অ্যাকাডেমিক বই পড়তে নয়, চাকরির প্রস্তুতি নিতে গ্রন্থাগারে ভিড়

কাকডাকা ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ লাইন। সবার হাতে বই-খাতা কিংবা ব্যাগ। গ্রন্থাগারের দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকে জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে দীর্ঘ লাইন। মূলত বিসিএসসহ সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেই কাকডাকা ভোর থেকেই গ্রন্থাগারের সামনে ভিড় শুরু হয়। ছবি: আনিসুর রহমান

কাকডাকা ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ লাইন। সবার হাতে বই-খাতা কিংবা ব্যাগ। গ্রন্থাগারের দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকে জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা।

কিন্তু টেবিলে বসে বেশির ভাগই খুলে বসছেন বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার গাইড বই। গ্রন্থাগার থেকে বই তুলছেন হাতে গোনা কয়েকজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী গত দশ বছরে গ্রন্থাগার ৬১ শতাংশ পাঠক হারিয়েছে।

এই তথ্যের সূত্র ধরে সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারসহ ঢাকার নয়টি গ্রন্থাগারে জরিপ করেছেন এই প্রতিবেদক। তাতে দেখা গেছে, ৯৭ শতাংশ ব্যবহারকারীই গ্রন্থাগারে আসছেন চাকরি সংক্রান্ত পড়াশোনা করতে। সঙ্গে করে নোট-গাইড নিয়ে এসে তারা গ্রন্থাগারকে ব্যবহার করছেন পাঠকক্ষ হিসেবে।

এর বিপরীতে গ্রন্থাগারের লাখো বইয়ে বাড়ছে ধুলার আস্তরণ। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্টও হচ্ছে।

ঢাকায় এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো গবেষণার কথা জানা না গেলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার নিয়ে একটি গবেষণার তথ্য পাওয়া গেছে। তাতে দেখা যায়, মাত্র ৯ দশমিক ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে বই তুলে পড়েন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ই-বই পড়ার প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক পূর্ণিমা বণিকসহ কয়েকজন গবেষক। জরিপে অংশ নেওয়াদের সবাই বলেছেন তারা অনলাইনে বই পড়েন।

ঢাকার নয়টি গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেও প্রায় একই রকম তথ্য পাওয়া যায়। এখানেও অনলাইনে জার্নাল ও বই পড়ার ঝোঁক বেড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনও বলছে, গ্রন্থাগারের ওয়েবসাইট ব্যবহার করে প্রতি বছর গড়ে সাড়ে চার লাখ ই-জার্নাল ডাউনলোড করা হয়।

গত বছরের জুলাই মাসে প্রকাশিত এই বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে যেখানে প্রতিদিন গড়ে আড়াই হাজারের বেশি বই ইস্যু হতো, সেখানে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে বই ইস্যু হয়েছে দিনে গড়ে মাত্র ৯৬৫টি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ও বিজ্ঞান গ্রন্থাগার থেকে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গবেষকরা মোট ৯ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫টি বই পড়ার জন্য তুলে ছিলেন। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে এই সংখ্যা নেমে এসেছে ৩ লাখ ৫২ হাজার ৩১০টিতে।

জানুয়ারির শেষ ১০ দিনে ঢাকার নয়টি গ্রন্থাগার ঘুরে দেখা যায় এক হাজার ৩৯৫ জন পাঠকের মধ্যে এক হাজার ৩৫৫ জনের কাছেই সরকারি চাকরি সংক্রান্ত বই। যা উপস্থিত পাঠকের ৯৭ শতাংশ। মাত্র ২১ জন পাঠক গ্রন্থাগার থেকে তুলে বই পড়ছিলেন। ১৯ জন পড়ছিলেন সংবাদপত্র, সাময়িকী অথবা ইন্টারনেট ব্যবহার করছিলেন।

রাজধানীর সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান গ্রন্থাগার, বেনবেইসের দুটি গ্রন্থাগার, গ্রন্থবিতান, জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠ, আরমানিটোলা গণগ্রন্থাগার, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এই জরিপ চালানো হয়।

শিক্ষার্থীরা বলেছেন, সরকারি চাকরির জন্য ব্যাপক প্রতিযোগিতা, গ্রন্থাগারের বই পুরনো হয়ে যাওয়া, মুঠোফোন ও অনলাইনে বইয়ের ই-ভার্সন সহজলভ্য হওয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি ব্যস্ত থাকা, নাগরিক জীবনে অবসর সময় কমে যাওয়া গ্রন্থাগার থেকে বই না তোলার বড় কারণ। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল এবং বাইরের মেসে পড়াশোনার পরিবেশ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ও চাকরির পড়াশুনার জন্য সবাই গ্রন্থাগারকে বেছে নিয়েছে।

গত ২১ জানুয়ারি সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান গ্রন্থাগারের তিনটি পাঠকক্ষে থাকা প্রায় ৪০০ জনের মধ্যে দুটি টেবিলে মাত্র পাঁচ জনকে চাকরির পড়াশোনার বাইরে অন্য বই পড়তে দেখা গেছে। এদের একজন জিআরই (গ্র্যাজুয়েট রেকর্ড এক্সামিনেশন) পড়ছিলেন, আর চারজন নিজ বিভাগের পড়াশোনা করছিলেন। তবে তাদের বই এই লাইব্রেরি থেকে ইস্যু করা নয়।

গ্রন্থাগারে ঢুকতে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তাই লাইনে দাঁড়িয়ে না থেকে ব্যাগ, বই বা পত্রিকা দিয়ে নিজেদের জায়গা দখলে রাখেন। ছবি: আনিসুর রহমান

গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী পার্থ সূত্রধর বললেন, ‘হলের রুমে একটানা পড়া সম্ভব হয় না। তাই সকালে লাইব্রেরিতে এসে রাত পর্যন্ত এখানেই থাকি। আর বিভাগও কাছাকাছি হওয়ায় এখান থেকে গিয়েই ক্লাস করি।’

তৃতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থী এখন পর্যন্ত লাইব্রেরি থেকে ছয়-সাতবার বই নিয়েছেন বলে জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ব্যবহারের নীতিমালার ২৭(১) ধারা অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা বাইরে থেকে কোনো বই নিয়ে ঢুকতে পারেন না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০০৯ সালে এই নিয়ম শিথিল করা হয়েছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক নাসিরউদ্দিন মুন্সী। তিনি বলেন, লাইব্রেরি ভবন আরও বড় করে পুনর্নির্মাণ করার পরিকল্পনা আছে। তখন হয়তো বিসিএস প্রস্তুতি নিতে আসা পাঠকদের জন্য একটি তলা ছেড়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু জায়গা না বাড়ানো পর্যন্ত এসব শিক্ষার্থীদের কিছু বলা যাচ্ছে না।

বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের এলিয়াস শাওন গত সেপ্টেম্বর থেকে সরকারি চাকরির জন্য গ্রন্থাগারে পড়ছেন। তিনি বলেন, তার পাঁচ বছরের শিক্ষাজীবনের প্রথম বর্ষেই শুধু দু-একবার লাইব্রেরি থেকে বই নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, লাইব্রেরির বই অনেক পুরনো। নতুন কোনো সংস্করণ এখানে পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ বই নিজেদেরই কিনতে হয়েছে অথবা বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরি থেকে নিতে হয়েছে।

এই গ্রন্থাগারে শিক্ষকদের পাঠকক্ষটি ছিল একদমই ফাঁকা। দায়িত্বরত একজন জানালেন, শিক্ষকরা আসলেও বই নিয়ে চলে যান। এখানে বসে খুব একটা পড়েন না।

দুপুর ১২টার দিকে সুফিয়া কামাল গণগ্রন্থাগারে গিয়ে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। প্রায় সাড়ে ৬৫০ জনের বসার ব্যবস্থা থাকা ওই লাইব্রেরিতে শিশু-কিশোরদের কক্ষের ১০০ চেয়ার ফাঁকাই ছিল। বাকি সবগুলো টেবিলেই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া পাঠক। দুজন শিক্ষার্থী টেবিলে জায়গা না পেয়ে মেঝেতে পুরনো পত্রিকা বিছিয়ে বসে পড়ছিলেন।

মধ্যবয়সী দুজনকে পাওয়া গেল যারা এই গ্রন্থাগারের বই পড়ছিলেন। তাদের একজন মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের এই উপস্থিতি দেখে তার ভালোই লাগে। যে বই-ই পড়ুক, তারা তো আর নেশা করছে না, বাজে আড্ডা দিচ্ছে না।

১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার বেসরকারি গ্রন্থাগার গ্রন্থবিতান। পুরান ঢাকার লালবাগে জরাজীর্ণ এক ভবনে ৩০-৩৫ জনের বসার জায়গা থাকা এ গ্রন্থাগারে পাঠকদের জায়গা দেওয়াই মুশকিল হচ্ছে বলে জানালেন অফিস সহকারী আশরাফ হোসেন। গত ২২ জানুয়ারি বিকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ৩৫ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। দুইজন ছাড়া বাকি সবার হাতেই ছিল চাকরির পরীক্ষার গাইড বই।

রাজধানীর পলাশীতে অবস্থিত ব্যানবেইস কার্যালয়ে দুটি গ্রন্থাগার আছে। দুপুর ২টার দিকে দুটি লাইব্রেরিতে গিয়ে মোট ৯৬ জনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। প্রত্যেকেই চাকরি সংক্রান্ত বই পড়ছিলেন।

ধানমন্ডিতে ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠ। পাঁচ বছরে এই গ্রন্থাগারের সদস্য সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে, যা বেগম সুফিয়া কামাল গণগ্রন্থাগারের সমান। বুধবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে গিয়ে ছয় জন পাঠককে সেখানে পাওয়া যায়। তাদের দুজন নিজস্ব ল্যাপটপে কাজ করছিলেন, দুজন বিদ্যাপীঠের কম্পিউটার ব্যবহার করছিলেন, একজন বিদ্যাপীঠের বই পড়ছিলেন, আর একজনের হাতে ছিল চাকরির বই।

চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া ঢাকা কলেজের ইংরেজির শিক্ষার্থী প্রত্যয় বিশ্বাস বললেন, এখানে বই আনা যায় না। কিন্তু নোট শিট আনা যায়। তাই নতুন বই কিনে তা ছোট ছোট ভাগ করে নিয়েছেন তিনি।

একমাত্র বাংলামোটরে অবস্থিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ছিল ব্যতিক্রম। সেখানে দশজন শিক্ষার্থীর সবাইকে কেন্দ্রের বই পড়তে দেখা গেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এ থেকে বোঝা যায় সত্যিকারের জ্ঞান অর্জনের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমছে। জীবন হয়ে যাচ্ছে চাকরি আর জীবিকাকেন্দ্রিক। এটা আলাদা কোনো প্রপঞ্চ নয় বরং মানুষ যে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে, মুঠোফোনের মধ্যে ডুবে থাকছে, সামাজিক হিসেবে বেড়ে উঠছে না, তার প্রমাণ।

Comments

The Daily Star  | English

Yunus sits with BNP delegation over reform commissions

BNP Secretary General Mirza Fakhrul Islam Alamgir is leading the six-member delegation at the State Guest House Jamuna.

1h ago