ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বসেরা
৫৪ বলে দরকার ছিল ১৫ রান, হাতে ৩ উইকেট। নামল বৃষ্টি। খেলা বন্ধ থাকল ২০ মিনিট। বাড়ল অপেক্ষা। বৃষ্টি থামলে নতুন নির্ধারিত লক্ষ্য দাঁড়াল ৩০ বলে ৭ রান। পেসার সুশান্ত মিশ্রর বলে অধিনায়ক আকবর আলি সিঙ্গেল নিয়ে দিলেন রকিবুল হাসানকে। টেলএন্ডার রকিবুল দুই বল খেলে মেরে দিলেন চার। উল্লাসের মঞ্চ তখন প্রস্তুত। দরকার দাঁড়ায় কেবল ২। ওভারের শেষ বলে রকিবুল নিলেন সিঙ্গেল। পরের ওভারে স্ট্রাইক পেয়ে মিড-উইকেটে ঠেলেই ভোঁ দৌড় রকিবুলের। চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ।
রবিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে রচিত হয়েছে ইতিহাস। ভারত যুব দলকে ডি/এল মেথডে ৩ উইকেটে হারিয়ে যুব বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। যেকোনো পর্যায়ের ক্রীড়া আসরের বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের কোনো দলের এটাই সেরা সাফল্য।
টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশের পেসারদের তোপে নির্ধারিত ৪৭.২ ওভারে ১৭৭ রানে গুটিয়ে যায় ভারত। জবাবে ৪২.১ ওভারে ৭ উইকেটে ১৭৮ রান তুলে শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশের যুবারা।
অথচ অনেকবার এই ভারতের বিপক্ষে তীরে গিয়ে তরী ডুবিয়েছে সিনিয়র দল। যুব দলও গত বছরে ভারতের কাছে দুবার ফাইনালে পুড়েছে হতাশায়। বাংলাদেশ-ভারত লড়াই হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের হৃদয় ভাঙার গল্প। এবার যুব বিশ্বকাপ ফাইনালে আর কোনো হৃদয় ভাঙার গল্প নয়। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানো ম্যাচ ট্রফি উঁচিয়ে ধরছেন আকবর। যার ৭৭ বলে অবিস্মরণীয় ৪৩ রানের অপরাজিত ইনিংস বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে নিশ্চিতভাবেই আলাদা জায়গা করে নেবে।
কারণ এক পর্যায়ে উইকেট হারাতে থাকা দল পড়ে গিয়েছিল চরম শঙ্কায়। দেখা দিচ্ছিল পা হড়কানোর ভয়। মাথা ঠান্ডা রেখে পুরো পরিস্থিতি পার করেন ১৯ বছরের আকবর। স্নায়ুচাপ জয় করে দেশকে এনে দেন বিশ্বকাপ।
১৭৮ রানের সহজ লক্ষ্যে নেমে চমৎকার শুরু আনেন দুই ওপেনার পারভেজ হোসেন ইমন আর তানজিদ হাসান তামিম। দ্রুত রান আনার কোনো চাপ ছিল না। তবু বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই রান আনতে থাকেন তারা। নবম ওভারে ৫০ রানের জুটির পর ভুল করে বসেন তামিম। লেগ স্পিনার রবি বিষ্ণইকে মিড উইকেট দিয়ে উড়াতে গিয়ে সীমানা ছাড়া করতে পারেননি। ২৫ বলে ১৭ রান করে ফিরে যান।
