চিত্রকর হাসি চক্রবর্তী স্মরণে

চিত্রপটে প্রতীক ও প্রকৃতি

six_seasons
সিক্স সিজনস, ১৯৯০

হাসি চক্রবর্তী, ডাক নাম বাচ্চু। একমাত্র তাঁর মাকেই এই নামে ডাকতে শুনেছি, যখন তিনি এদেশে আসতেন ছেলের কাছে। ১৯৪৮ সালে মামাবাড়ি গৌরনদীতে জন্ম তাঁর। বেড়ে উঠেছেন বরিশালে নিজেদের বাড়িতে। বিএম কলেজের সামনাসামনি বেশ খানিকটা খোলামেলা জায়গা জুড়ে একটি দোতলা কাঠের বাড়ি, পুকুর, গাছপালা, ঝোপঝাড়, কোথাও একটি পদ্মপুকুরের সঙ্গে ভীষণ ভয় ধরানো ভোর, অশ্বিনীকুমার টাউন হল, শংকরমঠ, জীবনানন্দের বাড়ি, কোথায় একটি কালীবাড়ি, বি এম কলেজের পুরো চৌহদ্দি-এসব ঘিরেই কেটেছে তাঁর শৈশব, কৈশোর আর প্রাক যৌবনের দুরন্ত সময়গুলো। বাংলাদেশের এই চিরায়ত প্রকৃতির সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে বহমান একটি চিরন্তন দারিদ্র, পিতা সুশীল চক্রবর্তী ও জ্যাঠা ফণী চক্রবর্তীর বামপন্থী রাজনৈতিক দর্শন ও বার বার কারাভোগ, মায়ের জীবনসংগ্রাম- সবকিছু ছাপিয়ে ফল্গুধারার মতো নিরন্তর বহমান একটি পারিবারিক আনন্দধারার মধ্যে গঠিত হয়েছে তাঁর ব্যক্তি ও শিল্পীমানস। স্কুল জীবনে ছবি আঁকার শুরু ও আকর্ষণ; অনুসন্ধিৎসু মনের দর্শন-পর্যবেক্ষনের অভিজ্ঞতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা কখনো কখনো সামাজিক নিষেধের সীমানাও ডিঙ্গিয়েছিল— সে গল্পও শুনেছি।

কম্পোজিশন উইথ আই, ১৯৭৫

১৯৬৭ সালে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। বাবা-জ্যাঠা তখনও রাজনৈতিক বন্দী। মায়ের অনুমতিতে আর্ট কলেজে ভর্তি। মফস্বল থেকে আসা একজন যুবকের জন্য রাজধানী ঢাকা অবশ্যই নতুন একটি অভিজ্ঞতা। তরুণ মনের রাজনৈতিক ভাবনায় আন্দোলিত হয়ে কিছুদিন মাথায় লাল ঝাণ্ডা বেঁধে মিছিল-শ্লোগান করলেও খুব কম সময়ের মধ্যে রাজনীতির মোহমায়া ত্যাগ করে হাসি চক্রবর্তীও একজন শিল্পশিক্ষার্থীর সমূহ ব্যতিক্রমী কার্যক্রম ও চর্চার মধ্যে প্রবেশ করতে বাধ্য হন। একটি শিল্পশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাপদ্ধতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা প্রধানত ব্যবহারিক, মাধ্যমিকের তাত্ত্বিক পঠন পাঠন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পরবর্তী ডিগ্রী গ্রহণের ক্ষেত্রেও এমন কি অন্যান্য ব্যবহারিক বিষয় (বিজ্ঞানের কোন বিষয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বা আর্কিটেচার) থেকেও আলাদা। কারণ অন্যান্য বিষয়ের যে রকম নির্দিষ্ট ব্যবহার উপযোগিতা রয়েছে, শিল্পকলা তথা চিত্রকলা সেরকম না। বরং স্থান ও কালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজের সৃষ্টিশীলতাকে পঠিত কলাকৌশলের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হয়, যা শিল্পীর নিজস্ব শিল্পদর্শনকে ধারণ করবে এবং একই সঙ্গে শিল্পীকে নিজস্ব পরিচয়ে চেনাবে। তাই প্রতিষ্ঠানে শিল্পশিক্ষার একাডেমিক পদ্ধতিতে শিল্পশিক্ষার পাঠ গ্রহণ করতে করতে একজন শিল্পশিক্ষার্থীকে যেমন তার স্থান, কাল ও সময়কে নিজ অভিজ্ঞতায় ধারণ করতে হয়, তেমনি ক্রমে এক অদৃশ্য দর্শক শ্রেণীর সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। যা পরবর্তীতে তাঁর পুরো শিল্প জীবনের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। সঙ্গে সঙ্গে একটি নিজস্ব শিল্পভাষার আবিষ্কারও একজন শিল্পীর প্রধান ভাবনার বিষয় হয়ে উঠে।

