‘খালি আপনেই খাইবেন? আমরা খামু না?’

এপ্রিল নিষ্ঠুর, আরও বেশি নিষ্ঠুর হতে পারে মে

গত বৃহস্পতিবার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের প্রবেশপথে দুই সন্তানের জননী আমেনা বেগম অপেক্ষায় ছিলেন কিছু পাওয়ার। কেরানীগঞ্জে একটি ছোট পোশাক কারখানার মেশিন অপারেটর ছিলেন তিনি। চলতি মাসের শুরুর দিকে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরি হারিয়েছেন আমেনা। অসুস্থ স্বামী কর্মক্ষম না হওয়ায় বেঁচে থাকার তাগিদে সাহায্য চাইতে বের হয়েছেন। ছবি: আনিসুর রহমান

ঢাকায় এবারের এপ্রিল মাসের আচরণ আমাদের পরিচিত এপ্রিলের মতো না। মাসটা অনেকটা বসন্তের মতো সুন্দর হয়ে উঠেছে।

চারদিকে নির্মল ঠান্ডা বাতাস আর কোলাহলহীন পথঘাট। এই নীরবতার কারণে কানে আসে পাখির কলতান, সবজিওয়ালাদের হাঁকডাক, মাঝে মাঝে রিকশার টুং-টাং বেল আর কুকুরের ডাক। মৃদু বাতাসে উড়তে থাকা জানালার পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকলে করোনাভাইরাস মহামারিতে চলমান লকডাউন হয়ে উঠতে পারে উপভোগ্য বিষয়।

তবে, যদি জরুরি ওষুধ বা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য ঘরের বাইরে বের হন, তাহলে বুঝতে পারবেন ঢাকার প্রায় নির্জন রাস্তাগুলো কত বদলে গেছে এই এক মাসে।

বের হলেই চারপাশ থেকে আপনাকে ঘিরে ধরবে এমন কিছু মানুষ, কদিন আগেও যারা বিভিন্নভাবে আপনার কাজে এসেছে। দেখতে পাবেন তাদের ক্ষুধার্ত মুখগুলো। হতবাক হয়ে যাবেন বাসার কাজের সহকারী-এখন যার বাসায় ঢোকার অনুমতি নেই, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, যানবাহনের মেকানিক, দোকানের কর্মচারী, শ্রমিক এবং পোশাক কারখানার কর্মীদের দেখলে। দিন এনে দিন খাওয়া এমন মানুষের সংখ্যা ঢাকার দুই কোটি জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ। ধীরে ধীরে তারা ভিখারিতে পরিণত হচ্ছেন। বেশ আগ্রাসী ভিখারি। তাদের দাবি না মানলে পড়বেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমার সামনে। তখন কিছুটা ধনী হওয়ার জন্য অসহায় ভাবতে শুরু করবেন নিজেকে।

দ্য ডেইলি স্টারের কয়েকজন সাংবাদিক এবং আরও কয়েকজন তাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন। সেগুলো শুনলে আপনি হয়ত ঢাকায় আর কখনও এমন এপ্রিল আসুক তা প্রত্যাশা করবেন না। ভয়ে থাকবেন পরের মাস মে নিয়ে।

গত বুধবার দ্য ডেইলি স্টারের একজন সিনিয়র সাংবাদিক ঘর থেকে বাইরে বের হন ওষুধ কিনতে। মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে বাসার পাশের একটি দোকানে যাওয়ার জন্য সুউচ্চ ভবনটি থেকে বের হওয়া মাত্রই তার সামনে এসে দাঁড়ায় পাঁচ থেকে ছয়টি রিকশা। প্রত্যেক চালকই তাকে জোর করতে থাকে রিকশায় ওঠার জন্য।

রিকশা চালকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘না, আমি বেশি দূর যাব না।’

এমন কথার জবাবে তিনি প্রশ্নের বাণে জর্জরিত হন।

‘স্যার, আপনেরা রিকশা না নিলে আমরা খামু ক্যামনে?’

‘আমাগো বাঁচতে হইব না?’

‘আপনারা কি আমগো নিয়া চিন্তা করবেন না?’

এরপরই এল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক দাবি। ‘আইচ্ছা, তাইলে কিছু ট্যাহা দেন।’

সেখান থেকে চলে গেলেন তিনি। হাঁটতে থাকলেন সামনের দিকে। প্রায় ১০০ গজ যেতেই মধ্যবয়স্ক অচেনা একজন তাকে থামিয়ে বললেন, ‘আস সালামু আলাইকুম, স্যার।’

এক দোকানে কাজ করতেন তিনি এবং দু সপ্তাহ ধরে কাজ নেই জানিয়ে মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটি দাঁতে দাঁত চেপে তাকে বললেন, ‘আমার বাচ্চা দুইটা না খেয়ে আছে ...আপনাদের তো অনেক টাকা।’

ওষুধের দোকানের কাজ সেরে ফেরার পথে তাকে ঘিরে ধরেন চার জন।

‘স্যার, তিন সপ্তাহ আগে আমাদের কাজে যাইতে না কইরা দিছে।’

‘গতকাল থিকা খাই নাই।’

‘বাচ্চাগুলা নিয়া না খায়া আছি।’

‘আপনে ওষুধ কেনেন, আর আমাগো বাইচা থাহার মতো খাওন নাই।’

একটি পোশাক কারখানার ম্যানেজার কামাল হোসেন মধুবাগ এলাকার এক দোকান থেকে মুদি সামগ্রী কিনে ফেরার পথে প্রায় ৫০ বছর বয়সী দুজনের মুখোমুখি হন। তারা দাবি করে বসেন, ‘আমাগো কিছু দেন।’

হঠাৎ করে তাদের কথা শুনে চমকে ওঠেন কামাল হোসেন। মাফ করেন বলে তিনি ভয়ংকর একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হন। ‘খালি আপনেই খাইবেন? আমরা খামু না?’