রবির লেগ স্পিন এরপর মুহূর্তেই খেলার মোড়ই ঘুরিয়ে দেয়। তার গুগলি যেন বুঝতেই পারছিলেন না বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। সেমিফাইনালের সেঞ্চুরিয়ান মাহমুদুল হাসান জয় আর তৌহিদ হৃদকে গুগলিতে কাবু করেন তিনি।
৮ রান করা জয় হন বোল্ড। কোনো রান করার আগেই হৃদয় এলবিডব্লিউ। এর আগে আহত হয়ে মাঠ ছেড়ে যান ভালো খেলতে থাকা ওপেনার পারভেজও।
রবি হয়ে ওঠেন আতঙ্ক। শাহাদাত হোসেন দিপুকেও ফেরান তিনি। ৬৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। অধিনায়ক আকবরের সঙ্গে মিলে জুটি গড়ছিলেন শামীম হোসেন। রবিকে সাবধানেই খেলছিলেন। কিন্তু শামীম ফেরেন আত্মঘাতী শটে। দ্রুত রান নেওয়ার কোনো চাপ ছিল না। তবু বাঁহাতি পেসার সুশান্ত মিশ্রকে উড়াতে গিয়ে ক্যাচ দেন কাভারে।
চরম বিপর্যয়ে-ভীতি জাগানিয়া পরিস্থিতিতে শান্তভাবে খেলছিলেন কেবল আকবর। অলরাউন্ডার অভিষেক দাসকে একপাশে নিয়ে ১৭ রানের জুটি এসে গিয়েছিল। লো স্কোরিং ম্যাচে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদালনো অবস্থায় জাগছিল আশা। কিন্তু স্লিপে ক্যাচ দিয়ে জীবন পাওয়ার পরের বলেই ক্যাচ উঠিয়ে ৫ রান করে ফেরেন অভিষেক। তার আউটে ক্রিজে ফেরেন চোটে বেরিয়ে যাওয়া পারভেজ।
এরপরই ফের বদলে যায় ম্যাচের মোড়। দৃঢ়তার সঙ্গে খেলতে থাকা আকবরের সঙ্গে পারভেজ যোগ দিয়ে যোগান ভরসা, আসে রান, বাড়ে আশা।
অধিনায়ক আকবর রাখেন বড় ভূমিকা। পুরো পরস্থিতি পড়ে ঠান্ডা মেজাজে চালাতে থাকেন ব্যাট। পারভেজ পায়ে ক্র্যাম্প নিয়ে বের করতে থাকেন বাউন্ডারি। ক্রমেই জয়ের কাছে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। জুটি বাড়ছিল, জেতার জন্য প্রয়োজনীয় রানের চাহিদা ৪০ এর নিচে নেমে আসছিল। কিন্তু নাটকের বাকি ছিল আরও। আকবরের সঙ্গে ৪১ রানের জুটির পর ফিফটির দিকে থাকা পারভেজের বিদায়। অনিয়মিত লেগ স্পিনার যশস্বী জয়সওয়ালের বলে অযথা পেটাতে গিয়ে মিড অফে দেন ক্যাচ তিনি। ৭৯ বলে তার ব্যাট থেকে আসে ৪৭ রান।
ফের তৈরি হয় আশা-নিরাশার দোলাচল। আকবর তখনো অবিচল। রকিবুল হাসানকে নিয়ে প্রথমে ঠান্ডা করলেন পরিস্থিতি, বেশ কিছুটা সময় নিলেন না কোনো রান। আকাশে তখন ঘন কালো মেঘের ঘনঘটা। ডি/এল মেথডের হিসাবটাও মাথায় রাখতে হচ্ছিল তাকে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও নামল এক সময়। খেলা বন্ধ থাকল ২০ মিনিট। ডি/এল মেথডে বাংলাদেশের লক্ষ্য নেমে আসে ৩০ বলে ৭ রানে। ওই রান ২৩ বল হাতে রেখেই নিয়ে নেয় বাংলাদেশ।
এর আগে টস জিতে উইকেটে আর্দ্রতা দেখে ফিল্ডিং নিয়েছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক আকবর। শরীরী ভাষায় আগ্রাসন, বোলিংয়ে ঝাঁজ আর ফিল্ডিংয়ে ক্ষীপ্রতা দিয়ে শুরু থেকেই ভারতকে ঘাবড়ে দেন তারা।