হাসি চক্রবর্তী যখন ঢাকা আর্ট কলেজে পাঠ গ্রহণ করতে এলেন সেইসময় চিত্রকলায় সিনিয়র শিল্পীদের দুটি শক্তিশালী ধারা প্রবহমান। প্রথম ও প্রধান ধারার শিল্পীরা তাঁদের শিল্পচিন্তা প্রকাশে বিষয়বস্তুকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। এই ধারার প্রধান শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, এস.এম.সুলতান, সফিউদ্দিন আহমেদ, খাজা শফিক আহমদ, আনোয়ারুল হক, মোস্তফা মনোয়ার প্রমুখ শিল্পীদের ছবিতে বাস্তববাদী রীতির বিকাশ ঘটেছিল। পরবর্তীতে তাঁদের ছাত্রদের একটি মেধাবী দল সরাসরি পাশ্চাত্য শিল্পকলার সাহচর্যে এসেছিলেন। তাঁদের হাত ধরে এদেশের চিত্রকলায় এসেছে পাশ্চাত্যধর্মী উপস্থাপনের রীতিনীতি। বিদেশ ফেরত সে শিল্পীদের কেউ কেউ বিশুদ্ধ রীতিতে, কেউ কেউ আধা বিমূর্ত রীতিতে শিল্পচর্চা করে ছিলেন। সেই দ্বিতীয় দলের প্রধান শিল্পীরা হলেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম, মো. কিবরিয়া, হামিদুর রহমান, আ. রাজ্জাক, মুর্তজা বশীর, রশীদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, কাইয়ূম চৌধুরী, আ. বাসেত, ভাস্কর নভেরা আহমেদ, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, নিতুন কুন্ডু, হাশেম খান, সমরজিত রায় চৌধুরী, আবু তাহের, আ. মতিন, শিল্পী মাহতাব, শামসুল ইসলাম নিজামী, আনোয়ার জাহান প্রমুখ। যুদ্ধ পরবর্তী দেশে বিরাজমান অস্থিরতায় অপেক্ষাকৃত তরুণ শিল্পীদের স্বপ্ন ও সামর্থ্যের সমন্বয়ে চিত্র রচনায় তরুণ শিল্পীদের এই দুটি ধারার কোনটিই যথেষ্ট মনে হয় নি। হাসি চক্রবর্তী তাঁর সেই সময়কার শিল্পভাবনা ও প্রয়াসকে তাঁর ‘আমাদের শিল্পকলা ও শিল্পদর্শন’ প্রবন্ধে বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন।

