হতাশার পর ভরসা হার্ড ইমিউনিটিতে
‘হার্ড ইমিউনিটি’ বা ‘গণ রোগপ্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন’ যে কোনো মহামারি মোকাবিলার শেষ প্রতিকার। আর কোনো উপায় নেই বলেই করোনাভাইরাসবিরোধী যুদ্ধে বাংলাদেশ যেন সে পথেই হাঁটছে।
ইউরেকা (পেয়েছি)! গ্রিক বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস নিজের ঘরে বাথটাবে গোসল করার সময় প্লবতার সূত্র খুঁজে পেয়ে ‘ইউরেকা’ বলতে বলতে নগ্ন হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিলেন।
আমরা কি করছি?
না, আমরা আর্কিমিডিস না এবং আমরা কোনো সূত্রও খুঁজে পাইনি। খোঁজার চেষ্টা যে করেছি, তাও দৃশ্যমান নয়। যতটা দৃশ্যমান হয়েছে, তা বড় বেশি রকমের অগোছালো-অপরিকল্পিত মনে হয়েছে। তারপর যেন হাল ছেড়ে দিয়ে ‘ভরসা‘র পথে চলছি।
গত কয়েক মাস ধরে দুর্বিসহ মানসিক চাপ ও হতাশায় কেটেছে! ইতোমধ্যে প্রায় তিন লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে এই মহামারিটি পুরো বিশ্বকে থমকে দিয়েছে। মহামারি থেকে উত্তরণের আশার বাণী শোনাতে পারছে না কেউ। এখন বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষকে ‘হার্ড ইমিউনিটি’র ওপর ‘ভরসা‘ করে বেঁচে থাকার কঠোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
পৃথিবীতে এর আগে যত মহামারি এসেছে তা শেষ হয়েছিল ‘হার্ড ইমিউনিটি’র মাধ্যমেই। এই প্রতিরোধ সক্ষমতা আমরা পেতে পারি দুই ভাবে— ভ্যাকসিনের মাধ্যমে বা প্রাকৃতিকভাবে। গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী, প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের জন্য এই ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শেষ করতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে।
এরপর বিশ্বের ধনী-ক্ষমতাধর দেশগুলোর চাহিদা পূরণ করে সেই ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আসতে দুই বছরের বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
সুতরাং, কার্যত বেঁচে থাকার জন্য আমাদের একটাই উপায় আছে। আর তা হলো প্রাকৃতিকভাবে অর্জিত রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা। এই রোগে আক্রান্ত হলে, শরীরের ডিফেন্স মেকানিজম অটোমেটিক্যালি রিঅ্যাক্ট করে একধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি শুরু করবে এবং শরীর একসময় প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করবে।
অবাস্তব মনে হচ্ছে?
মহামারি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। কারণ ভাইরাসের অজানা বৈশিষ্ট্য এবং বিশ্বের চিকিৎসা অক্ষমতার কারণে পরিস্থিতি প্রতিদিনই বদলাতে থাকে। তবে কয়েক মাস ধরে চলা সংক্রমণের বিষয়ে সরকার ও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা বেশ সহজ। পছন্দ হোক আর না হোক, বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের সবার আচরণ আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত করে দিয়েছে। হয়ত তা গ্রিক নাটকের পূর্ব নির্ধারিত ট্রাজিডির মতোই।
এই সংক্রমণ এখন আমাদের অধিকাংশের জন্যে হয়ত অনিবার্য।
আমাদের সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি এখন আর থাকছে না। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের কারণে প্রথম মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে ২৬ মার্চ থেকে জনসমাগমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। প্রায় ৪৮ দিন আগে আরোপিত বিধিনিষেধের বেড়াজাল ধীরে ধীরে কাটছে।
পোশাক কারখানা ২৬ এপ্রিল, মসজিদ ৭ মে ও শপিংমল ১০ মে থেকে আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। আগামী ১৫ মে পর্যন্ত দেশব্যাপী শিথিল লকডাউন (জাতীয় ছুটি) ও ৩০ মে পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
‘নিজেকে নিজেই বাঁচান’— এটাই এখন না বলা মেসেজ। সরকারের দৃষ্টি এখন মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার দিকে। শাটডাউনের কারণে ছোট-বড় সব ধরণের ব্যবসা-বাণিজ্য বিপদের মুখে। রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রা, রাজস্ব, নতুন ব্যবসা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং খাদ্য সংকট নিয়ে সত্যিই সরকারকে উদ্বিগ্ন হতে হচ্ছে।
প্রায় ৫০ দিনের লকডাউনের পরও কেন আমাদের এমন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে?
