জাহিদ হাসানের অভিনেতা হওয়ার গল্প

Zahid Hasan
অভিনেতা জাহিদ হাসান। ছবি: শেখ মেহেদী মোর্শেদ

টিভি নাটকের অন্যতম দর্শকপ্রিয় তারকা জাহিদ হাসান। নব্বই দশকের শুরুতে টিভি নাটকের নায়কদের মধ্যে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল মুখ। সিনেমা করেও পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অভিনয় নিয়ে এখনও ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তিনি। জাহিদ হাসান বলেছেন তার উঠে আসার গল্প।

আমার ডাক নাম পুলক। মা রেখেছিলেন পুলক নামটি। সিরাজগঞ্জ আমার নিজের এলাকা। ছেলেবেলার বন্ধুরা এখনো পুলক নামেই ডাকেন। কাছের মানুষরাও কেউ কেউ পুলক নামে ডাকেন আজও। জাহিদ নামটি রেখেছিলেন আমার দাদা। পুলক থেকে সবার ভালোবাসায় আজকের জাহিদ হাসান হয়েছি।

পেছনে ফিরে তাকালে কতো কথা মনে পড়ে। কতো স্মৃতি চোখে ভাসে। একজীবনে সেসব স্মৃতি কি ভুলে যাওয়া সম্ভব?

মনে পড়ে, ছেলেবেলায় সিরাজগঞ্জে থাকতে প্রচুর নাটক দেখেছি। শীতের সময় যাত্রাপালা দেখার কথাও মনে পড়ে। সিরাজগঞ্জ শহরে মঞ্চ নাটকের দল ছিলো। সেখানে নাটক দেখার কথাও মনে পড়ে। ওখানে টিকিট কেটে মঞ্চ নাটক দেখার প্রচলন ছিলো। আমিও টিকিট কেটে মঞ্চ নাটক দেখতাম। যাত্রাপালা বেশি দেখা হতো না, মাঝে মাঝে যেতাম।

একবার শুনলাম, সিরাজগঞ্জ শহরে ‘নবাব সিরাজদৌলা’ যাত্রাপালা হবে। ঢাকা থেকে দল আসবে। আনোয়ার হোসেন নবাবের চরিত্রে অভিনয় করবেন। ওই যাত্রাপালা দেখার জন্য সে কী আগ্রহ আমার! টিকিটের দাম পাঁচশ, একশ, পঞ্চাশ ও বিশ টাকা। বড় বড় শিল্পীরা যাবেন বলেই টিকিটের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো।

আব্বাকে বললাম, যাত্রা দেখব। বিশ টাকা দিয়ে আব্বা বলেছিলেন, ‘যাও’। আনোয়ার হোসেনকে দেখে এসো।

স্টেজের খুব কাছে মাটিতে বসে সেই রাতে ‘নবাব সিরাজদৌলা’ যাত্রাপালা দেখেছিলাম। ওই প্রথম আনোয়ার হোসেনকে কাছ থেকে দেখা! কী যে উত্তেজনা কাজ করেছিলো!

স্কুল পাশ করে সিরাজগঞ্জ শহরেই কলেজে ভর্তি হই। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নাটকের দিকে ঝুঁকে যাই। কেননা, অভিনয়ের নেশাটা পেয়ে বসেছে স্কুলজীবন থেকে। যার জন্য কোথাও নাটক বা যাত্রাপালা হলে দেখতে যেতাম।

কলেজে পড়ার সময়ে তরুণ সম্প্রদায় নাট্যদলে যোগ দেই। সেই দলের হয়ে কয়েকটি নাটকে অভিনয় করি। ‘সাত পুরুষের ঋণ’ নাটকটির কথা বলতেই হয়। নাটকটি ১৯৮৪ সালের ১০ আগস্ট বিটিভিতে সরাসরি প্রচারিত হয়েছিলো। সেই সময়ে আমার জন্য বিষয়টি অনেক বড় ছিলো।

ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে আমার বেশিরভাগ বন্ধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। আমিতো নাটক করতে চাই। আমাকে ঢাকায় আসতে হবে। ঢাকায় না এলে নাটক করতে পারবো না। আমার আশা পূরণ হবে না। বাড়ি থেকে অবশ্য কেউ তা চাচ্ছিলো না।

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলাম। ভর্তিও হয়েছিলাম। কিন্তু, মনটা পড়ে থাকলো ঢাকা শহরে। কিছুদিন সেখানে পড়ার পর চলে আসি ঢাকায়। কারণ, অভিনেতা হতে হবে। পড়ালেখা শুরু করি এই শহরে। আর ভেতরে ভেতরে স্বপ্ন দেখি- অভিনয় করবো।