রিমেমবারেন্স ০১, ১৯৯১

“বস্তুত আমাদের সময় ছিল অস্থির এবং আমরা ছিলাম তরুণ। যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক টানাপড়েন শিল্পীসমাজকেও অস্থির করে তুলেছিল। চিত্রকলায় যা কিছু আমাদের চারপাশে ছড়ানো ছিল, মন তাতে স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছিলো না। অথবা এভাবে বলা যায়, আমরা নিজেদের জন্য এমন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করতে চেয়ে ছিলাম যা হবে স্বতন্ত্র এবং শ্রেষ্ঠ। আমাদের পূর্বসূরিদের ছবির আবেগ থেকে আমাদের উপলব্ধি ছিল ভিন্ন, বলার কথা ছিল অন্য— তাই আমাদের প্রয়োজন ছিল একটি ভিন্ন প্রকাশভঙ্গী। অভিজ্ঞতার ঝুড়ি তখনো তেমন সমৃদ্ধ নয়; কিন্তু প্রকাশিত হবার আকাঙ্ক্ষা ছিল তীব্র, বলা যায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তীব্র। মনে রাখতে হবে যে, আজকের মতো আমাদের সামনে বিশ্বের সবগুলো দরজা- জানালা এমন হাট করে তখন খোলা ছিল না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের চিত্রকলার যেটুকু খবর শিল্পকলার ইতিহাসের পাঠ্য হিসেবে আমাদের সামনে এসে পৌঁছেছিল, তা আমরা পরীক্ষার খাতা পর্যন্ত টেনে নিতে রাজি ছিলাম, কিন্তু সেসব বিষয় বা চিত্রের রীতি বা আভাস ক্যানভাসে টেনে আনার মতো প্রলুব্ধ আমাদের করে নি। আমরা আমাদের জন্য একটি পৃথক চিত্রভাষার অন্বেষণ করছিলাম — যার ঠিকানা আমাদের পুরোপরি জানা ছিল না। বিদেশ ফেরত শিল্পীশিক্ষকদের কাজের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ছাড়া নিম্নমানের মুদ্রিত বিদেশি চিত্রের কিছু রি-প্রোডাকশন আমাদের দেখা ছিল। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন ছিল এমন ইঙ্গিতময়তা ও রূপের -যা একই সঙ্গে দৃশ্য এবং অর্থময়তার সংঘাতে তীব্র হয়ে উঠতে পারে, প্রতীকী আভাসে ধারণ করতে পারে আমাদের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, ব্যর্থতা ও সাফল্যের প্রয়াসকে। সেই অন্বেষায় আমাদের ছবি কমবেশি প্রতীকধর্মী হয়ে উঠলো। আমাদের তখনকার ছবিতে সময়ের অস্থিরতা, নৈরাশ্য, প্রতিবাদ, আক্রোশ এবং যৌবনের রোমান্টিকতা ইত্যাদি প্রতীকী চেহারায় প্রকাশিত হতে চেয়েছে স্ব-স্ব শৈলী অনুযায়ী। কারো কারো ছবিতে স্যুররিয়ালিস্টিক লক্ষণও লক্ষ্য করা গেছে। অর্থাৎ মূর্ত, বিমূর্ত বা আধাবিমূর্ত - যে রীতিতেই অঙ্কিত হোক না কেন প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হওয়া ছিল এই ধারার চিত্রীদের বৈশিষ্ট্য।”

সে ধারার প্রধান শিল্পীরা হলেন শিল্পী চন্দ্রশেখর দে, হাসি চক্রবর্তী, মনসুর-উল-করিম, কাজী হাসান হাবিব, বনিজুল হক, শাহাবুদ্দিন, অলক রায়, কে,এম,এ কাইয়ুম মোমেনুল রেজা, আসেম আনসারী, মারুফ আহমেদ,ইব্রাহিম, ফরিদা জামান, নাঈমা হক, নাসিম আহমেদ প্রমুখ শিল্পী। ছাত্রাবস্থায় এই মানসিকতার ১২ জন শিল্পী ১৯৭৩ সালে “পেইন্টার্স গ্রুপ” নামে  বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় ছাত্র সংসদ গ্যালারিতে একটি গ্রুপ প্রদর্শনী করে। যা সেসময়কার শিল্পী সমাজে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। ছাত্রাবস্থায় একাডেমিক কাজের বাইরে এরকম ‘মডার্ন’ কাজের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শিল্পশিক্ষকদের তেমন পছন্দের ছিল না। কিন্তু এই গ্রুপের অন্যতম সদস্য শিল্পী চন্দ্রশেখর দে বিশ্বাস করেন এই প্রথাবিরোধী ধারাটিই বাংলাদেশের  শিল্পাঙ্গনে আধুনিকতাকে আহ্বান করে এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে সম্ভাবনার পথ খুলে দেয়।

ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে বি.এফ.এ শেষ করে ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে এম.এফ.এ করতে এসেছিলেন হাসি চক্রবর্তী। এম.এফ.এ শেষ করে চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজে প্রথমে খন্ডকালীন, পরে পূর্ণকালীন শিক্ষক হিসেবে, আরো পরে অধ্যক্ষ এবং চারুকলা কলেজ সরকারি চারুকলা কলেজে পরিণত হলে আবারও শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। ২০০৭ সালে সরকারি নিয়ম অনুসারে অবসরে যান সরকারি চারুকলা কলেজ থেকেই। তবে চারুকলা কলেজে তাঁর চাকরিকাল নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে বদলী হয়ে যান এবং দশ বছর পর সরকারি চারুকলা কলেজে পুনরায় ফেরত না আসা পর্যন্ত ওখানেই কাজ করেছেন।

