ঢামেকে কোভিড-১৯ চিকিৎসা, অন্যান্য রোগীদের সেবা পাওয়া নিয়ে শঙ্কা
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ গত ১৬ এপ্রিল সার্কুলার জারি করে জানায়, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটকে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ কারণে সেখানকার রোগীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এরপর গত ২১ এপ্রিল জারিকৃত অপর সার্কুলারে সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়ে যায়। এতে বলা হয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট এবং হাসপাতালের মূল জেনারেল মেডিসিন বিভাগের ২ নম্বর ভবনকে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সে কারণে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগীদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে সরিয়ে নেওয়া হবে।
এ ছাড়াও, কোভিড-১৯ আক্রান্তদের জন্য নির্ধারিত অন্য তিনটি হাসপাতাল- মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরের জন্য হাসপাতালগুলোর পরিচালকদের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
ওই দিন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের রোগীদের তারা সরিয়ে নিয়ে আসবেন।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, হাসপাতালের মূল জেনারেল মেডিসিন বিভাগের ২ নম্বর ভবনের রোগীদের কোথায় রাখা হবে, সে ব্যাপারে তখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
আজ শুক্রবার সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আগামী রোববার থেকে ঢাকা মেডিকেলে ৩০০ শয্যার এই করোনা ইউনিট চালু হবে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসিরউদ্দিন।
যদিও কর্মরত চিকিৎসকদের না জানিয়েই ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন চিকিৎসকরা। জেনারেল মেডিসিন বিভাগের ২ নম্বর ভবনের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রেখে, সেখানেই আবার করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হলে হাসপাতালের পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা ধসে পড়বে বলে মনে করছেন অনেক চিকিৎসক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চিকিৎসক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলের জেনারেল মেডিসিন বিভাগের ২ নম্বর ভবনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ডায়ালাইসিস সেন্টার। এখানে নয় তলায় হেমোটোলজি অর্থাৎ বোন মেরু ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন হয়, তিন তলায় কার্ডিয়াক সার্জারি, পাঁচ-ছয়-সাত-আট তলায় মেডিসিনের চিকিৎসা হয়। নতুন নির্দেশনা অনুসারে এখানকার সব রোগীকে সরিয়ে নিতে হবে এবং সার্জারি ও গাইনি বিভাগেই কেবল করোনার ট্রিটমেন্ট হবে না।’
‘মুশকিল হলো, ঢাকা মেডিকেলে রোগী আসা-যাওয়া, চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন বিভাগে যাতায়াতের প্যাসেজ একটিই। সেক্ষেত্রে কোভিড-১৯ রোগী ও তাদের সঙ্গে থাকা সম্ভাব্য আক্রান্ত লোকজনের সংস্পর্শ এড়ানোর সুযোগ নেই। কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই আগামী রোববারের মধ্যে এখানে করোনার মত অধিক ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্তদের ভর্তি করানোর পরিকল্পনা হচ্ছে এবং বিষয়টি আমাদের পত্রিকার মাধ্যমে জানতে হয়েছে’, বলেন তিনি।
পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই ঢামেকে করোনা ট্রিটমেন্ট চালুর বিষয়ে জানতে চাইলে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘এতদিন আমরা নন-কোভিড ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা প্রদান করেছি। প্রতিদিন আমাদের জরুরি বিভাগে প্রায় ৪০০-৫০০ রোগী এসেছেন। তাদের মধ্য থেকে ৫০-৬০ জনকে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে আমরা বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠিয়েছি এবং তাদের মধ্যে বেশিরভাগই করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। গত ১ এপ্রিল থেকে আমাদের এখানেও করোনা টেস্ট করা হচ্ছে।’
‘এখন ঢামেককে যদি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তাহলে কোভিড-১৯ হাসপাতালের জন্য আন্তর্জাতিক যে নিয়ম আছে, কুয়েত মৈত্রী ও কুর্মিটোলা হাসপাতালে যে নিয়ম মানা হচ্ছে, যেমন: একজন চিকিৎসক সাত দিন কাজ করবেন, এরপর কাছের কোনো হোটেলে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন থাকবেন এবং পরে বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজে যোগ দেবেন। তবে দুঃখের বিষয় হলো- তিন দিন আগে নির্দেশ এলো, দুদিন পর ট্রিটমেন্ট শুরু হতে যাচ্ছে, অথচ যারা চিকিৎসা দেবেন তাদেরকে নিয়ে ঢামেকের পরিচালক অন্তত একদিন বসার প্রয়োজনটুকু অনুধাবন করেননি’, বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল চিকিৎসকরা নিজেরা মিলেই বসেছিলাম। এখনকার পরিস্থিতিতে করণীয় এবং আমাদের প্রস্তুতির বিষয়ে আলোচনা করেছি। সেখান থেকে কিছু দাবি-দাওয়া উঠে এসেছে, যেগুলো অত্যাবশ্যকীয়। যেমন: অ্যাপ্রোপ্রিয়েট পিপিই এবং এন-৯৫ মাস্ক লাগবে। তাছাড়া কে কে চিকিৎসা দেবেন, তাদের ডিউটি রোস্টার কী হবে, তারা থাকবেন কোথায়, এ বিষয়গুলো রয়েছে। অপরদিকে কোভিড-১৯ রোগী ও তাদের সঙ্গে থাকা লোকজন কোন দিক দিয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করবেন এবং বেরিয়ে যাবেন, এখানে তাদের অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কী হবে, এসব বিষয়ে কোনো প্রস্তুতিই নেই।’