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অন্যান্য দেশগুলো যেসব ব্যবস্থা নিয়েছিল, আমরা কি তা নেইনি? হ্যাঁ, সুরক্ষা নীতিমালা, পিপিই, পরীক্ষা, সংক্রামক শনাক্ত, হোম আইসোলেশন, প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন, অর্থনৈতিক প্রণোদনা, সুরক্ষামূলক কর্মসূচি হিসেবে সচেতনতামূলক প্রচারণা, কোনোকিছুই খুব সুপরিকল্পিতভাবে করেছি বলা যাবে না। শিথিল করার ক্ষেত্রে তারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
সরকার প্রথমাবস্থায় সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলেও, অন্যান্য দেশের দক্ষ সরকারের মতো প্রায় সব সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। সমস্যা হয়েছে যেভাবে সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। করোনাভাইরাস নামক একটি অদৃশ্য শত্রু আমাদের প্রশাসন, রাজনীতি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আসল চেহারা উন্মোচন করে দিয়েছে।
দেশের সর্বোচ্চ নেতার দৃঢ় ও দূরদর্শী নেতৃত্ব দেখা গেলেও তার অধীনস্থদের ক্ষেত্রে তা ছিল অদৃশ্য।
সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রথম অংশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মহামারির কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রোধ করা, সংক্রমিতদের আলাদা করা, গুরুতর রোগীদের চিকিত্সা নিশ্চিত করা ও দরিদ্রদের খাবারের ব্যবস্থা করা। প্রায় দুই কোটি মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা সহজ কাজ নয়।
এবং, আমরা প্রথম অংশের কথাস্বর্বস্ব যুদ্ধে ব্যর্থ হয়েছি।
ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ার আগে চীনের উহানে যখন সংক্রমণটি ছড়ায় তখন থেকে পূর্ব প্রস্তুতির জন্য বাংলাদেশ প্রায় দুই মাস সময় পেয়েছিল।
দুঃখের বিষয়, বেশিরভাগ প্রভাবশালী মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তা তখন ব্যস্ত ছিলেন চাটুকারিতা, অদক্ষতা ও সমালোচনার প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখাতে।
জনগণ যখন তাদের দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে, তখন তারা গর্ব করে বলতে ব্যাস্ত ছিলেন: ‘আওয়ামী লীগ করোনাভাইরাসের চেয়ে শক্তিশালী’, ‘করোনাভাইরাস বাংলাদেশে আসবে না’, ‘প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে দেশ করোনামুক্ত’, ‘অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রস্তুতি অনেক ভালো’ ইত্যাদি।
ক্ষমতাসীনরা করোনাভাইরাসের ক্ষমতাকে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি। ফলে তারা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে করোনাভাইরাস মোকাবিলার পথ বেছে নিয়েছে। অথচ, এটা হওয়া উচিত ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল যুদ্ধ। যেখানে থাকবে চিকিত্সক, স্বাস্থ্যকর্মী, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এনজিও কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীরা। তাদেরকে এক ছাদের নিচে এনে, একক নেত্রৃত্বের অধীনে কাজে লাগানো দরকার ছিল। যা করা হয়নি। যার পরিণতিতে ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হলেও একটি কঠিন-কঠোর জাতীয় নির্দেশনা অনুপস্থিত থেকে গেছে।
সঠিক যুদ্ধ পরিকল্পনার অভাবে প্রায় সারা দেশ ভুগেছে। তবে বাংলাদেশের মতোই ঘনবসতি, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেশ ভিয়েতনামের কাছ থেকে আমরা সঠিক শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তারা সমগ্র বিশ্বকে দেখিয়েছে যে কীভাবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়। মাত্র ৩০ দিনেরও কম সময়ের লকডাউনের মাধ্যমে যুদ্ধের প্রথম অংশে জিততে হয়। ভিয়েতনামে ২৮৮ জন সংক্রমিত হয়েছে, যার মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছে ২৪৯ জন। দেশটিতে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা শূন্য। কঠোরভাবে কোয়ারেন্টিন মেনে চলা ও সংক্রমিতদের সংস্পর্শে যারাই এসেছে তাদের সবাইকে শনাক্ত করার মাধ্যমে তারা এই যুদ্ধে জয়ী হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এতো বেশি সংখ্যক পরীক্ষা করার সক্ষমতা ভিয়েতনামের নেই বলে তারা সংক্রমিতদের সংস্পর্শে আসা সবাইকে কোয়ারেন্টিনে নেওয়ার পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। সংক্রমিতর সঙ্গে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরেও যারা সংস্পর্শে এসেছে তাদের দিকেও দেশটি লক্ষ্য রেখেছে। তাদের সবার চলাফেরা ও কাজের ওপর কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করেছে।
দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের গল্প দুর্নীতিগ্ৰস্ত সংস্কৃতির। সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে কারা এসেছে তা একেবারেই আমলে নেওয়া হয়নি। পরীক্ষা হয়েছে একেবারেই অপর্যাপ্ত। কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন ছিল উপহাসের নামান্তর। চিকিৎসক, পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবীসহ সম্মুখযোদ্ধাদের অনেক মন ভালো করা ঘটনা আছে। কিন্তু, তাদের গল্পটা হারিয়ে গেছে আমাদের সম্মিলিত অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডে।
এমনকী, যখন সংক্রমণের কারণে আমাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে, তখনও হতবাক করে দেওয়ার মতো সংবাদ শিরোনাম তৈরি করার মতো কাজ করে গেছি। করোনাভাইরাসের উত্স দেশ থেকে আসা যাত্রীদের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে হাতে ধরা ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে। চৌদ্দ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার মৌখিক পরামর্শ দিয়ে প্রায় সাত লাখ বিদেশফেরত বাংলাদেশির কোয়ারেন্টিন সম্পন্ন করা হয়েছে। এন৯৫ এর নামে নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে। ডাক্তার-নার্সরা পিপিই না পেলেও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সেগুলো পরে বসে থেকেছেন। সরকার বন্ধ ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক হাজার মানুষ কক্সবাজারে ছুটি কাটাতে গেছেন। দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দ করা চাল আত্মসাতের দায়ে ৫৪ চেয়ারম্যান-মেম্বারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লকডাউনের নীতিমালা ভঙ্গ করে প্রায় দেড় লাখ মানুষ হাজির হয়েছেন জানাজায়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হলেও জুমার নামাজে মসজিদ হয়েছে কানায় কানায় পূর্ণ। লকডাউনের মধ্যেও কাঁচাবাজারে মানুষের গিজগিজে ভিড়; ১১ সাংবাদিকের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। নিখোঁজ হওয়া সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ৫৩ দিন পর ‘আইনিভাবে গ্রেপ্তার’ হয়েছেন, মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে সাংবাদিকের হাতে লাগানো হয়েছে হাতকড়া।
এগুলো করোনাভাইরাস নিয়ে আমাদের যুদ্ধের প্রথম অংশের কয়েকটি ছোট ছোট গল্প।
যুদ্ধে আমরা নিশ্চিতভাবেই জিতিনি, তবে এখনও হেরে যাইনি।
যদিও কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি, তবে বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক কারণ আমাদের পক্ষে কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের অন্য ছয়টি স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে আমাদের সক্ষমতা আছে। যেগুলোর কারণে ফ্লু হয়। আমাদের অদ্ভুত রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা তৈরি হয়েছে কয়েক দশক ধরে অণুজীব ও দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থেকে। তুলনামূলকভাবে কম মৃত্যু সংখ্যা (করোনাভাইরাসে ২৬৯ জন এবং আরও কয়েকশ উপসর্গ নিয়ে) ও সর্বদা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকা আমাদের জিন ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের ব্যাপারে আশাবাদী করে তোলে।
‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের পথে অনেক মৃত্যু ছড়িয়ে থাকবে। তবে আমরা অধিকাংশই অনেক দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে পথের শেষে গিয়ে বেঁচে থাকবো। বেঁচে থাকার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের লড়াই এসে সামনে দাঁড়াবে। সেটা আমাদের এই সংক্রামক যুদ্ধের দ্বিতীয় অংশ।
Comments