মেশিনের পাশে কী ভূত ছিলো
প্রথমবারের মতো ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সবগুলো কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হয়েছে যন্ত্রের (ইভিএম) মাধ্যমে। অতীতের যেকোনও নির্বাচনের তুলনায় এই নির্বাচনে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে স্বাধীন থাকবেন, প্রত্যাশা এমনই ছিলো।
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। এদিন প্রায় ৫৫ লক্ষ ভোটার দুটি সিটি করপোরেশনে তাদের মেয়র পছন্দ করে নেওয়ার কথা ছিলো। গণতন্ত্রকামী এই জাতির ইতিহাসে দিনটি একটি বিশেষ দিন হতে পারতো। এই প্রযুক্তিগত উন্নতি নির্বাচনী ভূতদের বিশ্রাম দিতে পারতো। জাল ভোট, ভুয়া ভোটার কিংবা ভুল গণনার দীর্ঘদিনের সংস্কৃতির অবসান হতে পারতো। নির্বাচন কমিশন নজির হয়ে থাকতে পারতো বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় বিপুল পরিবর্তন আনতে পেরে।
দিনটি আসলে কীভাবে গেলো?
ভোট নেওয়ার মেশিনগুলো দুর্বলতার জন্য সমালোচিত এবং ডিজিটাল ভূত সম্বলিত ছিলো। আর দিনের শেষে নির্বাচনে সবচেয়ে শোচনীয় পরাজয় ঘটলো নির্বাচন কমিশনের।
শীতের সুন্দর সকালটি সুন্দর নির্বাচনের জন্য তৈরি ছিলো। প্রকৃতিও ভোটারদের ঘর থেকে বের হওয়ার উপযোগী হয়ে উঠেছিলো। আর প্রকৃতির উৎসাহের সঙ্গে যোগ হয়েছিলো সরকারি ছুটির ঘোষণা। সব মিলিয়ে নির্বাচনে ভোট দিতে যেতে সবার আগ্রহী হওয়ার জন্য দিনটি ছিলো অত্যন্ত উপযোগী।
ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ ছিলো শান্ত। তবুও আমাদের ৪৮ জন সংবাদদাতার দেখা ২৪৬৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২০টির পরিবেশ ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। এগুলো জুড়ে ছিলো নিস্তব্ধতা। খালি রাস্তা, খালি ভোটকেন্দ্র, খালি ভোট বুথ এবং পোলিং অফিসারদের শূন্য দৃষ্টি। যেনো ‘খালি’ শব্দটি সিটি নির্বাচনের স্বীকৃতি দেয়।
৩০ শতাংশেরও কম ভোটে প্রতিফলিত হয় নির্বাচন কমিশন ভোটারদের কাছে কতোটা আস্থা অর্জন করতে পেরেছে।
ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশিরা নিজেদের ভোটাধিকার সম্পর্কে উত্সাহী ছিলেন। সেই উত্সাহ কোথায় হারালো কিংবা কীভাবে আজকের ভোটাররা তাদের একসময়ের লালিত অধিকারের প্রতি উদাসীন হয়ে উঠলেন, তা আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য একটি গবেষণার বিষয় হতে পারে। তবে অধিকারের প্রতি এই উদাসীনতা রাতারাতি হয়নি। এই উদাসীনতা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভূতেরা।
সিটি নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে কার জয় বা কার পরাজয় হয়েছে, তার থেকে বড় হিসেব হচ্ছে এককভাবে সবচেয়ে বড় পরাজয় হয়েছে নির্বাচন কমিশনের। ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের না যাওয়া নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ‘না ভোট’। নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আত্মবিশ্বাস অনেক দিন আগে থেকেই নষ্ট হতে শুরু হয়েছিলো। নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যতো সখ্যতা তৈরি করেছে, ততোই ভোটারদের নির্বাচনকে ঘিরে আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলকে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করার অনুমতি দেওয়ার মতো সুস্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব ছাড়াও নির্বাচন কমিশন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলো এবং বিশেষজ্ঞদের ইভিএমের অপব্যবহারের বিষয়ে উদ্বেগ নিয়েও উদাসীন ছিলেন। তাদের উদ্বেগ ছিলো ‘মেশিনটি যদি মানুষ তৈরি করতে পারে, তাহলে মানুষ এটাকে ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণও করতে পারবে।’
নির্বাচন কমিশন তাদের এই উদ্বেগ তো দূর করেইনি, ভোট চলাকালীন এসব মেশিন যারা পরিচালনা করবেন তাদের সম্পর্কেও আস্থা তৈরি করতে পারেনি।
গতকাল (১ ফেব্রুয়ারি) ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে প্রায় সব ভোটারই ইভিএমের আশেপাশে অনেক বেশি ‘সহায়তাকারী’ থাকার কথা আমাদের সংবাদদাতাদের কাছে জানিয়েছিলেন।
তারা কারা ছিলেন? আসলে যন্ত্রটি যারা চালিয়েছে, তারা কি ভোটারদের ‘সহায়তাকারী’ ছিলো, নাকি ছিলো ভূত? একটি স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে উত্তর বের করা যেতে পারে। তবে নির্বাচন কমিশনের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি হলো তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা এবং নির্বাচনের প্রতি ভোটারের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
Comments