হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল, মর্মান্তিক-অমানবিক!
গতকাল দ্য ডেইলি স্টারে আমরা একটি ছবি প্রকাশ করেছি ক্যাপশনে মোটামুটি বিস্তারিত লিখে। যেখানে দেখা যাচ্ছে— ২৪ বছর বয়সী অন্তঃসত্ত্বা ঝুমা শহীদ মিনারের কাছে ফুটপাতে মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থায় বসে আছেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামী সুজনের গায়ে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
আমাদের ফটোসাংবাদিক আনিসুর রহমান মাঝেমধ্যে সেহরি করেই কাজে নেমে পড়েন। গত ২০ মে ভোর ৫টার দিকে আনিস এই তরুণ দম্পতির দেখা পেয়েছিলেন।
এই দম্পতি আনিসকে যা জানিয়েছিলেন—
এখন থেকে এক মাসের মধ্যে সন্তান জন্ম দেওয়ার কথা অন্তঃসত্ত্বা ঝুমার। ইতোমধ্যেই তিনি জানেন যে তার যমজ ছেলে সন্তান হবে। গত ২০ মে ভোররাত ৩টার দিকে তার প্রসববেদনা শুরু হয়। তখন স্বামীসহ তিনি নিজ এলাকার ক্লিনিকগুলোতে যান। কিন্তু, কোনো ক্লিনিকই তাকে ভর্তি করেনি। কারণ, তার জ্বর ছিল। পরে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারা মিরপুরের একটি ক্লিনিকের খোঁজ পান, যাদের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসও আছে। তারা ওই সার্ভিসের সহায়তা নেন এবং ভাবেন, এখানেই তাদের কষ্ট শেষ।
ক্লিনিকে পৌঁছানোর পর তাদের জানানো হয়, যেহেতু ঝুমার জ্বর আছে, তাই নো-কোভিড সার্টিফিকেট ছাড়া তাকে ভর্তি করা যাবে না। তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পৌঁছানোর পর তাদেরকে বলা হয় করোনা ইউনিটে যেতে।
কিন্তু, সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কায় স্বাভাবিকভাবেই তারা সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানান। এরপরে তারা ফুটপাতে আশ্রয় নেন, যেখানে আমাদের ফটোসাংবাদিক আনিসের সঙ্গে তাদের দেখা হয়।
এই সময়ের মধ্যে ঝুমার প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু, তার কোথাও যাওয়ার ছিল না এবং কেউই তাদের সহায়তা করছিল না। ঝুমা হতাশ ও উন্মত্তপ্রায় হয়ে ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘটনাস্থল দিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছিল। আনিস অ্যাম্বুলেন্সটি থামার ইশারা দিয়ে চালককে অনুরোধ করে মানবিক বিবেচনায় ঝুমাকে কোনো একটা ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার। অ্যাম্বুলেন্সচালক প্রথমে না চাইলেও পরে ঝুমার অবস্থা দেখে অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হন।
অ্যাম্বুলেন্সচালক তাদের বেশ কয়েকটি ক্লিনিকে নিয়ে যান। কিন্তু, কোনো ক্লিনিক তাকে ভর্তি করতে রাজি হয়নি। এরপর এই দম্পতি যে এলাকাতে বাস করেন, সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে গাজীপুরের একটি জরাজীর্ণ ক্লিনিক ‘নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা যাবে না’ এই শর্তে তাকে ভর্তি করাতে রাজি হয়। বেলা ১২টা ৪০ মিনিটে ওই ক্লিনিকেই সি-সেকশনের মাধ্যমে যমজ সন্তান জন্ম দেন ঝুমা। গতকাল পাওয়া খবর অনুযায়ী, মা-দুই সন্তান উভয়ই সুস্থ আছেন।
কাহিনিটির সমাপ্তি মর্মান্তিক না হয়ে, সুখেরই হলো!