গত বৃহস্পতিবার তিনি বলছিলেন, ‘তাদের সাহায্য করতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু, আমি নিজেই পাঁচ জনের পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকি। আমার কারখানা লে অফ হয়ে যাচ্ছে। চাকরি থাকবে কিনা সন্দেহ।’

গত মঙ্গলবার সিনিয়র ব্যাংকার ফয়েজ আহমেদ ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের একটি সুপার শপ থেকে ১৫ দিনের মুদি সামগ্রী কেনেন। সেগুলো ব্যাগে করে নিয়ে প্রায় ১০০ গজ দূরে পার্ক করে রাখা গাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। দোকান থেকে বাইরে আসার পর তাকে ঘিরে ধরে একদল ভিক্ষুক। তিনি ৫০০ টাকা দিয়ে তাদের হাত থেকে নিস্তার পান। তারপরও, জরাজীর্ণ পোশাক পরা একদল ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে তার পিছনে দৌড়াতে থাকে টাকার জন্য। তাদের দৌড়াদৌড়ি আর টানাটানির মধ্যেই একটি ব্যাগ ছিঁড়ে যায় এবং ব্যাগের সব জিনিসপত্র মাটিতে গড়িয়ে পড়ে।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘ব্যাগ থেকে পড়ে যাওয়া কিছু জিনিস আর পাইনি। কিন্তু, আমি চিন্তিত আগামী দিনগুলো নিয়ে।’

রাস্তায় যেসব গাড়ি দাঁড়ায় সেগুলোর জন্য ওঁত পেতে থাকে কিছু ভিক্ষুক আর মলিন মুখের মানুষ। ব্যবসায়ী মোসলেম উদ্দিন কয়েকদিন আগে কিছু মুদি সামগ্রী গাড়িতে বোঝাই করে সিটি কলেজের কাছে গিয়ে থামেন। সেখানে ফুটপাতে বসে থাকা গরিব মানুষদের মাঝে এগুলো বিতরণ করতে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল যুবক এসে ভিক্ষুকদের মারধর করে তাড়িয়ে দেয়।

গাড়ি থেকে বেশিরভাগ ব্যাগ তারা নামিয়ে নিয়ে যায় এবং খুব বাজেভাবে তাকে বলে, ‘যান এখান থেকে।’

গত বৃহস্পতিবার মৌচাক মোড়ে সরকারি ভর্তুকির ওএমএসের পণ্য ট্রাকে বিক্রি হচ্ছিল। দীর্ঘ সারি দিয়ে সেখান থেকে পণ্য কিনছে মানুষ। ছবি তোলার জন্য মোটরসাইকেল থামিয়ে এগিয়ে যান আমাদের ফটো সাংবাদিক প্রবীর দাশ।

মোটরসাইকেল থেকে নামার পরপরই একদল যুবক তাকে ঘিরে ধরে। দ্রুত মোটরসাইকেলে উঠে সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করে। প্রবীর বলেন, ‘অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি তাদের তাকানোর ধরন স্বাভাবিক ছিল না। তাদের চোখে ভয়ঙ্কর কিছু ছিল!’

দিন যত যাচ্ছে ততই বাড়ছে অর্ধাহার আর অনাহারে থাকা এই মানুষের সংখ্যা। অনেককেই দেখা যাচ্ছে দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করতে। কিন্তু, এই চরম সংকটে দরিদ্র মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করা সরকারেরই দায়িত্ব।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার দরিদ্র মানুষের জন্য তিন হাজার ৬০৩ টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। এই চাল কি সঠিক ভাবে বিতরণ করা হয়নি নাকি সেগুলো চার লাখ দরিদ্র মানুষের জন্য পর্যাপ্ত না?

দিন এনে দিন খাওয়া বেশিরভাগ মানুষ এনআইডি কার্ড না থাকার কারণে ভর্তুকির চাল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার ভোর তিনটা থেকে মুগদা বাসস্ট্যান্ডে সরকারি চাল আসার অপেক্ষায় থাকা এক শ্রমিক দুপুরের দিকে বলেন, ‘আমরা যহন ঢাহায় কামের জন্যি আইছি তহন তো কাড আনি নাই। এহন আমরা গ্রামেও যাতি পারতিছি ন্যা। তালি কি আমরা না খায়া মরব?’ (আমরা যখন ঢাকা কাজের জন্য এসেছি, তখন তো কার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) আনিনি। এখন আমরা বাড়িতেও যেতে পারছি না। তাহলে কি আমরা না খেয়ে মরব?)

দ্য ডেইলি স্টারের ফটো সাংবাদিক এস এনামুল হককে এই প্রশ্ন করেন তিনি। প্রশ্ন করার সময় তার চোখে ছিল পানি আর চেহারা জ্বলছিল ক্রোধে।

সৈয়দ আশফাকুল হক: দ্য ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক

Comments

The Daily Star  | English

Managing expectations the challenge for EC

The EC was a rubber stamp to legalise AL's usurpation of power in last three elections

1h ago