১৯৮৬ সালে ‘বলবান’ নামের একটি সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পাই। এটি ছিলো বাংলাদেশ-শ্রীলংকা ও পাকিস্তান প্রযোজিত একটি সিনেমা।

১৯৮৯ সালে বড় একটি সুযোগ আসে আমার জীবনে। বিটিভিতে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য অডিশন দিই। পাশও করি। আসলে এখনকার মতো ওই সময়ে টিভি নাটকে অভিনয় করাটা অতো সহজ ছিলো না। খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিলো। কাজেই অডিশনে পাশ করার পরপরই নাটকে অভিনয় করতে পারিনি। তারপরও তালিকাভুক্ত হতে পেরেছি- এটাই ছিলো আমার জন্য বড় ব্যাপার।

১৯৯০ সাল আমার জীবনে বড় একটি টার্নিংয়ের বছর। ঢাকায় তখন মঞ্চর্মীদের বেশ ভালো অবস্থা। চিন্তা করি, আমিও মঞ্চ নাটকে অভিনয় করবো। সেবছর মঞ্চ নাটক শুরু করি। যোগ দেই ‘নাট্যকেন্দ্র’-এ। এছাড়া একই বছর প্রথমবার টিভি নাটকে অভিনয় করার সুযোগ এসে যায়।

প্রথম অভিনীত টিভি নাটকটির নাম ছিল ‘জীবন যেমন’। নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন আলীমুজ্জামান দুলু। ভাগ্য প্রসন্ন ছিলো বলে প্রথম টিভি নাটকেই গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র পেয়েছিলাম।

প্রথম টিভি নাটকে অভিনয় করে পেয়েছিলাম ১,২০০ টাকা।

সেসময়ে আড্ডা দেওয়ার কথাটা কখনোই ভুলতে পারবো না। শত কষ্টের মধ্যে থেকেও আড্ডা ঠিকই দিতাম। কখনো টিএসসিতে, কখনো বেইলি রোডে, কখনো রামপুরা টেলিভিশনের কাছে। যেখানেই থাকতাম, মন পড়ে থাকতো রামপুরা টেলিভিশন সেন্টারে। ভাবতাম, কবে সুযোগ পাবো।

আব্বা-আম্মা চাইতেন আমি ডাক্তার হই। কিন্তু, আমি চাইতাম অভিনেতা হবো। এজন্য অভিমান করে অনেকদিন বাড়ি থেকে টাকা নিইনি। অভিমান করার কারণে এক সময় অনেক কষ্ট হয়েছে আমার। তারপরও ঢাকায় পড়ালেখা ও নাটক দুটিই করে গেছি।

আমার নাটকের নাট্যকেন্দ্র ‘বিচ্ছু’ নামের একটি মঞ্চ নাটক করেছিলো। তারিক আনাম খান নির্দেশক ছিলেন। আমি ওই নাটকে বিচ্ছু চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। সেসময়ে ঢাকায় মঞ্চ নাটকের দর্শকদের কাছে ‘বিচ্ছু’ নাটকটি বেশ সাড়া ফেলেছিলো। আমিও বিচ্ছু চরিত্রে অভিনয় করে সবার ভালোবাসা পাই। এরপর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিচ্ছু নাটকটির পর টিভি নাটকেও ব্যস্ততা বাড়তে থাকে।

তবে সে সময়ে বিটিভিতে খুব বেশি নাটক করার সুযোগ সবার ছিলো না। ‘জীবন যেমন’ নাটকটি বিটিভিতে করার বেশ পরে ‘সমাপ্তি’ নামে একটি নাটকে অভিনয় করি। ‘সমাপ্তি’র পর অভিনয় করি ‘সখী ভালোবাসা কারে কয়’, ‘কাশবনের কন্যা’, ‘ছবি শুধু ছবি নয়’ নাটকগুলোতে।

আরও পরে এসে অভিনয় করি হুমায়ূন আহমেদের ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘আজ রবিবার’, ‘সবুজ ছায়া’, ‘সবুজ ছাতা’ ধারাবাহিকগুলোতে। এভাবেই বদলে যায় আমার অভিনয় জীবনের গল্প।

আসলে লেগে থাকার বা সাধনার কোনো বিকল্প নেই। সততা ও ভালোবাসা নিয়ে লেগেছিলাম বলেই অভিনেতা হতে পেরেছি। সারাজীবন অভিনেতা পরিচয় নিয়েই বাঁচতে চাই।

Comments

The Daily Star  | English

PSC announces major changes to ease BCS recruitment process

The PSC chairman says they want to complete the entire process — from prelims to recruitment — in 12 months

7h ago