ন্যাকস, বিছানায় পরিষ্কার চাদর, বালিশ, লিনেন ইত্যাদি সরবরাহ করে থাকে। আমরা এই বিশেষ ওয়ার্ডের জন্য আরও বেশি সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। প্রতিটি শয্যায় টিভি, দর্শনার্থীদের জন্য হাইজিন কিটস, যত্ন নেওয়ার জন্য কর্মী, পরিবারের সদস্যদের থাকার ব্যবস্থা এবং আরও অনেক কিছু করা পরিকল্পনা রয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টার: এই কাজ কতটা মানসিক তৃপ্তি দেয়?

আনিস আহমেদ: যখন কোনো শিশু লিউকেমিয়া থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়, স্কুলে ফিরে যায়, তখন যে ঠিক কতটা ভালো লাগে তা প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার নেই। আমরা যেসব চক্ষু শিবির করি সেখানে আসা শিশুরা যখন ছানি অপসারণের পরে আরও ভালো দেখতে পায়, তাদের সেই আনন্দ আমাদের যে কীভাবে উচ্ছ্বসিত করে তা প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীরা আমাদের দেওয়া স্মার্ট ছড়ি নিয়ে তাদের জীবন চালিয়ে দেয় বা আমাদের দেওয়া অর্থ সহায়তা মানুষের মুখের কোণায় যে হাসিটা ফোটায় তা দেখে কতটা আনন্দ হয় তা দেখানোর সুযোগ পেলে ভালো হতো। সেই সময়গুলোতে আমার শুধু একটাই কথা মনে হয়, জীবনের পূর্ণতা পেলাম।

দ্য ডেইলি স্টার: ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা কী ভূমিকা পালন করেন? ফাউন্ডেশন নিয়ে আপনার পরিকল্পনা ও স্বপ্ন কী? আপনি কীভাবে বিল-মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সাফের তুলনা করেন?

আনিস আহমেদ: সুহানা এবং আমি আমাদের স্বপ্ন, পরিকল্পনা একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করি। কোন সময়ের মধ্যে কোন লক্ষ্য অর্জন করতে চাই তা নির্ধারণ করি। দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে একটি প্রকল্প বেছে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সুহানা একটি বড় ভূমিকা পালন করে। আমি জোর দেই আমাদের বাছাই করা প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য।

আমাদের লক্ষ্য তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে আরও কাজ করা। সাফ বিশ্বব্যাপী সফল হওয়ার জন্য তরুণ বাংলাদেশিদের আরও বেশি শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করবে।

আমাদের তরুণ প্রজন্ম বুদ্ধিমান, মেধাবী, নমনীয় ও সংকল্পবদ্ধ। যারা যোগ্য কিন্তু অর্থের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে তাদের মধ্যে থেকে কিছু তরুণকে আমরা সহযোগিতা করতে চাই। আমরা সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় শিক্ষার্থীর জন্য একটি বার্ষিক স্কলারশিপ প্রোগ্রামের জন্য অর্থায়ন করেছি। যার মধ্যে তিনটি পাবে কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীরা। সফটওয়্যার, ক্লাউড নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদিতে এ জাতীয় বৃত্তি চালু করার জন্য আমরা অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি।

বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন একটি স্বীকৃত জনহিতকর প্রতিষ্ঠান। যা মহামারি থেকে বাঁচাতে জনস্বাস্থ্য থেকে শুরু করে পানির পুনর্ব্যবহার নিয়ে কাজ করে। আমাদের এই উদ্যোগটিকে কোনোভাবেই বিশ্বের এই ধনী দম্পতির উদ্যোগের সঙ্গে তুলনা করা যায় না।

দ্য ডেইলি স্টার: দাতব্য কাজের ক্ষেত্রে ফাউন্ডেশনের কোনো ধর্মীয় পছন্দের বিষয় আছে কি?

আনিস আহমেদ: না, কোনো ধর্মীয় পছন্দ নেই। একেবারেই নেই।

দ্য ডেইলি স্টার: এই মহামারির সময়ে আপনার ফাউন্ডেশন কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে?

আনিস আহমেদ: আমরা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের শুকনো খাবার কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলাম। বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা কিশোর অত্যন্ত সুচারুভাবে কাজ সম্পাদন করে উদ্যোগটিকে বাস্তবায়ন করেছে। আমরা লকডাউন চলাকালীন প্রায় ৩ হাজার অটোরিকশা চালককে দুই মাস ধরে আর্থিক সহযোগিতা করেছি। লকডাউন আরও দীর্ঘায়িত হলে আর্থিকভাবে ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষদের জন্য কী করা যেতে পারে সে বিষয়ে আমরা আরও গবেষণা ও পরিকল্পনা করছি।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনার উদ্যোগ থেকে সমাজের ধনীরা কী শিক্ষা নিতে পারে?

আনিস আহমেদ: আপনি যখন সেই সব মানুষদের কাছে পৌঁছবেন যারা সুবিধা বঞ্চিত, তখন বুঝতে পারবেন আপনার জীবনটা আসলে কতটা স্বচ্ছন্দ্যে ভরা। অল্প কিছু দান করেই আপনি অনেক মানসিক পরিপূর্ণতা পেতে পারেন। আগে আমরা প্রচারবিহীন দানে বিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু, মহামারির এই ধাক্কা আমাদের পরিকল্পনা পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। এখন আমরা চাই ধনীরা আমাদের উদ্যোগ সম্পর্কে জানুক, যাতে দরিদ্রদের কল্যাণে আরও বেশি হাত এগিয়ে আসে।

Comments

The Daily Star  | English

Cyber protection ordinance: Draft fails to shake off ghosts of the past

The newly approved draft Cyber Protection Ordinance retains many of the clauses of its predecessors that drew flak from across the world for stifling freedom of expression.

7h ago