শরিফুল ইসলাম, তানজিম হাসান সাকিবের শুরুটা হয় দুর্ধর্ষ। এই দুজনকে খেলতে হাঁসফাঁস করছিলেন ভারতের দুই ওপেনার জয়সওয়াল আর দিব্যানশ সাক্সেনা। প্রথম ১৩ বল থেকে তারা কোনো রানই নিতে পারেননি। নিজের প্রথম ১৭ বলেও কোনো রান দেননি সাকিব।
এই চাপেই কাবু ভারত অভিষেককে মারতে গিয়েই হারায় উইকেট। বাঁহাতি স্পিনার হাসান মুরাদকে বাদ দিয়ে তৃতীয় পেসার হিসেবে অভিষেককে খেলিয়েছিল বাংলাদেশ। কতটা কার্যকর এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ হয় অভিষেকের বোলিংয়ে। সাক্সেনাকে পয়েন্টে ক্যাচ বানিয়ে প্রথম উইকেটই নেন তিনি। স্লগ ওভারেও অভিষেক ছিলেন দারুণ। নিয়েছেন আরও ২ উইকেট।
এর আগে অবশ্য খেলাটা বাংলাদেশে মুঠোয় এনে দেন বাঁহাতি শরিফুল। শুরু থেকেই ভেতরে আগুন নিয়ে নেমেছিলেন তিনি। দারুণ বল করলেও উইকেট পাচ্ছিলেন না। এদিকে বিপর্যয় পেরিয়ে ভারতকে টানছিলেন জয়সওয়াল, পাইয়ে দিচ্ছিলেন জুতসই পুঁজির সুবাস। পরের স্পেলে ফিরে শরিফুল দলের হয়ে নেন সবচেয়ে দামি উইকেট।
তার গতি বৈচিত্র্য বুঝতে না পেরে পুল করে সহজ ক্যাচ উঠান ৮৮ রান করা ভারতের সেরা ব্যাটসম্যান জয়সওয়াল। পরের বলেই শরিফুল ফিরিয়ে দেন সিদ্ধেশ বীরকে।
টানা উইকেট হারিয়ে ভেঙে পড়ে ভারতের মিডল অর্ডারও। বাকিটা সাকিব আর অভিষেক মিলে মুড়ে দেন। একমাত্র বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে খেলা রকিবুল হাসান এদিনও ছিলেন মিতব্যয়ী। আউট করেছেন ভারতীয় অধিনায়ক প্রিয়ম গার্গকে।
পুরো ইনিংসে বাংলাদেশ অধিনায়ক আকবরের নেতৃত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। নিজের তূণে থাকা বোলারদের কাজে লাগিয়েছেন দারুণভাবে। বোলাররাও দলের হয়ে দিয়েছেন সর্বোচ্চ। ফলও মিলেছে সেরাটাই।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দল: ৪৭.২ ওভারে ১৭৭ (জয়সওয়াল ৮৮, সাক্সেনা ২, ভার্মা ৩৮, গার্গ ৭, জুরেল ২২, বীর ০, আনকোলেকার ৩, বিষ্ণই ২, মিশ্র ৩, তিয়াগি ০, সিং ১*; শরিফুল ২/৩১, সাকিব ২/২৮, অভিষেক ৩/৪০, শামিম ০/৩৬, রকিবুল ১/২৯, হৃদয় ০/১২)।
বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল: ৪২.১ ওভারে ১৭০/৭ (ডি/এল মেথডে লক্ষ্য ৪৬ ওভারে ১৭০) (পারভেজ ৪৭, তামিম ১৭, মাহমুদুল ৮, হৃদয় ০, শাহাদাত ১, আকবর ৪৩*, শামিম ৭, অভিষেক ৫, রকিবুল ৯*; কার্তিক ০/৩৩, মিশ্র ২/১৯, সিং ০/৩৩, বিষ্ণই ৪/৩০, আনকোলেকার ০/২১, জয়সওয়াল ১/১৫ )।
ফল: ডি/এল মেথডে বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ী।
Comments