এ নাইট ইন লেট অটাম, ১৯৮০

হাসি চক্রবর্তী চট্টগ্রামে এসেছিলেন একজন সহায় সম্বলহীন তরুণ হিসেবে। যুদ্ধ পরবর্তীতে তাঁর জীবনযাত্রা ছিল একেবারে একা ও শিকড়হীন। বরিশালে পৈত্রিক সহায় সম্পত্তি হারানো, ’৭৩ সালে বাবার মৃত্যু এবং যুদ্ধ পরবর্তী নানা বিপর্যয় ও সামাজিক ভাঙ্গনে পুরো পরিবারের দেশান্তর তাঁকে একেবারে স্বজনহীন স্থায়ী ঠিকানাহীন একজন শহুরে মানুষে পরিণত করেছিল। ১৯৭৬ সালে বিয়ে করেন তিনি। আমার পঠনপাঠন বাংলা সাহিত্য নিয়ে সেই সময়ের অনার্সের নিয়মানুসারে অনার্সের প্রধান বিষয়ের পাশাপাশি দুটো সাবসিডিয়ারি বিষয়ও অধ্যয়ন করতে হতো। আমার অধীত দুটি বিষয়ের একটি ছিল চারুকলা। পরবর্তীতে প্রায় আঠারো বছর চারুকলা কলেজে প্রি ডিগ্রী ক্লাসে ‘বাংলা’ বিষয় এবং বি.এফ.এ ডিগ্রী ক্লাসে ‘নন্দনতত্ত্ব’ নামে একটি বাধ্যতামূলক বিষয়ে আমি পাঠদান করেছি। চারুকলা বিষয়ে আমার যে যৎকিঞ্চিত জানা বা জ্ঞান তার প্রায় সবটুকু হাসি চক্রবর্তীর কাছ থেকেই পাওয়া। একজন চিত্রশিল্পীর চিত্রভাবনা প্রথমে ‘লেওয়াটে’ ও ধীরে ধীরে  রঙে-রেখায়-ফর্মে ক্যানভাসে ক্রমে কিভাবে ছবি হয়ে ওঠে তা দেখেছি। সঙ্গে কত শিল্পী-বন্ধু, কত জ্ঞানী-গুণী শিল্পীর পরস্পর কথোপকথন, ম্যারাথন আড্ডা- বাসায়, মেঝের উপর পড়ে থাকা স্কেচ খাতায় যার যা খুশি যখন খুশি আঁকাআঁকি, তাদের সাহচর্য, ক্রোধ, নিন্দা, প্রশংসা সবকিছুর ভিতর দিয়ে চারুকলার একটা রহস্যময় জগত রং, রেখা, ভাষা-পরিভাষা নিয়ে আমার সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে। চারুকলা বিষয়ে আমাকে সরাসরি তাত্ত্বিক শিক্ষা নিতে হলো যখন হাসি চক্রবর্তী তাঁর কিছু শিল্পবিষয়ক চিন্তা ভাবনাকে লেখায় রূপ দিতে চাইলেন। লেখার কাজটা আমাকে করতে হলো। ভাষায় তাঁর ভাবনাকে রূপ দেওয়া কিছুটা কঠিন যখন আমি চিত্রশিল্পী নই, যখন ভাবনাটা পুরোপুরি আমার নয়, আবার তা শ্রুতিলেখনও নয়। তার আগে আমি তাঁর একক প্রদর্শনীর ক্যাটালগগুলোতে তাঁর কথাকে ভাষায় রূপান্তর করেছি মাত্র। শিল্পীর সঙ্গে ক্রমাগত আলাপ ছাড়াও তখন থেকে বাংলায় লেখা দেশি বিদেশি নানা শিল্পসমালোচকের শিল্প ইতিহাস, শিল্পতত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধ ও বই কখনো একা, কখনো একসঙ্গে পড়েছি। আজ এই লেখাটিও এসব জানাজানি চেনাচিনির আলোকে লেখা।        