‘এর মধ্যে আরেকটি ভয়ের বিষয় হলো ডেঙ্গু। গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকজন ডেঙ্গু রোগী ঢামেকে এসেছেন। যেহেতু আমরা এখনও সে দিকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছি না। তারপরও কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। দেশে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মে মাসে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। গত দু’বছর ধরে ডেঙ্গু চিকিৎসায় বৃহত্তর কৃতিত্ব দেখিয়েছে ঢামেক। এখন থেকে যেহেতু করোনার ট্রিটমেন্ট হবে, তাহলে ডেঙ্গু রোগীরা যাবে কোথায়? এপিডেমিওলজিস্ট ও ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়া এ ধরণের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের আমরা কোনো কারণ খুঁজে পাই না’, বলেন এই চিকিৎসক।
এসব বিষয়ে ঢামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসিরউদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ওয়ার্ড, অপারেশন থিয়েটার রেডি করছি, আইসিইউ’র একটু পুনঃব্যবস্থাপনা করতে হবে। জনবল প্রস্তুত করছি। ডাক্তারদের থাকার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। সেজন্য আমরা হোটেল খুঁজছি। বেশ কিছু হোটেলের সঙ্গে কথা বলেছি। কারণ এক জায়গায় তো আর এতগুলো হোটেল পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা আশা করছি আগামীকাল সেসব বিষয়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলব।’
করোনার চিকিৎসার প্রস্তুতি বিষয়ে তিনি বলেন, ‘করোনা চিকিৎসকদের চারটি গ্রুপ করা হবে। যারা এখানে ডিউটি করবেন, তারা হোটেলে আলাদাভাবেই থাকবেন। তাছাড়া করোনা ইউনিটকে মূল হাসপাতাল থেকে একটু আলাদা রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমরা ব্যারিয়ার দিচ্ছি। আমাদের একটি গেট ছিল, যেটি বন্ধ থাকে। সেই গেট দিয়েই এবার আমরা করোনা রোগীদের আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। দেখা যাক, পরবর্তীতে হয়ত সেগুলোতে আরও পরিবর্তন আনতে হতে পারে।’
চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা না করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বসার কি আছে এখানে। সবাই এখানে সরকারের কর্মচারী। যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হবে, সে সেখানে দায়িত্বপালন করবে। যারা করোনার ট্রিটমেন্ট করবে, তাদের সঙ্গে কি বসে আলাপ করতে হবে? এখানে তো কয়েক হাজার চিকিৎসক-নার্স আছে, এখন সবার সঙ্গে বসে কি আমরা আলাপ করব? আপনার কি মনে হয়?’
‘এখানকার সবাই বিষয়টা জানে। আমরা বহুদিন ধরে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি। ঢাকা মেডিকেলকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সব বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছে। যারা এসব বলছে, করোনার ডিউটি দিলে দেখবেন যে, তারা ধারে কাছেও আসতে চাইবে না। যারা এসব মন্তব্য করবে তারা হলো ওই গ্রুপ, তাদের কথায় কান দেবেন না’, বলেন তিনি।
পিপিই ও এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এন-৯৫ মাস্ক পৃথিবীর কিছু চিকিৎসক ব্যবহার করছেন। আপনারা টিভিতে দেখে থাকবেন যে, বিশ্বের অনেক দেশেই যারা আইসিইউতে কাজ করছে, সেসব ডাক্তার সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক পরে আছেন। এন-৯৫ মাস্ক তো আমেরিকাও দিতে পারছে না। তাহলে আপনি কি করে আশা করেন, বাংলাদেশ এন-৯৫ মাস্ক দিতে পারবে। এটি তো বাংলাদেশে তৈরি হয় না। যে দেশগুলো বানায়, তারা তো রপ্তানি করছে না। তাহলে আমরা কোথায় পাবো? তাছাড়া আমাদের পিপিই’র কোনো স্বল্পতা নেই। সবাই পিপিই নিয়েছে, অনেকবার নিয়েছে। প্রতিদিন প্রায় এক হাজার পিপিই চাইছে আমাদের কাছে। বাংলাদেশে আর কোথাও এতো পিপিই দিচ্ছে না। আমাদের এখানে প্রতিটি বিভাগে রিজার্ভ পিপিই দেওয়া আছে।’
ডেঙ্গু রোগীদের চাপ সামলানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গত বছর আমাদের এখানে ডেঙ্গু বেশ কঠিনভাবে এসেছিল। এবারও সময় চলে আসছে। সেক্ষেত্রে আমাদের জায়গা, মেডিসিন ও অভিজ্ঞতা তো আছেই। তো সেটাও আমরা ভালোভাবেই সামাল দিব।’
Comments