‘একাত্তরে আমরা প্রতিপক্ষকে দেখতে পেতাম’
১৯৭১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ‘জয় বাংলা’ ব্যাট হাতে নামার সময় যুদ্ধের দামামা বাজছিল রকিবুল হাসানের মনে। আভাস পাচ্ছিলেন সংগ্রাম আসন্ন, টের পাচ্ছিলেন ক'’িনের জন্য হয়ত এসব ব্যাট-বল তুলে রাখতে হবে। ডাক আসছে আরও বড় কিছুর। একাত্তরের নয় মাস কেটেছে যুদ্ধ আর অস্থিরতায়। স্বাভাবিকভাবে ক্রীড়াঙ্গনও ছিল স্থবির। প্রায় অর্ধশতাব্দি পর ২০২০ সালের এই সময়টাতেও আরেকটি যুদ্ধে সামিল মানুষ। তবে এই যুদ্ধে বাংলাদেশ তো বটেই, কাবু এখন গোটা দুনিয়া। খেলাধুলার জগতে অবিশ্বাস্য এক স্থবিরতা। ভিন্ন প্রেক্ষাপটের আলাদা দুই সময়কে কাছ থেকে দেখা রকিবুল বের করলেন মিল, অমিল। শোনালেন লড়াইয়ের আশাবাদ।
প্রশ্নটা ছিল বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকেই ঘিরেই। কোথাও কোন খেলা নেই, অনুশীলন নেই। অন্য সকলের মতো খেলোয়াড়রাও সবাই গৃহবন্দী। একাত্তরে যুদ্ধ, গুলাগুলি, হত্যা, রক্তের হোলিখেলা। তখন কেউ হয়ত যুদ্ধে গিয়েছেন, কেউ জীবন বাঁচানোর সংগ্রামে কুঁকড়ে গেছেন। খেলার কোন বাস্তবতা ছিল না। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বানিয়ে ভারতে খেলেছেন ফুটবলাররা। তবে সেই খেলাও ছিল সংগ্রামেরই অংশ। এখনো খেলোয়াড়রা খেলা বাদ দিয়ে তহবিল সংগ্রহ করছেন, বিপর্যস্ত সময় দিচ্ছে বিপন্নের পাশে দাঁড়ানোর ডাক।
মিল আছে কি কোথাও? বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মিল খুঁজে পেলেন এভাবে, ‘আমি দুটোর মধ্যে যে মিলটা দেখতে পাই সেটা হচ্ছে, ‘আ ওয়ার সামথিং এগেন্সট আওয়ার ইন্টারেস্ট’ যেটা আমার স্বার্থ বিরোধী।’
কিন্তু মিলের কথা বলতে গিয়েই বড় হয়ে দেখা দিল আসলে তফাৎ, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্বাধিকার, যেটা গণযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমরা যুদ্ধ করেছি। কিন্তু সেই লড়াইয়ে যে প্রতিপক্ষ ছিল তাদের দেখা যায়, আমরা সে শক্তুকে দেখতে পেতাম। এখন যে যুদ্ধটা এটা দুটো দেশের মধ্যে নাই যেটা একাত্তরে ছিল। এই করোনাভাইরাস, কোভিড-১৯ এটা সারা পৃথিবীকে কাবু করে দিয়েছে। এই শত্রুটা কেবল বাংলাদেশের শত্রু না। একে দেখাও যায় না। এখানে আবার বড় তফাত।’
একাত্তরে দীর্ঘ নয়মাস তো যুদ্ধই চলেছে। মাঠে খেলা স্বাভাবিক হতে লেগেছে আরও অনেকদিন। ২০২০ সালেও অন্যরকম এক যুদ্ধে মার্চ মাস থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে সব খেলা। কাগজে কলমে সেটা অনির্দিষ্টকালের স্থগিতাদেশ। সেই অনির্দিষ্টকালটা কতদিনের সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। রকিবুলের মতে এই অনিশ্চয়তা তো আছেই, কিন্তু এই সংকট কেটে গেলে হুট করেই সব স্বাভাবিক হবে না, ‘এই করোনাভাইরাসের যুদ্ধ কবে শেষ হবে আমরা কেউ জানি না। আদৌ শেষ হবে কিনা জানি না। বড় বড় জার্নালে লেখা দেখছি এটা নাকি ঘুরে ফিরে আবার আসতে পারে। ছয় মাস পর হয়ত আমরা ভ্যাক্সিন পেয়ে যাব। লড়াইয়ের অস্ত্র পাব। কিন্তু তখন যেটা মোকাবেলা করতে হবে তা হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দা। সামনে হয়ত আরেকটা লড়াইয়ে নামতে হবে।’
যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের খেলাধুলার স্থবিরতা নিজ চোখে দেখেছেন রকিবুল। কিন্তু গোটা বিশ্বজুড়ে কোথাও কোন খেলা নেই এমন কোন সময় তার ধারনারও বাইরে, ‘আমার দেখা মতে তো নাই। যখন একা ঘরে বসে ভাবি, চিন্তাই করতে পারি না । এর কাছাকাছি বোধহয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হয়েছে। এটা হলো মহাপ্রলয়। সারা পৃথিবীকে কাবু করে দিয়েছে। এরকম দেখিনি। আমি দেখতেও চাই না। আমি শত্রুকে মোকাবেলা করতে পারব। কিন্তু যে শত্রু দেখতে পাচ্ছি না তাকে কি করে সামলাব। হয়ত অস্ত্র বের হয়ে আসবে কিন্তু এরমধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। মানবতার জয় হবে। হয়ত অনেক মূল্য দিয়ে।’
খেলা মানুষকে লড়াইয়ের মন্ত্র শেখায়। খেলাধুলা অনেক সময় বিনোদন ছাপিয়েও তাই ভিন্ন কিছু। ফলোঅনে পড়ে যাওয়া কোন দল কোণঠাসা পরিস্থিতি থেকেও ঘুরে দাঁড়িয়ে যায়, এমন নজির তো আছেই। রকিবুল আশায় আছেন খেলার মর্মবাণী মেনে বাজে অবস্থা থেকেও ঠিকই ঘুরে দাঁড়াবে বিশ্ব, ‘যদি আমরা বাঁচতে চাই হতাশ হলে চলবে না। একাত্তরে লড়াই করেছি, আবার আমি লড়াই করব। আমি ক্রীড়াবিদদের নিয়েই বলব- উই আর ফাইট ইট আপ, স্পোর্টস পিপল আর ফাইটার। দে প্লে দ্যা গেইম ফর উইন, উইথিদ দ্যা রুলস। উই ফাইট, গেট আউট এন্ড কিক আউট দ্যাটস এনিমি।’
Comments