১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম আর্ট কলেজে এস এম সুলতানের সঙ্গে হাসি চক্রবর্তী এবং ছায়া দে।

হাসি চক্রবর্তীর ১৯৭৫ এ আঁকা চার কি পাঁচটি ছবি - (যতটা মনে পড়ে ছবিগুলো তাঁর মাস্টার্সের কাজ) বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত “প্রথম নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনী ১৯৭৫”তে ছিল। সে প্রদর্শনীতে “কম্পোজিশন উইথ আই” ছবিটি চিত্রকলা মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করে। এই প্রদর্শনীর ছবিগুলোই আমার  দেখা তাঁর প্রথম ছবি। ‘কম্পোজিশন উইথ আই’, ‘ইমেজ অব লাভ’ সিরিজের সম্ভবত তিনটি ছবি। হার্ডবোর্ডের উপর তেলরঙে আঁকা ছবিগুলোতে নানা বস্তু ও ফর্মের উপস্থাপনা আপাতসম্পর্কহীন মনে হলেও সব মিলিয়ে বেশ একটি জমাটি রচনা এতোটাই উজ্জ্বলতায় নির্মিত হয়েছিল যা চোখকে ছবি থেকে দৃষ্টি ফেরাতে দেয় না। ‘কম্পোজিশন উইথ আই’ ছবিটি হাসি চক্রবর্তীর সমগ্র চিত্রচর্চার একটা দিক নিদর্শনা দেয়। সমস্ত পটভূমি জুড়ে একটি হরিণ, বেশ বড় আকৃতির একটা মানব চক্ষু, শ্রেণীবদ্ধ তিনটি মাছের শরীরের পাশে মাছের কাঁটা, জ্বলন্ত মোমবাতি, প্যাঁচা – এসব নিয়ে বিন্যস্ত কম্পোজিশন। প্রতীকধর্মীতা তাঁর ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলেও পরবর্তী সময়ে ক্রমে বুঝেছি তাঁর ছবিতে ব্যবহৃত এই সব প্রতীক বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক বা তাত্ত্বিক অর্থের চেয়ে দৃশ্যগত অভিজ্ঞতার রসেই বেশি পুষ্ট।

হাসি চক্রবর্তী। ছবি- ছায়া দে, ১৯৮০

১৯৭৬ সাল থেকে হাসি চক্রবর্তীর জীবনভর চিত্ররচনার পুরো অধ্যায়টি আমার সামনে রচিত। তেলরঙ তাঁর প্রধান মাধ্যম, ১৯৮২ সালে বিমূর্ত ধারার একটি সিরিজ অঙ্কনে এনামেল রং মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা ছাড়া তাঁকে তেলরঙ ছাড়া আর কোন মাধ্যমে তেমন স্বাচ্ছন্দ্য দেখি নি। চিত্ররচনায় ক্রমে বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা চেয়ে রং ব্যবহারে তাঁর অধিক মনোযোগ লক্ষ্য করেছি। রঙ তৈরিতে স্বনিয়ন্ত্রিত এক শৃঙ্খলা এবং রং ব্যবহারে নিজস্বতা তাকে তখন থেকেই অন্য শিল্পীদের চেয়ে আলাদা করে চিনিয়েছে। তাঁর প্রথম পর্যায়ের চিত্রকলায় বিষয়বস্তু হিসেবে নানা রকম প্রতীক ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমে প্রকৃতির সহজ রূপায়নে রূপান্তর হয়েছে। তাঁর অঙ্কিত পুরো চিত্রযাত্রায় আমার মনে হয় তাঁর ছবিগুলোর মধ্যে একটা ধারাবাহিক রূপান্তর আছে; তাঁর রঙ ও রঙের ব্যবহার-পদ্ধতি, বিষয় ও বিষয়-উপস্থাপনরীতির সূক্ষ্ম পরিবর্তন এক ছবি থেকে আর এক ছবিতে গড়িয়ে গেছে। চিত্রকলা একটি দর্শন ইন্দ্রিয়নির্ভর শিল্পমাধ্যম, তাই একজন চিত্রশিল্পীকে তাঁর চিত্রকর্ম নিয়ে বার বার দর্শকশ্রেণীর সামনে দাঁড়াতে হয় এবং চিত্রপ্রদর্শনী ছাড়া আর কোন উপায়ে তা সম্ভব নয়। চিত্রশিল্পীদের কাছে তাই সবসময় একক প্রদর্শনীর মতো যৌথ প্রদর্শনীগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ, তাতে যেমন নিজের সৃষ্টির ক্রমপরিবর্তনের সুরটি দর্শকশ্রেণীর কাছে মেলে ধরা যায়, তেমনি অনুসন্ধিৎসু দর্শকও এক শিল্পীর শিল্পকর্মের সঙ্গে অন্য শিল্পীর শিল্পকর্মকে মিলিয়ে দেখার অনির্বচনীয় উপভোগেরও সামিল হতে পারেন। শিল্পকলার যুগধর্মটিও অবলীলায় যৌথ প্রদর্শনীতে ধরা পড়ে।