কিন্তু, এটি এমন নাও হতে পারতো। ঝুমা যমজ সন্তান প্রসবের বেদনায় ছিলেন। যার মানে সীমিত সময়ের মধ্যেই তার পরিচর্যা এবং তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা সহায়তার প্রয়োজন ছিল। যেসব ক্লিনিক তাকে ভর্তি করেনি, সেগুলোর প্রত্যেকটিই তাকে ভয়াবহ বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তার বা তার যমজ সন্তানের জীবনশঙ্কার সম্ভাবনা ছিল। প্রতিটি ক্লিনিক পরিচালনাকারীরা তা খুব ভালোমতো জানতেন।
প্রসববেদনা নিয়ে যাওয়া একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকে কীভাবে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো ফিরিয়ে দিতে পারলো? ন্যূনতম কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যেত যে তিনি এক ক্লিনিক থেকে অন্য ক্লিনিকে যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না। একপর্যায়ে তার প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ শুরু হলো। কিন্তু, এরপরেও তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। যেকোনো কারণ, এমনকি প্রসববেদনার কারণেও জ্বর আসতে পারে। জ্বর ছাড়া কোভিড-১৯’র আর কোনো লক্ষণ ঝুমার মধ্যে ছিল না।
জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট নিয়ে যাওয়া রোগীদের প্রতিদিনই চিকিৎসাসেবা না দেওয়ার অনেক সংবাদ সম্প্রতি আমরা প্রকাশ করেছি। (গতকাল ২১ মে ২০২০ প্রকাশিত সংবাদ: ‘ভিকটিমস অব ডিনায়াল’)। রোগীদের ভর্তির আগে ‘নো-কোভিড’ সার্টিফিকেট চাওয়া হচ্ছে। সীমিতসংখ্যক জায়গা বাদে (২৩টি টেস্টিং বুথ, যেগুলোর অবস্থানও ভালোভাবে জানা নয় এবং শহরের সব সরকারি হাসপাতাল) অন্য কোথাও থেকে এই সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে না। কেউ যদি সেই জায়গায় গিয়ে পরীক্ষা করাতে পারার মতো ভাগ্যবান হন, তাহলে তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে তিনি ফলাফল পাবেন।
তাহলে এই সময়কালে সাধারণ কোনো রোগে অসুস্থ একজন মানুষ কী করবেন? যার নিয়মিত কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হয় এবং তার যদি জ্বর আসে, কী করবেন তিনি? ‘নো কোভিড-১৯’ সার্টিফিকেট জোগাড় করবেন কয়দিনে, এই সময়ে ডায়ালাইসিস করতে না পারলে- বাঁচবেন কীভাবে?
কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত নন, এমন গুরুতর রোগীরাও হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা না পেয়ে, এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল ঘুরে প্রতিদিনই দু’একজন মারা যাচ্ছেন। গত ১৮ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া নির্দেশিকায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে, যদি চিকিৎসার দেওয়ার সুবিধা থাকে, তাহলে কোনো রোগীকে সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানানো যাবে না। যারা রোগে ভুগছেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন, তাদের কাছে এই নির্দেশনা অর্থহীন।
আর কিছু না হলেও এই ধরনের কঠিন পরিস্থিতিতে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা যাতে চিকিৎসাসেবা পান, ডায়ালাইসিস যাতে পান, এর জন্যে জরুরিভিত্তিতে বিশেষ উদ্যোগ প্রত্যাশিত। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলি, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের যারা গর্ভাবস্থার শেষের দিকে, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, সে সময়ে যেকোনো মুহূর্তেই তাদের জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
পুনশ্চ
একটি সহজ সমাধান হলো প্রত্যেকটি হাসপাতালে কোভিড-১৯ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা এবং সেই অনুযায়ী রোগী ভর্তি করা। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট যদি সফল হয়, তাহলে এটির মাধ্যমে সঠিক সমাধান দেওয়া যেতো। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এখনো এটির অনুমোদনে দেরি হচ্ছে। শুধু ভেবে দেখুন, সহজে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা গেলে পরিস্থিতির কতটা উন্নয়ন সম্ভব ছিল, জনমানুষের দুর্ভোগ কতটা কমে যেত!
মাহফুজ আনাম, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক
Comments