‘ফরীদিকে ভীষণ মিস করি’
এদেশে তার মতো মেধাবী অভিনেতা কমই এসেছেন। তার জীবদ্দশায় এই কথাটি নানা সময় তার সহকর্মীরাই স্বীকার করেছেন। সব মাধ্যমে সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার দৃষ্টান্ত কম শিল্পীই রেখে যেতে পারেন। হুমায়ুন ফরীদি পেরেছিলেন।
কী মঞ্চ, কী টিভি নাটক, কী সিনেমা— সব মাধ্যমে সফল ছিলেন তিনি। আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি, তার প্রয়াণ দিবস। ২০১২ সালের এই দিনে, এক বসন্তের সকালে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন হুমায়ুন ফরীদি।
টিভি নাটকে তার অভিনয়ের সত্যিকারের রূপ এদেশের দর্শকরা দেখতে পেয়েছিলেন ধারাবাহিক নাটক সংশপ্তকে। বিটিভিতে প্রচারিত নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন প্রখ্যাত টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আল মামুন। সংশপ্তক নাটকে হুমায়ুন ফরীদি ‘কানকাটা রমজান’ চরিত্রে অভিনয় করে তুমুল সাড়া জাগিয়েছিলেন। সব শ্রেণির দর্শকরা অভিনয়ে তার দক্ষতা দেখেছিলেন সেই চরিত্রের মধ্য দিয়ে। তারপর জনপ্রিয় তকমাটি পেয়ে যান তিনি।
সংশপ্তক টিভি নাটকটি ছাড়া আরও বহু টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে— কোথাও কেউ নেই, নিখোঁজ সংবাদ, ভাঙনের শব্দ শুনি, পাথর সময়, সেতু কাহিনী, সাত আসমানের সিঁড়ি, বকুলপুর কত দূর, দূরবীন দিয়ে দেখুন।
শেখ নিয়ামত আলী পরিচালিত দহন সিনেমায় তিনি নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছিলেন। তবে খ্যাতি কুড়িয়েছেন খলনায়ক হিসেবে। নায়ক থেকে খলনায়ক হওয়ার ইতিহাস আমাদের দেশে কম শিল্পীরই আছে।
বাংলাদেশ বেতারেও অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। অভিনয়ের যতগুলো শাখা রয়েছে সবগুলিতে তার সরব পদচারণা ছিল। সবখানেই তিনি ছিলেন সফল।
থিয়েটার থেকে অভিনয় জীবন শুরু করেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। তখন তিনি মাদারীপুরের একটি স্কুলে পড়তেন। বাবার চাকরির কল্যাণেই সেখানে পড়ালেখা করা। শিল্পী নাট্যগোষ্ঠী নামে একটি নাট্যদলে সম্পৃক্ত হন। এরপর বেশ কয়েকটি মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে যোগ দেন ঢাকা থিয়েটারে। যেখানে দেশবরেণ্য অনেক শিল্পী মঞ্চে অভিনয় করেছেন। তিনি ছিলেন তাদেরই অন্যতম একজন। ঢাকা থিয়েটারের হয়ে অনেক প্রশংসিত মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন তিনি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— কীত্তনখোলা, মুনতাসির ফ্যান্টাসি, কেরামত মঙ্গল, ধূর্ত ওই, ত্রিরত্ন। ত্রিরত্ন ছিল ঢাকা থিয়েটারের হয়ে তার প্রথম অভিনীত নাটক। ভূত নামে একটি মঞ্চ নাটকে নির্দেশনাও দিয়েছিলেন হুমায়ুন ফরীদি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন গুণী এই শিল্পী। সেখানে পড়ার সময় কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার। সংগঠনটি এখনো আছে।
নব্বইয়ের দশকে এদেশে সিনেমা ব্যবসা যখন রমরমা সেই সময় বাণিজ্যিক সিনেমায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার নতুন পথচলা। বিরতিহীনভাবে একটার পর একটা বাণিজ্যিক সিনেমায় অভিনয় করে গেছেন। পেয়েছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।
হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু সিনেমা হলো দহন, একাত্তরের যীশু, মায়ের অধিকার, কমান্ডার, মিথ্যার মৃত্যু, আনন্দ অশ্রু, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, বিশ্ব প্রেমিক, জয়যাত্রা, ব্যাচেলর, শ্যামল ছায়া, লড়াকু।
একটা সময়ের পরে তিনি সিনেমায় অভিনয় একেবারেই কমিয়ে দিয়েছিলেন। টিভি নাটক ও নাটক পরিচালনা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। ২০১২ সালের আজকের দিনে ঢাকায় তার ধানমন্ডির বাসায় মারা যান হুমায়ুন ফরীদি। তার বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর।
অভিনয় জীবনের শুরুতে হুমায়ুন ফরীদি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তবে স্বপ্ন দেখেছিলেন শুধুমাত্র অভিনয়ই করবেন। তার সেই স্বপ্ন পূরণও হয়েছিল।
জীবদ্দশায় তিনি পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। আর মারা যাওয়ার পরে তাকে দেওয়া হয় মরণোত্তর একুশে পদক।
হুমায়ুন ফরীদিকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অভিনেতা আফজাল হোসেন বলেন, ফরীদি নেই এ কথা ভাবতেই কেমন যেন লাগে! একটা শূন্যতা অনুভূত হয়। আমরা একসঙ্গে কত সময় কাটিয়েছি! কত স্মৃতি আমাদের! কত সুখের স্মৃতি, কত আনন্দের স্মৃতি। সত্যি আমি ফরীদিকে ভীষণ মিস করি।
অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন, দেখতে দেখতে অনেক বছর হয়ে গেল ফরীদি নেই। আমরা একসঙ্গে বছরের পর বছর কাজ করেছি। থিয়েটার ছিল আমাদের ধ্যান-জ্ঞান। ঢাকা থিয়েটারের হয়ে আমরা দীর্ঘ একটা সময় কাটিয়েছি। আসলে ফরীদি ছিল একজন জাত শিল্পী। জাত শিল্পী কমই আছে আমাদের দেশে।
ছবি: তুহিন হোসেন
Comments