হাসি চক্রবর্তী তাঁর সময়ে আয়োজিত ও আমন্ত্রিত দেশে বিদেশের প্রায় সব যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। সংক্ষেপে তা লিপিবদ্ধ করলাম।

GROUP EXHIBITIONS

•      Calcutta, India, Paintings from Bangladesh, 1971

•      Delhi, India, Paintings from Bangladesh, 1972.

•      Ethnological Museum of Dresden, East Germany, Contemporary Bangladesh Art Exhibition, 1978.

•      Whitechapel Art Gallery of London, United Kingdom, Selected Fifty Paintings of Bangladesh, 1979.

•      Dhaka, Bangladesh, Asian Art Bangladesh, 1981.

•      Sofia, Bulgaria, Contemporary Bangladesh Art Exhibition, 1982.

•      Dhaka, Bangladesh, 2nd Asian Art Biennale Bangladesh, 1983.

•      Czechoslovakia, Selected Drawings and Prints from Bangladesh Exhibition, 1984.

•      Kualalumpur, Malaysia, Contemporary Paintings of Bangladesh, 1985.

•      Dhaka, Bangladesh, 3rd Asian Art Biennale Bangladesh, 1986.

•      National Gallery of Modern Art, New Delhi, India, Contemporary Paintings of Bangladesh, 1987.

•      Alhamra Art Gallery Lahore, Pakistan, 1st Art Biennale of Pakistan, 1988.

•      Fukuoka, Japan, 4th Asian Art Biennale Bangladesh and 3rd Asian Art Show, 1989.

•      Harare, Zimbabwe and Zambia, Contemporary Paintings of Bangladesh, 1990.

•      Dhaka, Bangladesh, 5th Asian Biennale, 1991.

•      Habana, Cuba, Forth Habana Biennale, 1991.

•      India, Contemporary Painting Exhibition of South Asian Country Festival, 1992

•      Dhaka, Bangladesh, 6th Asian Art Biennale Bangladesh, 1993

•      Dhaka, Bangladesh, 7th  Asian Art Biennale Bangladesh, 1995

•      Dhaka, Bangladesh, 8th  Asian Art Biennale Bangladesh, 1997

•      Dhaka, Bangladesh, 9th Asian Art Biennale Bangladesh, 1999

•      Dhaka, Bangladesh, 10th Asian Art Biennale Bangladesh,  2001

•      Anniversary Exhibition, rooted creativity Bengal Gallery of Fine Arts.2010

•      Bangladesh Shilpakal Academy, Dhaka, National Art Exhibitions 1976,1977,1982,1985,1986,1989,1992.

•      Bangladesh Shilpakal Academy, Dhaka. Young Painter’s Exhibitions, 1976, 1980, 1982, 1989.

