বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যা
কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলা অনন্তপুর সীমান্তে ১৫ বছর বয়সী ফেলানী খাতুনের বীভৎস হত্যার নবম বার্ষিকী গেল গত ৭ জানুয়ারি।
নয়াদিল্লীতে গৃহকর্মীর কাজ করা ফেলানী সেদিন তার বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরছিল। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার সময়, ফেলানীর পোশাক কাঁটাতারের বেড়ায় জড়িয়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে সে চিৎকার শুরু করে। ভারতের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী (বিএসএফ) সেই চিৎকারের জবাব দেয় তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে। সেখানেই ফেলানী মারা যায়। মধ্যযুগীয় কায়দায় তার প্রাণহীন দেহটি প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে উল্টোভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। হয়তো অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকারীদের ভয় দেখাতে!
ফেলানী হত্যার ফলে বাংলাদেশে এবং ভারতেরও কোনো কোনো মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয় ফেলানীর ঝুলন্ত দেহের ছবি। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও ন্যায় বিচারের দাবি থাকলেও প্রধান আসামি বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ এবং তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিএসএফের নিজস্ব আদালত জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে নির্দোষ প্রমাণিত হন। রায় পুনর্বিবেচনা করেও একই আদালত সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। ফেলানীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশও আমলে নেওয়া হয়নি।
সীমান্তে বেসামরিক নাগরিক হত্যার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছিলেন যে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে মোট ২৯৪ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। তিনি আরও জানান, ২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫ জন, ২০১১ ও ২০১২ সালে ২৪ জন করে, ২০১৩ সালে ১৮ জন, ২০১৪ সালে ২৪ জন, ২০১৫ সালে ৩৮ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন এবং ২০১৮ সালে মাত্র ৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।
শেষ তিন বছরে সীমান্তে হত্যার সংখ্যা ধারাবাহিক ভাবে কমে যাওয়ার পরিসংখ্যান দেখিয়ে মন্ত্রী এই ধরনের হত্যা আরও কমে যাওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু, সে অনুযায়ী কাজ হয়নি। ২০১৮ সালে সীমান্তে নিহতের সংখ্যা তিন হলেও ২০১৯ এ তা বারোগুণ বেড়ে দাড়ায় ৩৪-এ। যদিও শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বেসরকারি সূত্র অনুযায়ী এই সংখ্যা আরও বেশি। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং অধিকার এর সূত্র অনুযায়ী এই সংখ্যা যথাক্রমে ৪৬ এবং ৪১। অধিকার এর নথিপত্রে আরও দেখা যায় ২০১৯ সালে বিএসএফের হাতে অন্তত ৪০ জন বাংলাদেশি আহত হয়েছে এবং আরও ৩৪ জন অপহৃত হয়েছেন। আসক এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছে ৪৬ জনের মধ্যে ছয় জনকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।
বিএসএফ এই ধরনের মৃত্যুকে ‘হত্যা’ না বলে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু’ বলে আখ্যায়িত করছে। ২০১৯ সালের ১২ থেকে ১৫ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিজিবি ও বিএসএফের মহাপরিচালকের (ডিজি) বৈঠকের পর, বিএসএফের ডিজি জোর দিয়ে বলেছেন যে এ জাতীয় মৃত্যুগুলো 'হত্যা নয়, অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু' । তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে ‘দুর্বৃত্তরা হামলা চালালে আত্মরক্ষায়’ বিএসএফ সদস্যরা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেন। ২০১৮ সালের এপ্রিলে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করা হয়েছিল। যেখানে সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনায় প্রাণঘাতি অস্ত্রের ব্যবহার না করার ব্যাপারে উভয় দেশ একমত হয়। কিন্তু, এক্ষেত্রে স্পষ্টতই এই চুক্তির লঙ্ঘন করা হয়েছে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভারতের দিল্লিতে বিজিবি-বিএসএফের ডিজি পর্যায়ের সাম্প্রতিক বৈঠকের পর বিজিবির প্রধান গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যে তিনি সীমান্তে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি নিহত হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এর জবাবে বিএসএফ আরও সতর্ক ও সজাগ থাকার আশ্বাস দিয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এই জাতীয় অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু এড়ানো যায়।
ঘটনাচক্রে, দুই সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর প্রধানরা সংবাদ সম্মেলন করার একদিন আগে বিএসএফের হাতে একজন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হন।
১১ জানুয়ারি সীমান্তে হত্যার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, “ভারত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সীমান্তে একজন মানুষও মারা যাবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে, সীমান্ত হত্যা একটি বাস্তবতা। এটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।” তিনি আরও বলেছিলেন যে বাংলাদেশ দাবি জানাচ্ছে ভারত যেন প্রতিশ্রুতি পূরণ করে। (সূত্র: প্রথম আলো, ১২ জানুয়ারি ২০১০)
সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার প্রধান কারণ বিএসএফের অতিরিক্ত বল প্রয়োগ। দুই দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। উভয় দেশের বহু মানুষ নদী ভাঙনের কারণে খেত-খামার ও জীবিকা হারিয়েছে। তারা আন্তঃসীমান্ত গবাদি পশু ও পণ্য পাচারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেক ক্ষেত্রে, চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে অনেককে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয় বা হত্যা করা হয়। পণ্য পাচারের জন্য শিশুদেরও ব্যবহার করা হয়। কারণ, তাদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে তারাও সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করে। কিন্তু, বাস্তবতা তা বলে না। বেশ কয়েক বছর আগে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামে একটি প্রতিবেদনে এ ধরনের বেশ কয়েকটি মামলার উল্লেখ করেছে। যাতে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন যে বিএসএফ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা না করে বা সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলি চালায়। বিএসএফ আরও দাবি করেছে যে দুর্বৃত্তরা গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা করলে তাদের সদস্যরা গুলি চালায়। তবে কোনো অপরাধের সন্দেহে প্রাণঘাতি অস্ত্রের ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত হয় না।
নির্যাতনের ঘটনাগুলোর মধ্যে শিশু নির্যাতনের ঘটনাও আছে। ২০১৯ সালের ১০ মে সাতক্ষীরার কুশখালী সীমান্তে বিএসএফের হাতে নির্যাতনের শিকার হন কবিরুল ইসলাম। তার মুখ এবং পায়ুপথে পেট্রল দেওয়া হয়েছিলে। এর ১৭ দিন পর ২৭ মে নওগাঁর শাপার সীমান্তে আজিমুদ্দিন নামের এক রাখালের ১০টি আঙুলের নখ দুষ্কৃতিকারীরা তুলে নেয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
এইচআরডাব্লিউ, অধিকার ও এএসকের প্রতিবেদন এবং সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে অপরাধী হিসেবে সীমান্তে হত্যার শিকার ব্যক্তিরা হয় নিরস্ত্র থাকে অথবা তাদের কাছে বড়জোর কাস্তে, লাঠি বা ছুরি থাকে। এমন ব্যক্তিদের মোকাবিলায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী সম্ভবত অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার করে ফেলছে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে পিঠে গুলি করা হয়েছিল। এইচআরডাব্লিউ আরও উল্লেখ করেছে, তদন্ত করা মামলার কোনোটিতেই বিএসএফ প্রমাণ করতে পারেনি যে হত্যার শিকার ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র বা বিস্ফোরক পাওয়া গেছে; যার দ্বারা তাদের প্রাণ সংশয় বা গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। সুতরাং, বিএসএফের মেরে ফেলার জন্য গুলি চালানোর দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে মানুষের জীবনের অধিকার লঙ্ঘন করে। যা ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের বেআইনিভাবে হত্যায় বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি নয়াদিল্লিতে খুবই কম গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশিকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যের বিবরণ বাংলাদেশকে দেয়নি ভারত। ভারত সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট অনুমোদন না থাকলে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিএসএফকেও ফৌজদারি কার্যবিধির বাইরে রাখা হয়। বিএসএফ সদস্যদের এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকাই সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ভালো প্রতিবেশী দেশ সীমান্তে চলাচলকারীদের সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আচরণ করে। ভারত সরকারের এটা নিশ্চিত করা উচিত যে তার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান করছে এবং আইনের শাসন অনুসরণ করছে। বিএসএফ এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে জাতিসংঘের সাধারণ নীতিমালা মেনে চলার জন্য প্রকাশ্যে আদেশ দেওয়া উচিত। বিএসএফের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত তার সদস্যদের বিচার করতে পারেনি। ভারত সরকার বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে নির্যাতনের মামলাগুলো তদন্তের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।
বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর উচিত একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের জন্য দাবি তোলা। সেখানে এ জাতীয় ঘটনার জন্য ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই অভিযোগ জমা দিতে পারবে। প্রয়োজনীয় প্রমাণও জমা দেবে উভয় পক্ষ। এই কমিশনটি হবে স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ।
২০২০ সালের প্রথম ১৫ দিনে বিএসএফ তিনজন বাংলাদেশিকে সীমান্তে হত্যা করেছে বলে জানা গেছে। বছরের পর বছর ধরে সীমান্তে হত্যা বন্ধ করতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কোনো অর্থবহ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়া বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর। এটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে চাপ বাড়িয়ে বাংলাদেশ সরকারকে একটি কঠিন পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে। এধরনের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্তে আসার জন্য এখনই নয়াদিল্লির নীতিনির্ধারকদের পদক্ষেপ নেয়ার সময়।
সি আর আবরার একজন শিক্ষাবিদ এবং মানবাধিকার কর্মী
Comments