            

১৯৭৬ সালে হাসি চক্রবর্তীর প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী চট্টগ্রাম ক্লাবে। এর চার বছর পর ১৯৮০ সালে দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী সাজু আর্ট গ্যালারি, গুলশানে। এই চার বছরে দর্শকশ্রেণীর কাছে তাঁর নিজস্ব একটি চিত্রভাষা পরিচিত উঠেছে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত ‘নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনী’তে সকল মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ শিল্পীর পুরস্কার লাভ করেছেন। বিষয় উপস্থাপনে প্রতীকধর্মীতাকে একেবারে ত্যাগ না করলেও তাঁর ছবিতে রং ক্রমশ প্রধান হয়ে উঠছে এবং প্রকৃতির রূপ রূপায়নে স্থিত হয়েছেন। তাঁর সমগ্র শিল্পচর্চায় শিল্পী বারবার তাঁর চিত্রকলার অন্যতম উপাদান হিসেবে রঙের প্রাধান্যের কথা জানিয়েছেন। তিনি চিত্রপটে রং, রেখা ও কম্পোজিশনের সাবলীল বাঁধুনি দিয়ে একটি অনন্য শৈলী রচনা করতে চান যা একান্তভাবে তাঁর পরিচয় বহন করবে। ড্রইং শিল্পীর নিত্যদিন ও ক্ষণের সঙ্গী। তাঁর ড্রইং নিরাভরণ কালির ঋজু, স্পষ্ট, একরৈখিক, সামান্য কিন্তু অসামান্য-রূপী এবং ইংগিতধর্মী, তাই কাব্যিক।

তৃতীয় প্রদর্শনী ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে। শৈশব-কৈশোরের নদীনালা জড়াজড়ি এক মায়াবী প্রকৃতির বরিশাল ছেড়ে এলেও সবুজ বনানী আর সমুদ্র ও পাহাড়বেষ্টিত চট্টগ্রামের প্রকৃতি তাঁর সৃষ্টিশীলতার অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে এবং ক্রমে বিষয়বস্তুতে প্রতীকের পাশাপাশি প্রকৃতির সরল রূপায়ন প্রধান হয়ে ওঠে। ‘প্রকৃতির রূপবৈচিত্র আমাকে আকর্ষণ করে, তাই যখনই মনে মনে একটি ছবি করতে চাই তখন তা-ই হয়ে ওঠে।” – এটি তাঁর এই প্রদর্শনীর মূল সুর।  ১৯৮৯ সালে চতুর্থ একক প্রদর্শনী জার্মান কালচারাল সেন্টারে এবং পঞ্চম প্রদর্শনী ১৯৯৩ সালে যোজন কন্টেম্পোয়ারি আর্ট গ্যালারিতে। শিল্প সমালোচকদের বিবেচনায় হাসি চক্রবর্তীর চিত্রভাষা ততদিনে পরিণত রূপ ধারণ করেছে। ক্যানভাসে আলোছায়া নির্মাণে বিষয়বস্তু নয়, রঙ-ই হয়ে উঠেছে তাঁর প্রধান হাতিয়ার। এই প্রসঙ্গে ছাত্র হাসি চক্রবর্তীর চতুর্থ একক প্রদর্শনীর ছবি সম্পর্কে বিশিষ্ট তেলরঙ শিল্পী ও শিল্প-শিক্ষক মোহাম্মদ কিবরিয়ার বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ।

‘His skill in the art of colour-mixing in Canvas is worth-seeing. Of all the colour, the use of black is prominent which has made his paintings powerful and complete. Besides, has use of blue and yellow colours has made his paintings suggestive and successful.’

তিনিই আবার শিল্পীর পঞ্চম একক চিত্রপ্রদর্শনীর চিত্রমালায় রঙ ব্যবহারের বৈচিত্র্যকে একজন সচেতন পর্যবেক্ষণকারীর দৃষ্টিতে সনাক্ত করেন।

‘Though Hashi especially works on basic forms but he is again keeping white space in his works which is different from his earlier works. Use of colour is quite bold. His creative thoughts are very clear. His experiences are clearly noticeable in his paintings.’

শিল্পীর শেষ দুটি একক প্রদর্শনী সুইডেনে, ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে। ব্যক্তিগত ইউরোপ ভ্রমণের সময় ওখানেই এঁকেছেন ছবিগুলো। তাঁর নিজের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘I have tried to draw the speed of colour and line. In a different way, it’s the speed of life.’

১৯৯১-১৯৯২ এরপর থেকে তাঁর ছবিতে সমাজ জীবনের নানা টানা পোড়েন, ব্যক্তিগত ও পারিপার্শ্বিক জীবনযাত্রার নৈরাশ্য, অস্থিরতা, জটিলতা মূর্ত, আধা মূর্ত ও বিমূর্ততায় প্রকাশ পেয়েছে।

কোন শিল্পীর ছবিকে কখনই ভাষায় যথাযথভাবে ব্যক্ত করা যায় না। চিত্রকলা হচ্ছে স্থির রূপকল্পের বিন্যাস, চিত্রিত কোন বস্তুর প্রতিরূপ বা প্রতীকের বর্ণনাও চিত্রটির যথাযথ পরিচয় দিতে পারে না। এই ধরনের লেখা শিল্পীকে তাঁর স্থান কালের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে তাঁর শিল্প-প্রবণতার আভাস দিতে পারে মাত্র। যেকোন চিত্রশিল্পীই তাঁর চিত্রে স্থির রূপকল্পটি এমনভাবে নির্মাণ করতে চান যা তাঁর শিল্পদর্শনকে যেমন প্রকাশ করে, তেমনি রূপকল্পটির অপ্রকাশ্য প্রবাহটিকেও দর্শকের কাছে কোনো না কোনো ভাবে প্রবাহিত করে দিতে পারে। পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের  দেশের শিল্পকলার মূল প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করাতে হলে অবশ্যই পূর্ববর্তী শিল্পীদের ভূমিকা ও শিল্পরীতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। 

চিত্ররচনার পাশাপাশি হাসি চক্রবর্তীর সাংগঠনিক কাজের আগ্রহও তাঁর জীবনযাত্রাকে অনেকটাই পরিচালিত করেছে। ঢাকা আর্ট কলেজে পড়াকালীন সময় ‘পেইন্টার্স গ্রুপ’কে ঘিরে তাঁর যে সাংগঠনিক স্পৃহা পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ, ‘ফাইভ ফিংগারস্’(১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত শিশু সংগঠন) এবং চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর শিশু কিশোরদের জন্যে প্রতিষ্ঠিত ‘হাসিস্ স্টুডিও’ এর উদাহরণ। হাসি চক্রবর্তীর জীবনে শিল্পী রশিদ চৌধুরীর প্রভাবের কথা উল্লেখ করে বন্ধু চন্দ্রশেখর বলেন, “শিল্পী রশিদ চৌধুরী হাসিকে একটি অন্যধরনের স্বপ্নের ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলেন। চারুকলা কলেজকে ঘিরে এক অদ্ভুত প্যাশন আমার মনে হয় ওকে একেবারে নেশাগ্রস্ত করে রেখেছিল, কিন্তু কলেজকে ঘিরে নানা ঘাত প্রতিঘাতের সেই সময়গুলিতে আঁকা কোন ছবিতে ঘাত প্রতিঘাতের কোন প্রতিফলন ছিল না। ‘Image of Love”, ‘The Episode Of Forest.’  সিরিজের ছবিগুলো সেই সময়ের আঁকা ছবি।’ 

ছবি আঁকার পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক দেয়ালচিত্র অঙ্কন, প্রচ্ছদ, পোস্টার ইত্যাদিও করেছেন সমান মনোযোগ ও যত্নের সঙ্গে। শিল্পকলা ও শিক্ষা বিষয়ক কিছু লেখালিখিও করেছেন, ‘রেখা ও লেখায় হাসি চক্রবর্তী’ নামে তাঁর একটি গ্রন্থ রয়েছে।

 হাসি চক্রবর্তী ব্যক্তি চরিত্রে আসঙ্গলিপ্সু এক মানুষ, জন্মস্থানের শিকড় উপড়ানো এই যুবক সারা জীবন বন্ধুবান্ধবের হৃদয়ে শিকড় ছড়াতে চেয়েছে। মারাত্মক আবেগপ্রবণ ও রাগপ্রধান তিনি শেষ বয়সে নিঃসঙ্গ এক মানুষ। পুরাদস্তুর পারিবারিক হয়েও হৃদয়ে সন্ন্যাসী। প্যালেটে রং তৈরির কারিগর তিনি, ছবিতে রঙের কবি, স্থির শান্ত এক প্রকৃতি প্রেমিক। 

ছায়া দে চিত্রকর হাসি চক্রবর্তীর স্ত্রী এবং অবসরপ্রাপ্ত বাংলার অধ্যাপক।

ছবি: হাসি চক্রবর্তীর পরিবারের কাছে থেকে সংগৃহীত

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

5h ago